ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরব জাতির অবস্থা কিরূপ ছিল ?

ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরব জাতির অবস্থা কিরূপ ছিল ?

ইসলামপূর্ব আরব জাতি কি সভ্য ছিল?


‘তামাদ্দুনে ইসলাম ওয়া আরাব’ গ্রন্থের রচয়িতা জাহেলী যুগের আরব জাতির অবস্থা অধ্যয়ন ও গবেষণা করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, আরবগণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সভ্য ছিল। আরব ভূখণ্ডের বিভিন্ন স্থানে আরবদের বিদ্যমান বৃহৎ ও উঁচু ইমারতসমূহ এবং সে সময়ের সভ্য জাতিসমূহের সাথে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক তাদের সভ্যতা ও সভ্য হওয়ার প্রমাণস্বরূপ। কারণ যে জাতি রোমান জাতির আবির্ভাবের আগে উন্নত শহর ও নগর স্থাপন করেছিল এবং বিশ্বের বড় বড় জাতির সাথে যাদের ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল সে জাতিকে অসভ্য-বর্বর জাতি বলা যায় না

আরবী ভাষা-আরবী সাহিত্য 
, আরবী সাহিত্য এবং আরবদের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষার অধিকারী হওয়া তাদের সভ্যতার শিকড় গভীরভাবে প্রোথিত হওয়ারই প্রমাণস্বরূপ। তাই লেখকের বক্তব্য : “আমরা যদি ধরেও নিই যে, আরব উপদ্বীপের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জ্ঞাত ছিলাম না, এরপরও আমরা আরব জাতির অসভ্য হওয়া সংক্রান্ত তত্ত্বটি প্রত্যাখ্যান করতে সক্ষম। একটি জাতির ভাষা সংক্রান্ত যে বিধান সে একই বিধান উক্ত জাতির সভ্যতা সম্পর্কেও প্রযোজ্য। উক্ত জাতির সভ্যতা ও ভাষা একই সাথে অস্তিত্ব লাভ করে থাকতে পারে। তবে তার ভিত্তিসমূহ নিঃসন্দেহে অত্যন্ত প্রাচীন এবং সুদূর অতীতকাল থেকে ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করেছে। কোন পূর্বপ্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ ও ভূমিকা ছাড়াই সংশ্লিষ্ট সাহিত্যসহ কোন ভাষার উদ্ভব ও উন্মেষ সম্ভব নয়। অধিকন্তু সভ্য জাতিসমূহের সাথে সম্পর্ক স্থাপন একটি যোগ্যতাসম্পন্ন জাতির ক্ষেত্রে সর্বদা উন্নতি ও প্রগতির কারণ বলে গণ্য।” উপরিউক্ত লেখক ইসলামপূর্ব আরব জাতির একটি উন্নত ও সুদীর্ঘ সভ্যতা প্রমাণ করার জন্য গ্রন্থের কয়েকটি পৃষ্ঠা বরাদ্দ করেছেন। তাঁর তত্ত্ব তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল।
আধুনিক কালে এসে পৃথিবীর বহু ভাষার মানুষ নিজেদের ভাষার একটা ইতিহাস রচনা করেছে। এসব ইতিহাসে এসব ভাষার প্রাচীনতম সাহিত্যের সন্ধ্যান করা হয়েছে। যেমন ইংরেজি ভাষায় লিখিত সাহিত্যের প্রাচীনতম উদাহরণ ধরা হয় ‘বেওউলফ’, বাংলা ভাষায় ‘চর্যাপদ’ এবং আরবী ভাষায় ‘আল কোরআন’। এর মধ্যে কোরআন সবচাইতে প্রাচিন, সাত শতকের শুরুর ভাগে কোরআন সংকলিত হয়েছে। বেওউলফ লেখা হয়েছে আট থেকে এগার শতক পর্যন্ত সময়ের মাঝে এবং চর্যাপদ আট থেকে বারো শতক পর্যন্ত সময়কালে। সেই হিসাবে বেওউলফ এবং চর্যাপদ সমসাময়িক সাহিত্য। কোরআন তাদের চাইতে সামান্য প্রাচিন।

কোরআনের পূর্বে লিখিত আরবী ভাষার উদাহরণ হাতে গোনা যায়, ব্যপ্তিও যৎসামান্য। লিখিত আরবী ভাষা গড়ে উঠেছে কোরআনকে কেন্দ্র করেই। কোরআনের পূর্বে লিখিত আরবী ভাষার কোন কাঠামো ছিল না, ব্যাকরণ ছিল না। মূলত কথ্য ভাষার আরব সংস্কৃতিতে কোরআনের মতো এতো বড় আকারের একটি লিখিত গ্রন্থ আসমানি মর্যাদা তাই সহজেই লাভ করেছে। প্রাচীন আরবদের কাছে কোরআন ছিল এক বিষ্ময়। কোরআন কেন্দ্র করেই ক্লাসিক আরবী ভাষার কাঠামো এবং ব্যাকরণ গড়ে উঠেছে। কোরআন কেন্দ্র করে এবং কোরআন বুঝতে গিয়েই আরবী ভাষায় প্রাচীন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা প্রশাখা গড়ে উঠেছিল। সুসংবদ্ধ আরবী ভাষায় দর্শন ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মধ্যযুগের আরব-অনারব মুসলমান, খ্রিষ্ঠান ও ইহুদীরা মধ্যযুগের স্বর্ণযুগের জন্ম দিয়েছিল যা বিস্তৃত ছিল পারস্য থেকে স্পেন পর্যন্ত। এশিয়া ও ইউরোপের বিরাট অঞ্চলজুরে আরবী ভাষা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কায় পরিণত হয়েছিল। রেনেসাপূর্ব ইউরোপের মানুষ আরবী থেকে অনুবাদ করেই গ্রিক, আরব, পারস্য ও ভারতের সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শনের জ্ঞান লাভ করেছে। এই কোরআন কেন্দ্র করেই আরবরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং কোরআনের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিতেই আরবরা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের উপর সাম্রাজ্য বিস্তারের বৈধতা আদায় করে নিয়েছিল। উমাইয়া খেলাফতের পতনের পর মুসলিম দুনিয়ায় একচ্ছত্র আরব কর্তৃত্বের সমাপ্তি হলেও কোরআনের কর্তৃত্ব ও প্রভাব অনারবদের মধ্যে আজ অবধি বহমান এবং একবিংশ শতকের সবচাইতে আলোচিত ও সমালোচিত গ্রন্থ হলো কোরআন।

এগুলো হচ্ছে : ১. অতি উন্নত একটি ভাষার (আরবী ভাষা) অধিকারী হওয়া,
২. উন্নত দেশসমূহের সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং
৩. ইয়েমেনের আশ্চর্যজনক ইমারতসমূহ-যা খ্রিষ্টের জন্মের পূর্বে হেরোডোট (Herodote) ও আরটিমিডোর (Artemidor) নামীয় দু’জন প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক এবং মাসউদী ও অন্যান্য মুসলিম ঐতিহাসিক বর্ণনা করেছেন।

আলোচনার অবকাশ নেই যে, আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে সীমিত পরিসরে বিভিন্ন সভ্যতা ছিল। তবে লেখক যে সব দলিল-প্রমাণ তাঁর গ্রন্থে উপস্থাপন করেছেন তা থেকে প্রমাণিত হয় না যে, আরবের সর্বত্র সভ্যতা ছিল।

এটি ঠিক যে, সভ্যতার সকল নিদর্শনের সাথেই একটি ভাষার পূর্ণ বিকাশ হয়ে থাকে। তবে আরবী ভাষাকে স্বাধীন-স্বতন্ত্র এবং হিব্রু, সুরিয়ানী, আশুরী ও কালদানী ভাষার সাথে সংশ্লিষ্টহীন বলে বিশ্বাস করা যায় না। কারণ বিশেষজ্ঞদের সত্যায়ন ও সাক্ষ্য অনুসারে এ সব ভাষা এক সময় একীভূত একক ভাষা ছিল এবং একটি আদি ভাষা থেকে এগুলোর উৎপত্তি হয়েছে। এতদসত্ত্বেও ধারণা করা যায় যে, ইব্রানী (হিব্রু) অথবা অ্যাসীরীয় ভাষাসমূহের মাঝেই আরবী ভাষা পূর্ণতা লাভ করেছে। আর পূর্ণতা লাভ করার পর তা স্বাধীন-স্বতন্ত্র ভাষার রূপ পরিগ্রহ করেছে।


নিঃসন্দেহে বিশ্বের উন্নত জাতিসমূহের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রাখা উন্নতি ও সভ্যতার পরিচায়ক। কিন্তু সমগ্র আরব উপদ্বীপে কি ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল অথবা প্রধানত হিজায অঞ্চলটি কি এ ধরনের সম্পর্ক থেকে বঞ্চিত ছিল? অন্যদিকে ইরান ও রোম সাম্রাজ্যের সাথে হিজাযের দু’টি সরকার শাসিত অঞ্চলের (হীরা ও গাসসান) সম্পর্ক থেকে আরব জাতির সভ্যতার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না। কারণ উক্ত সরকারদ্বয় সম্পূর্ণরূপে বিদেশী শক্তির সমর্থন ও মদদে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। আজও আফ্রিকা মহাদেশের অনেক দেশই পাশ্চাত্য দেশসমূহের উপনিবেশ। কিন্তু ঐ সব দেশে প্রকৃত পাশ্চাত্য সভ্যতার কোন নিদর্শনই বিদ্যমান নেই।


তবে ইয়েমেনের সাবা ও মারিব-এর আশ্চর্যজনক সভ্যতাকে অস্বীকার করা যায় না। কারণ তাওরাতে যে বিবরণ রয়েছে তা এবং হেরোডোট ও অন্যান্য ঐতিহাসিক যা বর্ণনা করেছেন সেগুলো ছাড়াও প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক মাসউদী মারিব সম্পর্কে লিখেছেন : “সব দিক থেকে মারাব সুরম্য অট্টালিকা, ছায়াদানকারী বৃক্ষ, প্রবাহমান ঝরনা ও নদী দিয়ে পরিবেষ্টিত ছিল। আর দেশটি এত বড় ছিল যা একজন সামর্থ্যবান অশ্বারোহী এক মাসেও তা পাড়ি দিতে পারত না।
আরোহী ও পায়ে হেঁটে ভ্রমণকারী সকল পরিব্রাজক ও মুসাফির যারা এ দেশটির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত গমন করত তাদের কেউই সূর্যালোক দেখতে পেত না। কারণ রাস্তার দু’পাশ জুড়ে থাকত ঘন ছায়াদানকারী বৃক্ষরাজি। দেশটির সবুজ-শ্যামল শস্যক্ষেত্রসমূহ এবং স্থায়ী রাজকীয় সরকার ও প্রশাসন সমগ্র বিশ্বে তখন খুবই প্রসিদ্ধ ছিল।


সংক্ষেপে এ সব দলিল-প্রমাণের অস্তিত্ব সমগ্র আরব ভূখণ্ড জুড়ে বিরাজমান সভ্যতার অস্তিত্ব প্রমাণ করে না; বিশেষ করে হিজায অঞ্চলে এ ধরনের সভ্যতার কোন অস্তিত্বই বিদ্যমান ছিল না, এমনকি গোস্তাব লোবোঁ এ প্রসঙ্গে লিখেছেন : “আরব উপদ্বীপ কেবল উত্তরের সীমান্ত এলাকাসমূহ ব্যতীত সকল বৈদেশিক আক্রমণ ও জবরদখল থেকে মুক্ত থেকেছে এবং কোন ব্যক্তি সমগ্র আরব ভূখণ্ড নিজের করায়ত্তে আনতে পারেনি। পারস্য, রোম ও গ্রীসের বড় বড় দিগ্বিজয়ী যাঁরা সে যুগের সমগ্র বিশ্ব তছনছ করেছেন তাঁরা আরব উপদ্বীপের প্রতি খুব কমই দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন।”
যদি এ কথা স্বীকার করে নেয়া হয় যে, সমগ্র আরব উপদ্বীপব্যাপী ঐ সকল পৌরাণিক সভ্যতা বাস্তবতার নিকটবর্তী; তারপরেও অবশ্যই বলতে হয় যে, ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের সময় হিজায অঞ্চলে আসলে সভ্যতার কোন নিদর্শনই বিদ্যমান ছিল না। পবিত্র কোরআন এ বিষয়টি উল্লেখ করেছে :
আর তোমরা আগুনের গর্তের ধারে ছিলে, আর তাদের থেকে তোমাদের উদ্ধার করলাম
“হে আরব জাতি! (ইসলাম ধর্মে তোমাদের দীক্ষিত ও বিশ্বাস স্থাপনের পূর্বে) তোমরা জাহান্নামের আগুনের নিকটে ছিলে। অতঃপর মহান আল্লাহ্ তোমাদেরকে (ইসলামের মাধ্যমে) মুক্তি দিয়েছেন।” (সূরা আলে ইমরান : ১০৩


ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের পূর্বে আরব জাতির অবস্থা বর্ণনা করে হযরত আলী (আ.)-এর যে সব বক্তব্য আছে সেগুলো হচ্ছে এতৎসংক্রান্ত জীবন্ত দলিল। এ সব বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, জীবনযাপন পদ্ধতি, চিন্তামূলক বিচ্যুতি ও নৈতিক অধঃপতনের দিক থেকে আরব জাতি অত্যন্ত দুঃখজনক অবস্থার মধ্যে ছিল। হযরত আলী তাঁর একটি ভাষণে ইসলামপূর্ব আরব জাতির অবস্থা ঠিক এভাবে বর্ণনা করেছেন :
“মহান আল্লাহ্ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে বিশ্বাসীদের ভয় প্রদর্শনকারী ঐশী প্রত্যাদেশ ও গ্রন্থের (আল কোরআন) বিশ্বস্ত আমানতদার হিসাবে প্রেরণ করেছেন। হে আরবগণ! তখন তোমরা নিকৃষ্ট ধর্ম পালন ও নিকৃষ্টতম স্থানসমূহে বসবাস করতে। তোমরা প্রস্তরময় স্থান এবং বধির (মারাত্মক বিষধর) সর্পকুলের মাঝে জীবনযাপন করতে (সেগুলো এমন বিষধর সাপ ছিল যা যে কোন প্রকার শব্দে পলায়ন করত না), তোমরা নোংরা লবণাক্ত-কর্দমাক্ত পানি পান করতে, কঠিন খাদ্য (খেজুর বীজের আটা এবং গুঁইসাপ) খেতে, একে অপরের রক্ত ঝরাতে এবং নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের থেকে দূরে থাকতে। তোমাদের মধ্যে মূর্তি ও প্রতিমাপূজার ব্যাপক প্রচলন ছিল। তোমরা কুকর্ম ও পাপ থেকে বিরত থাকতে না।”


আমরা এখানে আসআদ বিন যুরারার কাহিনী উল্লেখ করব যা হিজাযের অধিবাসীদের জীবনের অনেক দিক উন্মোচন করতে সক্ষম।
মদীনায় বসবাসকারী আওস ও খাযরাজ গোত্রের মধ্যে বহু বছর ধরে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের লেলিহান শিখা প্রজ্বলিত ছিল। একদিন আসআদ বিন যুরারাহ্ নামক খাযরাজ গোত্রের একজন নেতা মক্কা গমন করল যাতে করে কুরাইশদের আর্থিক ও সামরিক সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে ১০০ বছরের পুরানো শত্রু আওস গোত্রকে পদানত করতে সক্ষম হয়। উতবাহ্ বিন রাবীয়ার সাথে তার পুরানো বন্ধুত্ব থাকার সুবাদে সে উতবার গৃহে গমন করল এবং তার কাছে নিজের মক্কা আগমনের কারণও উল্লেখ করল। সে উতবার কাছে সাহায্য চাইলে তার পুরানো বন্ধু উতবাহ্ তাকে বলল, “আমরা তোমার অনুরোধ ও আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া দিতে পারব না। কারণ বর্তমানে আমরা এক অদ্ভুত অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছি। আমাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি আবির্ভূত হয়ে আমাদের উপাস্যদের সম্পর্কে কটুক্তি করছে। সে আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে নির্বোধ ও স্বল্প বুদ্ধির অধিকারী বলে মনে করে এবং মিষ্টি-মধুর ভাষা ব্যবহার করে আমাদের একদল যুবককে তার নিজের দিকে টেনে নিয়েছে। আর এভাবে আমাদের নিজেদের মাঝে এক গভীর ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। হজ্বের মৌসুম ব্যতীত অন্য সময় এ লোকটি শেবে আবু তালিবে (আবু তালিবের গিরিদেশে) বসবাস করে এবং হজ্বের মৌসুমে গিরিদেশ থেকে বের হয়ে হিজরে ইসমাঈলে (কাবা শরীফের কাছে) এসে বসে এবং জনগণকে (হজ্ব উপলক্ষে আগত ব্যক্তিদেরকে) তার ধর্মের প্রতি আহবান জানায়।”

আসআদ অন্যান্য কুরাইশ গোত্রপতির সাথে যোগাযোগ করার আগেই মদীনা প্রত্যাবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সে আরবদের সনাতন প্রথা অনুযায়ী কাবাঘর যিয়ারত করতে আগ্রহী হয়। তবে উতবাহ্ তাকে এ ব্যাপারে ভয় দেখিয়েছিল যে, সে তাওয়াফ করার সময় ঐ লোকটির (রাসূলের) কথা শুনবে এবং তার মধ্যে তার প্রভাব বিস্তার করবে। অন্যদিকে কাবাঘর তাওয়াফ ও যিয়ারত না করে পবিত্র মক্কা নগরী ত্যাগ করাও খুবই অশোভন ও মর্যাদাহানিকর বলে এ সমস্যা সমাধান করার উদ্দেশ্যে উতবাহ্ আসআদকে প্রস্তাব করল সে যেন তাওয়াফ করার সময় কানের ভিতর তুলা দিয়ে রাখে, তাহলে সে ঐ লোকটির কথা শুনতে পাবে না।
আসআদ ধীরে ধীরে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করে তাওয়াফ করায় মশগুল হলো। প্রথম তাওয়াফেই তার দৃষ্টি মহানবী (সা.)-এর ওপর নিবদ্ধ হলো। সে দেখতে পেল এক ব্যক্তি হিজরে ইসমাঈলে বসে আছে। কিন্তু মহানবীর কথায় প্রভাবিত হওয়ার ভয়ে সে তাঁর সামনে আসল না। অবশেষে সে তাওয়াফ করার সময় ভাবল, এ কেমন বোকামিপূর্ণ কাজ করছি! আগামীকাল যখন মদীনায় এ ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাসা করা হবে তখন আমি কি জবাব দেব। তাই আসআদ বুঝতে পারল যে, এ বিষয়ে তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন।
আসআদ একটু সামনে এগিয়ে এসে জাহেলী আরবদের চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী সালাম দিয়ে বলল, أ“আপনার প্রাতঃকাল মঙ্গলময় হোক।” মহানবী (সা.) এর জবাবে বললেন, “আমার প্রভু মহান আল্লাহ্ এর চেয়ে উত্তম সম্ভাষণ ও সালাম অবতীর্ণ করেছেন। আর তা হচ্ছে : (আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক)।” তখন আসআদ মহানবীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। মহানবী আসআদের এ প্রশ্নের জবাবে সূরা আনআমের ১৫১ ও ১৫২ নং আয়াত-যা আসলেই জাহেলী আরবদের মন মানসিকতা, আচার-আচরণ ও রীতিসমূহ চিত্রিত করেছে তা পাঠ করলেন। এ দু’আয়াত-যা ১২০ বছর ধরে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত একটি জাতির সকল ব্যথা-বেদনা ও দুঃখ-দুর্দশা এবং এর উপশম ও সমাধান সম্বলিত ছিল তা আসআদের হৃদয়ে গভীর প্রভাব বিস্তার করল। এ কারণে সে তৎক্ষণাৎ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল এবং মহানবীর কাছে আবেদন জানাল-যেন তিনি এক ব্যক্তিকে মুবাল্লিগ হিসাবে মদীনায় প্রেরণ করেন। মহানবী আসআদের অনুরোধে মুসআব ইবনে উমাইরকে পবিত্র কোরআন এবং ইসলামের শিক্ষক হিসাবে মদীনায় প্রেরণ করলেন।

আইয়ামে জাহেলিয়াত এর মধে দুইটি শব্দ রয়েছে। প্রথমটি আইয়াম। যার অর্থ – দিন, দিবস, রাতের বিপরীত ইত্যাদি। তবে এখানে আইয়াম দ্বারা যুগ বোঝানো হয়েছে। আর জাহেলিয়াত অর্থ – অজ্ঞতা, বর্বরতা, কুসংস্কার, তমসা বা অন্ধকার ইত্যাদি। তাই আইয়ামে জাহেলিয়াতের অর্থ হবে অন্ধকার যুগ বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন যুগ। ইসলামের ইতিহাসের পরিভাষায় এ শব্দটি রাসূল (স) এর আবির্ভাবের পূর্বেকার আরবদের অবস্থার উপর ব্যবহার হত। কেননা এ যুগে সাধারণত আরবগণ স্বভাব ও চরিত্রের দিক থেকে অজ্ঞতা ও মুর্খতার চরম অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। যদিও কোন কোন ইতিহাসবিদ আইয়ামে জাহেলিয়াত বলতে হযরত ঈসা (আ) ও রাসূল (স) এর মধ্যকার ফাতরাতে ওহী তথা ওহী মুলতবি সময় উদ্দ্যেশ্য করেছেন। ঐতিহাসিকদের বিবেচনায় ইসলাম আবির্ভাবের ঠিক পূর্ববর্তী যুগকে আইয়ামে জাহেলিয়াত বলা হয়। ড. নিকলসন ইসলাম আবির্ভাবের পূর্ববর্তী এক শতাব্দি কালকে আইয়ামে জাহেলিয়া যুগ বলে গণ করেছেন। অধ্যাপক পি.কে হিট্টি বলেন, সাধারণভাবে আইয়ামে জাহেলিয়া বলতে অজ্ঞতার যুগ বা বর্বরতার যুগ বুঝায়। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এ পদবাচ্য দ্বারা সে যুগকেই বুজায় যে যুগে আরবে কোন নিয়ম কানুন ছিল না, কোন নবীর আবির্ভাব ঘটে নি এবং কোন আসমানী কিতাব অবতীর্ণ হয় নি।

আইয়ামে জাহেলিয়ার সময়কাল

আইয়ামে জাহেলিয়ার সময়কাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। যেমন –
১. কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ (স) এর নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্ব যুগকে আইয়ামে জাহেলিয়াত বলা হয়। কিন্তু এই মতামত গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা তাদের মাঝখানে বহু নবী – রাসূলের আগমন ঘটেছে।
২. কারো কারো মতে, হযরত ঈসা (আ) এর উর্ধ্ব গমনের পর থেকে ইসলামের আবির্ভাবের পুর্ব পর্যন্ত সময়কে আইয়ামে জাহেলিয়া বলা হয়। তবে এ মতও গ্রহণযোগ্য নয়।
৩. ঐতিহাসিক মুইর বলেন, হযরত ঈসা (আ) হযরত মুহাম্মদ (স) এর মধ্যকার সময়কেই আইয়ামে জাহেলিয়া বলা হয়।
৪. ড. এস এম ইমামউদ্দীনের মতে, হযরত মুহাম্মদ (স) এর জন্মের পুর্বে ৬১০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এক শতাব্দিকাল সময়কে আইয়ামে জাহেলিয়া বলে।

উক্ত আয়াতদ্বয়ের অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু নিয়ে একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই জাহেলী আরবদের অবস্থা সম্পর্কে গবেষণা ও অধ্যয়ন করার আর কোন প্রয়োজন থাকবে না। কারণ এ দু’আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দীর্ঘদিনের চারিত্রিক ব্যাধিসমূহ জাহেলী আরবদের জীবনকে হুমকির সম্মুখীন করেছিল। এ কারণে এখানে আয়াতদ্বয়ের আরবী ভাষ্য ও এর অনুবাদ সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ শ্রদ্ধেয় পাঠকবর্গের সামনে তুলে ধরা হলো :
“(হে মুহাম্মদ!) বলে দিন : আমার রিসালাতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ ব্যাখ্যা করব। আমার রিসালাতের লক্ষ্যসমূহ নিম্নরূপ :
১. আমি শিরক ও মূর্তিপূজার মূলোৎপাটন করার জন্য প্রেরিত হয়েছি।
২. আমার কর্মসূচীর শীর্ষে আছে পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করা।
৩. আমার ধর্মে দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তান হত্যা সবচেয়ে মন্দ কাজ বলে বিবেচিত।
৪. মানব জাতিকে মন্দ কাজসমূহ থেকে দূরে রাখা এবং সকল প্রকার গুপ্ত ও প্রকাশ্য পাপ ও অন্যায় থেকে বিরত রাখার জন্য প্রেরিত হয়েছি।
৫. আমার শরীয়তে অন্যায়ভাবে মানব হত্যা ও রক্তপাত ঘটানো সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে মহান আল্লাহর নির্দেশ যাতে করে তোমরা চিন্তা-ভাবনা কর।
৬. ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করা হারাম।
৭. আমার ধর্মের ভিত্তি ন্যায়বিচার, এবং ওজনে কম দেয়া হারাম।
৮. আমরা কোন ব্যক্তিকে তার সাধ্য ও সামর্থ্যরে ঊর্ধ্বে দায়িত্ব ও কর্তব্য চাপিয়ে দেই না।
৯. মানুষের কথাবার্তা ও বক্তব্য-যা হচ্ছে তার সমগ্র মন-মানসিকতার আয়নাস্বরূপ তা সত্যের সমর্থনে ব্যবহৃত হওয়া আবশ্যক; আর সত্য ব্যতীত অন্য কিছু যেন মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত না হয়, এমনকি সত্য যদি তার ক্ষতিরও কারণ হয়।
১০. মহান আল্লাহর সাথে যে সব প্রতিজ্ঞা করেছ তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে।
এগুলো হচ্ছে তোমার স্রষ্টার বিধি-নিষেধ ও নির্দেশাবলী যা তোমরা অবশ্যই মেনে চলবে।
এ আয়াতদ্বয়ের অন্তর্নিহিত অর্থ এবং আসআদের সাথে মহানবীর আলোচনাপদ্ধতি থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এ সব হীন চারিত্রিক ত্রুটি অন্ধকার যুগের আরবদের আপাদমস্তক জুড়ে ছিল। আর এ কারণেই মহানবী (সা.) আসআদের সাথে প্রথম সাক্ষাতেই এ দু’আয়াত তেলাওয়াত করে শুনিয়েছিলেন। আর এভাবে তিনি আসআদকে তাঁর রিসালাতের মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ সম্পর্কে অবগত করেছিলেন।
আরবের ধর্মীয় অবস্থা
যখন হযরত ইবরাহীম (আ.) তাওহীদের পতাকা হিজায অঞ্চলে উড্ডীন এবং পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর সহায়তায় পবিত্র কাবা পুনঃর্নিমাণ করলেন তখন একদল লোক তাঁর সাথে যোগ দিয়েছিল এবং তাঁর বরকতময় পবিত্র অস্তিত্বের আলোক প্রভায় অনেক মানুষের অন্তর আলোকিত হয়েছিল। তবে সঠিকভাবে জানা যায় নি যে, স্বর্গীয় ব্যক্তিত্ব হযরত ইবরাহীম (আ.) কতদূর ও কি পরিমাণ তাওহীদী ধর্ম ও মতাদর্শ প্রচার এবং সেখানে তাওহীদবাদী পূজারীদের দৃঢ় সমাজ গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হযরত আলী (আ.) আরব জাতি ও গোত্রসমূহের ধর্মীয় অবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন :
এবং পৃথিবীর মানুষের যে দিন একঘেয়েমি এবং বিক্ষিপ্ত বায়ু এবং বিক্ষিপ্ত সম্প্রদায়ের নরত্বারোপমূলক ঈশ্বর মধ্যে ছড়িয়ে তাঁর সৃষ্টি বা তার নামে একজন নাস্তিক বা অন্য পরামর্শদাতা তাকে পথভ্রষ্টতায় থেকে হিদায়াত এবং তাদের মূর্খতা থেকে রক্ষা করার জন্য
“তখন (অন্ধকার যুগে) আরব জাতি বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী ছিল। তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বিদআত (ধর্ম বহির্ভূত প্রথা) প্রচলিত ছিল এবং তারা বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। একদল লোক মহান আল্লাহ্কে তাঁর সৃষ্টির সাথে তুলনা করত (এবং মহান আল্লাহর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অস্তিত্বে বিশ্বাস করত)। কেউ কেউ মহান আল্লাহর নামের ক্ষেত্রেও হস্তক্ষেপ করত [যেমন মূর্তিপূজকরা লাত মূর্তির নাম ‘আল্লাহ্’ শব্দ থেকে এবং প্রতিমা উয্যার নাম নবী ‘উযাইর’ থেকে নিয়েছিল]। আবার কতিপয় ব্যক্তি আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য সত্তার দিকে ইশারা-ইঙ্গিত করত; অতঃপর এদের সবাইকে আল্লাহ্ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে সৎ পথের সন্ধান দিলেন-সৎ পথে পরিচালিত করলেন এবং তাদেরকে পথভ্রষ্টতা ও অজ্ঞতা থেকে মুক্তি দিলেন।”
আরবের চিন্তাশীল শ্রেণীও চাঁদের উপাসনা করত। আরবের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক কালবী (মৃত্যু ২০৬ হি.) লিখেছেন : বনি মালীহ্ গোত্র জ্বিনপূজারী ছিল। হিময়ার গোত্র সূর্য, কিনানাহ্ গোত্র চাঁদ, তামীম গোত্র আলদেবারান (Al-debaran), লাখম গোত্র বৃহস্পতি, তাই গোত্র শুকতারা, কাইস গোত্র শে’রা নক্ষত্র (Dog star) এবং আসাদ গোত্র বুধ গ্রহের পূজা করত।
কিন্তু নিম্নশ্রেণীর লোক যারা আরবের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল তারা তাদের গোত্রীয় ও পারিবারিক প্রতিমা ছাড়াও বছরের দিবসসমূহের সংখ্যা অনুসারে ৩৬০টি মূর্তির পূজা করত এবং প্রতিদিনের ঘটনাসমূহকে ঐ ৩৬০টি মূর্তির যে কোন একটির সাথে জড়িত বলে বিশ্বাস করত।



হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পরে আমর বিন কুসাই-এর দ্বারা মক্কায় মূর্তিপূজার প্রচলন হয়েছিল। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, শুরুতে তা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল না; বরং প্রথম দিকে আরবগণ মূর্তিগুলোকে সুপারিশকারী বলে বিশ্বাস করত। এরপর তারা আরো এক ধাপ এগিয়ে এ সব প্রতিমাকে খোদায়ী শক্তির অধিকারী বলে ভাবতে থাকে। যে সব মূর্তি পবিত্র কাবার চারপাশে স্থাপিত ছিল সেগুলো আরবের সকল গোত্রের শ্রদ্ধাভাজন ও আরাধ্য ছিল। তবে গোত্রীয় প্রতিমাসমূহ ছিল কেবল নির্দিষ্ট কোন গোত্র বা দলের কাছেই শ্রদ্ধাভাজন ও পূজনীয়। প্রতিটি গোত্রের প্রতিমা ও মূর্তি যাতে সংরক্ষিত থাকে সেজন্য তারা প্রতিমাসমূহের জন্য নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করত। মন্দিরসমূহের তদারকির দায়িত্ব উত্তরাধিকারসূত্রে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের হাতে স্থানান্তর হতো।
পারিবারিক প্রতিমা ও মূর্তিসমূহের পূজা প্রতি দিন-রাত একটি পরিবারের মধ্যে সম্পন্ন হতো। ভ্রমণে যাওয়ার সময় তারা নিজেদের দেহকে পারিবারিক প্রতিমাসমূহের সাথে রগড়াতো। ভ্রমণ অবস্থায় তারা মরুভূমির পাথরসমূহের পূজা করত। যে স্থানেই তারা অবতরণ করত সেখানে চারটি পাথর বাছাই করে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরটিকে নিজের উপাস্য এবং অবশিষ্ট পাথরগুলোকে বেদীর পদমূল হিসাবে গণ্য করত।



মক্কার অধিবাসীদের হারাম শরীফের প্রতি চরম আকর্ষণ ছিল। ভ্রমণের সময় তারা হারামের পাথর সাথে নিয়ে যেত এবং যে স্থানেই তারা যাত্রাবিরতি করত সেখানে তা স্থাপন করে পূজা করত। সম্ভবত এগুলোই ‘আনসাব’ হতে পারে যেগুলোকে মসৃণ ও অবয়বহীন পাথর হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর এগুলোর বরাবরে আছে ‘আওসান’যার অর্থ হচ্ছে আকার-আকৃতি ও নকশাবিশিষ্ট এবং চেঁচে ফেলা হয়েছে এমন পাথর। ‘আসনাম’ হচ্ছে ঐ সকল প্রতিমা যা স্বর্ণ ও রৌপ্যকে গলিয়ে অথবা কাঠ খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে।

মূর্তিসমূহের সামনে আরবদের বিনয়াবনত হওয়া আসলে মোটেও আশ্চর্যজনক বিষয় নয়। আরবগণ বিশ্বাস করত যে, কোরবানী করার মাধ্যমে এ সব মূর্তির সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব। কোরবানী করার পর তারা কোরবানীকৃত পশুর রক্ত প্রতিমার মাথা ও মুখমণ্ডলে মর্দন করত। গুরুত্বপূর্ণ কাজসমূহের ক্ষেত্রে তারা এ সব প্রতিমার সাথে পরামর্শ করত। তারা পরামর্শের জন্য কতগুলো কাঠ (লাঠি) ব্যবহার করত। এগুলোর একটিতে লেখা থাকত অর্থাৎ কর; অন্যটিতে লেখা থাকত (করো না)। এরপর তারা হাত বাড়িয়ে দিত, অতঃপর যে লাঠিটি বেরিয়ে আসত তাতে যা লেখা থাকত তদনুসারে তারা কাজ করত।
সংক্ষেপে : মূর্তিপূজা সমগ্র আরবে প্রচলিত হয়ে পড়েছিল। বিভিন্নরূপে তাদের মাঝে এ মূর্তিপূজা অনুপ্রবেশ করেছিল। পবিত্র কাবা জাহেলী আরবদের পূজ্য প্রতিমা ও বিগ্রহের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছিল। প্রতিটি গোত্রেরই সেখানে একটি করে মূর্তি ছিল। কা’বাঘরে বিভিন্ন আকার-আকৃতির ৩৬০টির বেশি মূর্তি ছিল, এমনকি খ্রিষ্টানরাও কাবার স্তম্ভ ও দেয়ালসমূহে হযরত মরিয়ম ও হযরত ঈসা (আ.)-এর চিত্র, ফেরেশতাদের ছবি এবং হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর কাহিনী চিত্রিত করে রেখেছিল।


লাত, মানাত ও উয্যা-এ তিন প্রতিমাকে কুরাইশরা আল্লাহর কন্যা বলে বিশ্বাস করত। কুরাইশরা বিশেষভাবে এ তিন প্রতিমার পূজা করত। লাত দেবতাদের মা হিসাবে গণ্য হতো। লাতের মন্দির তায়েফে অবস্থিত ছিল। এ লাত ছিল সাদা পাথরের মতো। মানাতকে ভাগ্যদেবী ও মৃত্যুর প্রভু বলে বিশ্বাস করা হতো। মানাতের মন্দির মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী একটি স্থানে অবস্থিত ছিল।
আবু সুফিয়ান উহুদের যুদ্ধের দিবসে লাত ও উয্যার মূর্তি সাথে নিয়ে এসেছিল এবং এগুলোর কাছে সাহায্য চেয়েছিল। কথিত আছে যে, আবু আহীহাহ্ সাঈদ বিন আস নামের এক উমাইয়্যা বংশীয় ব্যক্তি মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় কাঁদছিল। আবু জাহল তাকে দেখতে গেল। আবু জাহল তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “এ কান্না কিসের জন্য? মৃত্যুকে ভয় করছ, অথচ এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কি কোন উপায় নেই?” সে বলল, “মৃত্যুর ভয়ে কাঁদছি না; বরং আমি ভয় পাচ্ছি যে, আমার মৃত্যুর পর জনগণ উয্যার পূজা করবে না।” তখন আবু জাহল বলল, “তোমার কারণে জনগণ উয্যার পূজা করেনি যে, তোমার মৃত্যুতেও তারা উয্যার পূজা করা থেকে বিরত থাকবে।”


এ সব মূর্তি ছাড়াও অন্যান্য দেবতার পূজা আরবদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। যেমন কুরাইশরা পবিত্র কাবার ভিতরে হুবাল নামের একটি মূর্তি রেখেছিল। প্রতিটি গোত্রের নিজস্ব বিশেষ মূর্তিই ছিল না, বরং প্রতিটি পরিবারেরও গোত্রীয় প্রতিমার পূজা করা ছাড়াও নিজস্ব পারিবারিক প্রতিমা থাকত। নক্ষত্র, চন্দ্র, সূর্য, পাথর, কাঠ, মাটি, খেজুর এবং বিভিন্ন ধরনের মূর্তি প্রতিটি গোত্রের কাছে আরাধ্য ও পূজনীয় ছিল। পবিত্র কাবা ও অন্যান্য মন্দিরে রক্ষিত এ সব প্রতিমা বা মূর্তি কুরাইশ ও সকল আরব গোত্রের নিকট পরম শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত ছিল। এগুলোর চারদিকে তারা তাওয়াফ (প্রদক্ষিণ) করত এবং এগুলোর নামে পশু কোরবানী করত। প্রত্যেক গোত্র প্রতি বছর কোন না কোন ব্যক্তিকে আনুষ্ঠানিকতার দ্বারা নির্বাচিত করে তাদের দেবদেবী ও প্রতিমাসমূহের বেদীমূলে কোরবানী করত এবং তার রক্তাক্ত মৃতদেহ বলিদানের স্থানের নিকটেই দাফন করা হতো।
সংক্ষিপ্ত এ বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সমগ্র জাযিরাতুল আরবের (আরব উপদ্বীপের) প্রতিটি গৃহ ও প্রান্তর, এমনকি বাইতুল্লাহ্ অর্থাৎ পবিত্র কাবাও সে যুগে দেবদেবী দিয়ে পরিপূর্ণ ছিল।
কবির ভাষায় :

“উপাসনাস্থলসমূহ বিরান ধ্বংসপ্রাপ্ত, কাবার পবিত্র অঙ্গন হয়ে গিয়েছিল প্রতিমালয়
তখন জনগণ ছিল মহান স্রষ্টা থেকে বিমুখ-কি সুখে কি দুঃখে সর্বাবস্থায়।”


এ সব অর্থহীন প্রতিমা ও দেবদেবীর পূজা করার ফলে আরবে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মতভেদ, হানাহানি ও হত্যাকাণ্ড বিরাজ করত। আর এর ফলে অসভ্য-বর্বর মরুচারী আরবদের জীবনে নেমে এসেছিল ভয়ঙ্কর দুর্ভাগ্য ও দুর্দশা এবং চরম পার্থিব ও আত্মিক ক্ষতি।
হযরত আলী (আ.) তাঁর এক ভাষণে ইসলামপূর্ব আরব জাতির অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন : “মহান আল্লাহ্ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে রিসালাতের দায়িত্বসহকারে জগদ্বাসীকে ভয় প্রদর্শন করার জন্য প্রেরণ এবং তাঁকে তাঁর ঐশী বিধি-বিধান ও নির্দেশাবলীর বিশ্বস্ত সংরক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। হে আরব জাতি! তখন তোমরা নিকৃষ্টতম ধর্মের অনুসারী ছিলে; তোমরা সর্পকুলের মাঝে শয়ন করতে, ময়লা-আবর্জনাযুক্ত পানি পান করতে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ও বন্ধন ছিন্ন করতে, তখন তোমাদের মধ্যে প্রতিমা ও মূর্তিসমূহ প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তোমাদের আপদমস্তক জুড়ে ছিল পাপ, অন্যায় ও অপরাধ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

২০০০ সালে এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৫৯০ দুর্ঘটনার মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে কনকর্ড যুগের।

বাংলাদেশের সকল রাজবাড়ী ও জমিদার বাড়ীগুলির ইতিহাস ও বর্তমান অবস্হা কি (ভিডও সহ )