মাচু পিচু দক্ষিন আমেরিকায় অবস্থিত পেরুর একটি প্রধান নগরী – যেখানে কেউ বসবাস করে না।





মাচু পিচু দক্ষিন আমেরিকায় অবস্থিত পেরুর একটি প্রধান নগরী – যেখানে কেউ বসবাস করে না।
অনুমান করা হয় ১৪৫০ সালের দিকে ইনকা শাসন আমলে এই শহরের সৃস্টি। পরবর্তীতে স্পেনিশদের কাছে এই শাসকগোষ্ঠী পরাজিত হয়। স্পেনিশরা পুরো পেরু দখল ও শাসন করলেও কোনো এক অজানা কারণে এই শহরের সন্ধান তারা কোনভাবেই পায়নি।
মাচু পিচু দক্ষিন আমেরিকায় অবস্থিত পেরুর একটি প্রধান নগরী – যেখানে কেউ বসবাস করে না। কেউ মনে করেন এটা তীর্থস্থান হিসেবে বানানো হয়েছিল, কেউ বলেন অবকাশযাপন কেন্দ্র, আবার কারো মতে এটা ভয়ঙ্কর অপরাধীদের আটক রাখার কয়েদখানা! অনুমান করা হয় ১৪৫০ সালের দিকে ইনকা শাসন আমলে এই শহরের সৃস্টি। পরবর্তীতে স্পেনিশদের কাছে এই শাসকগোষ্ঠী পরাজিত হয়। স্পেনিশরা পুরো পেরু দখল ও শাসন করলেও কোনো এক অজানা কারণে এই শহরের সন্ধান তারা কোনভাবেই পায়নি।
মাচু পিকচু -মাচু পিক্‌চু অর্থাৎ “পুরানো চূড়া”) বা মাচু পিচু) কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের আগের সময়কার একটি ইনকা শহর, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা ২৪০০ মিটার (৭,৮৭৫ ফিট। এটি পেরুর উরুবাম্বা উপত্যকার (Valle de Urubamba) ওপরে একটি পর্বতচূড়ায় অবস্থিত। মাচু পিচুই সম্ভবতঃ ইনকা সভ্যতার সবচেয়ে পরিচিত নিদর্শণ, যাকে প্রায়শঃ ইনকাদের হারানো শহর বলা হয়। এটি ১৪৫০ সালের দিকে নির্মিত হয়, কিন্তু এর এক শ বছর পর ইনকা সভ্যতা যখন স্পেন দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন এটি পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে। কয়েক শ বছর অজ্ঞাত থাকার পর ১৯১১ সালে হাইরাম বিঙাম (ইংরেজি: Hiram Bingham) নামে এক মার্কিন ঐতিহাসিক এটিকে আবার সমগ্র বিশ্বের নজরে নিয়ে আসেন। তারপর থেকে মাচু পিচু পর্যটকদের কাছে একটি আকর্ষণী দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। এটিকে ১৯৮১ সালে পেরুর সংরক্ষিত ঐতিহাসিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ইউনেস্কো ১৯৮৩ সালে এটিকে তাদের বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এটি বর্তমান বিশ্বের সাতটি নতুন বিস্ময়েরও একটি।
চিত্র: Intihuatana সৌর Clock.jpg
মাচু পিচু ঐতিহ্যবাহী ইনকা বাস্তুকলার এক অনুপম নিদর্শণ। পালিশ করা পাথর নির্মিত এই শহরের প্রধান স্থাপনাগুলো হচ্ছে ইন্তিউয়াতানা  সূর্য স্তুপ), সূর্য মন্দির ও তিন জানালা ঘর ইত্যাদি। পুরাকীর্তিবিদদের কাছে মাচু পিচুর পবিত্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত অংশে এ স্থাপনাগুলো অবস্থিত। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে হাইরাম বিঙাম মাচু পিচু থেকে যে সব পুরাকীর্তি নিয়ে গিয়েছিলেন সেসব ফেরত দেবার জন্য ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পেরু সরকার ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বর্তমানে অতিরিক্ত পর্যটক সমাগমের ফলে এই প্রাচীন শহরের অস্তিত্ব নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন; উল্লেখ্য, ২০০৩ সালে এখানে আগত পর্যটকের সংখ্যা ৪০০,০০০ ছাড়িয়ে যায়।
Machu Picchu
ধারণা করা হয় ইন্তিউয়াতানা ইনকাদের নির্মিত একটি মহাকাশ ঘড়ি
ইনকা সভ্যতার স্বর্ণযুগে ১৪৫০ সালের দিকে মাচু পিচু নির্মিত হয়। কিন্তু তার ১০০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এটি পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে। সম্ভবতঃ স্পেনীয় অভিযাত্রীদের আগমনের আগেই এই শহরের অধিকাংশ অধিবাসী গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। মাচু পিচুর সন্ধানকারী হাইরাম বিঙাম এবং আরও অনেকেরই মতে এই সুরক্ষিত শহরটি ইনকাদের ঐতিহ্যগত জন্মস্থান অথবা সূর্য কুমারীদের পবিত্র কেন্দ্র ছিল।
অন্য একটি মতবাদ অনুসারে মাচু পিচু একটি ইনকা লিয়াক্তা বা এমন একটি উপনিবেশ যা বিজিত অঞ্চল সমূহের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রনে ব্যবহৃত হত। আবার কেউ কেউ মনে করেন এটি একটি জেলখানা হিসাবে ভয়ংকর অপরাধীদের রাখার জন্য নির্মিত হয়েছিল। অন্যদিকে জন রো (ইংরেজি: John Rowe) ও রিচার্ড বার্গার (ইংরেজি: Richard Burger) সহ আরও অনেকের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মাচু পিচু কোনও প্রতিরক্ষামূলক আশ্রয়স্থল নয়, বরং এটি ইনকা সম্রাট পাচাকুতিকের  একটি অবকাশযাপন কেন্দ্র। বেশির ভাগ পুরাতত্ত্ববিদই এই মতবাদকে সমর্থন করেছে। এছাড়াও ইয়োহান রাইনহার্ড (জার্মান: Johan Reinhard য়োহান্‌ রায়্‌ন্‌হার্ট্‌) এর উপস্থাপিত তথ্য এটা প্রমান করেন যে, এই স্থানটিকে শহর নির্মানের জন্য বেছে নেয়া হয়েছিল এর পবিত্র ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের জন্য। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, অনেকেই ধারণা করেন এর পাহাড় চূড়াগুলোর অবস্থান প্রধান প্রধান জ্যোতির্মণ্ডলীয় ঘটনাবলীর সাথে সামঞ্জস্যতাপূর্ণ।
এই দুর্গনগরীটি ইনকাদের রাজধানী কোস্কো থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার (৫০ মাইল) দূরে অবস্থিত। কিন্তু এর অবস্থান অজ্ঞাত থাকার কারণে অন্যান্য ইনকা নগরীর মত এই শহরটি কখনও স্পেনীয়দের দ্বারা আক্রান্ত এবং লুট হয় নি। কয়েক শ বছর জনমানবহীন থাকার ফলে শহরটি এক সময় ঘন জঙ্গলে ঢেকে যায় এবং তখন খুব কম লোকই এর অস্তিত্ব সম্বেন্ধে জানত। পরবর্তীকালে ১৯১১ সালের ২৪শে জুলাই মার্কিন ঐতিহাসিক ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রভাষক হাইরাম বিঙাম শহরটিকে বিশ্বের নজরে নিয়ে আসেন। আগেই মাচু পিচুতে গিয়েছিলেন এমন কিছু স্থানীয় মানুষ তাঁকে সেখানে নিয়ে যান। সেখানে বিঙাম শহরটির পুরাতাত্ত্বিক নিরীক্ষা ও জরিপ করেন। তিনিই মাচু পিচুর নাম দেন ইনকাদের হারানো শহর এবং তাঁর প্রথম বইটিও এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়। তিনি কখনওই স্থানীয় সেসব লোকদের কোনও উল্লেখ করেন নি যারা তাঁকে মাচু পিচুতে নিয়ে গিয়েছিলেন; এমনকি মাচু পিচুর উদ্ঘাটনে তাঁদের কোনও কৃতিত্বও স্বীকার করেন নি। তিনি তাঁর গাইড হিসাবে শুধু স্থানীয় উপকথার উল্লেখ করেছেন।
চিত্র:Machupicchu hb10.jpg
১৯১২ সালে তোলা মাচু পিচু শহরের ছবি।
বিঙাম অনেকটা ঘটনা চক্রেই মাচু পিচুর উদ্ঘাটন করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি ইনকা শহর বিতকোসের (Vitcos) সন্ধান করছিলেন, এটি পেরুতে স্পেনীয়দের আক্রমণের বিরুদ্ধে সর্বশেষ ইনকা প্রতিরোধের স্থান এবং ইনকাদের শেষ আশ্রয়স্থল ছিল। বেশ কয়েক বছরের ভ্রমণ ও অনুসন্ধানের পর ১৯১১ সালে কেচুয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা বিঙামকে মাচু পিচু শহরে নিয়ে যায়। এই সম্প্রদায় মাচু পিচুতে ইনকাদের নির্মিত স্থাপনাগুলোয় থাকত। কিছু পরিবার ১৯১১ সালে শহরটি আবিষ্কারের সময় পর্যন্ত সেখানে বসবাস করত, যদিও নগরীর আদি বাসিন্দাদের অধিকাংশই শহর তৈরির এক শ বছরের ভেতর মারা যায়। সে সময় মাচু পিচুতে কিছু মমি (বিশেষতঃ মহিলাদের) পাওয়া যায়। বিঙাম সেখানে বেশ কয়েকবার ভ্রমণ করেন এবং ১৯১৫ সাল পর্যন্ত সেখানে খনন কাজ পরিচালনা করেন। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় মাচু পিচুর আবিষ্কার নিয়ে বেশ কিছু বই লিখেছেন।
হুয়ায়না পিচু এর চূড়া থেকে মাচু পিচু এবং আগুয়াস কালিয়েন্তেস থেকে এখানে যাতায়াতের রাস্তা হাইরাম বিঙাম মহাসড়ক দেখা যাচ্ছে
সিমোন ওয়েসবার (ফরাসি: Simone Waisbard) নামের একজন কোস্কো শহর গবেষিকা দাবী করেছেন যে এনরিকে পালমা (Enrique Palma), গাবিনো সাঞ্চেস (Gabino Sánchez), এবং আগুস্তিন লিসারাগা (Agustín Lizárraga) – এই ব্যক্তিত্রয় ১৯০১ সালে ১৪ই জুলাই মাচু পিচুর একটি পাথরে তাঁদের নাম খোদাই করেন। এর অর্থ এই তিন ব্যক্তি হাইরাম বিঙামের অনেক আগেই শহরটির খুঁজে পান। একই ভাবে কেউ কেউ দাবী করেন যে ফ্র্যাংকলিন নামের একজন প্রকৌশলী দূরবর্তী এক পাহাড় থেকে মাচু পিচুর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। তিনি ওই এলাকায় বসবাসরত টমাস পেন একজন ইংরেজ প্লিমথ ব্রেদ্রেন খ্রিস্টান মিশনারিকে এই শহরটির কথা বলেন। পেন পরিবারের দাবী, তিনি ও স্টুয়ার্ট ই ম্যাকনের্ন (আইরিশ ইংরেজি: Stuart E McNairn, ১৮৬৭-১৯৫৬) নামক তাঁর একজন সঙ্গী মিশনারি ১৯০৬ সালেই মাচু পিচুতে যান।
মাচু পিচুর ইনকা দেয়াল
১৯১৩ সালে জাতীয় ভৌগোলিক সংস্থা তথা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি (ইংরেজি: National Geographic Society) তাদের এপ্রিল মাসের পুরো সংখ্যাটি মাচু পিচুর ওপর প্রকাশ করলে শহরটি ব্যাপক প্রচারণা পায়। মাচু পিচুর আশপাশের ৩২৫.৯২ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ১৯৮১ সালে পেরুর “সংরক্ষিত ঐতিহাসিক এলাকা” হিসেবে ঘোষণা করা হয়। শহরের ধ্বংসাবশেষ ছাড়াও এই এলাকায় অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল উদ্ভিদ ও জীব বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ।
মাচু পিচুকে ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণায় মাচু পিচুকে বর্ণনা করা হয়েছে ধ্রুপদী বাস্তুকলার নিদর্শন ও ইনকা সভ্যতার অনন্য স্বাক্ষর হিসেবে। ২০০৭ সালের ৭ই জুলাই New Open World Corporation কর্তৃক আয়োজিত প্রতিযোগিতায় মাচু পিচু বিশ্বের সাতটি নতুন বিস্ময়ের একটি নির্বাচিত হয়। অতিরিক্ত পর্যটক সমাগম, নিকটবর্তী আগুয়াস কালিয়েন্তেস শহরের অপরিকল্পীত নগরায়ন, এবং আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে বিলকানোতা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের ফলে (যা পক্ষান্তরে পর্যটক সমাগম আরও বৃদ্ধি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে) সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে World Monuments Fund মাচু পিচুকে তাদের “বিশ্বের সবচাইতে বিপন্ন ১০০টি স্থানের” ২০০৮ সালের তালিকায় নিয়ে এসেছে।
সূর্য মন্দির
১৯১১ সালের প্রথম এক্সপিডিশনঃ
বিঙাম কোন প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত প্রত্নতত্তবিদ ছিলেন না। ১৯০৬ সালে পেরুতে তিনি চারটি অভিযান পরিচালনা করেন। এই সময়ে তিনি সিমন বলিভারের পথ অনুসরন করে ভেনেজুয়েলা এবং কলম্বিয়াতে ভ্রমন করেন। এই অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন, যা পরবর্তীতে তাঁর পুরো জীবন বদলে দিয়েছিল। ১৯০৮ সালে চিলির সান্তিয়াগোতে অনুষ্ঠিত প্রথম প্যান আমেরিকান সাইন্টিফিক কংগ্রেসে একজন ডেলিগেট হিসেবে যোগদানের জন্য তাঁকে নির্বাচিত করা হয়। কনফারেন্স সমাপ্ত করে তিনি পেরু হয়ে ফেরার পথ ধরেন। পেরুতে অবস্থানকালীন একজন স্থানীয় চিফ অফিসিয়াল, মিঃ নুনেজের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। নুনেজের অনুরোধে তিনি প্রি-কলাম্বিয়ান শহর, চক্কোকুইরাও (অনুসন্ধানের পরিকল্পনা করেন। সময়টা তখন ছিল ফেব্রুয়ারি, বর্ষাকাল। শেষপর্যন্ত তিনি চক্কোকুইরাও খুঁজে পান, কিন্তু সেটা ছিল অভিযানের মাত্র শুরু। ১৯১১ সালে তাঁর এই ভ্রমনের উপর তিনি একটি বই প্রকাশ করেন।
চূড়ার ওপরে টেরেস করা চাষের জমি
“দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, চিলি এবং পেরুতে নোট নিয়ে পোতসির পথে বুয়েনোস আইরেস থেকে লিমা পর্যন্ত একটি যাত্রা।”পেরুতে অনাবিষ্কৃত ইনকা শহরগুলোর আবিস্কারের প্রত্যাশায় বিঙাম শিহরিত ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১১ সালে তিনি “ইয়েল পেরুভিয়ান এক্সপিডিশান” এর আয়োজন করেন। ইনকাদের শেষ হারানো শহর “ভিটকস” এর অনুসন্ধান এবং মাউন্ট করপুনার শীর্ষে পৌছানোই ছিল এই অভিযানের অন্যতম উদ্দেশ্য।

“মাচুপিচু” অনুসন্ধানঃমাচু পিচুর মানচিত্র


বিঙাম তাঁর প্রথম অভিযানে ইনকাদের হারানো শহরগুলো খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থান পরিবর্তনের সময় তিনি স্থানীয়দের কাছে ওইসব শহরগুলোর খোঁজ নিতে থাকেন। একদিন তিনি কিছু গুরুত্তপূর্ণ তথ্য পেয়ে যান। সেই তথ্য অনুযায়ী মাচুপিচু এবং হুয়ানা পিচুর আশপাশে প্রচুর ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। মাত্রই তখন হুয়ানা পিচুর কাছাকাছি একটি নতুন রাস্তা করা হয়েছিল, তাই তারা সেই রাস্তা অনুসরন করা শুরু করলো। “মান্দর পাম্পা” নামক এক জায়গায় পৌছে তাঁরা এক রাত ক্যাম্প করলো। সেই রাতে তাঁদের সাথে পরিচয় হল মেলচর আরটেগার সাথে, যিনি ছিলেন ওই এলাকার স্থানীয় মালিক। তাঁর তথ্য অনুযায়ী হুয়ানা পিচু পর্বতের উপরে নদীর কাছাকাছি এক জায়গায় প্রচুর ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। বিঙামের অনুরোধে দৈনিক ৫০ সেন্ট পারিশ্রমিকে আরটেগা তাঁদেরকে সেই জায়গায় নিয়ে যেতে রাজি হলো। পরদিন সকালে, ২৪ জুলাই-১৯১১ সাল, তাঁরা যাত্রা শুরু করলো। আরটেগার দেখানো পথে অবশেষে তাঁরা মাচুপিচু পর্বতের উপরের বিশাল ধ্বংসাবশেষের কাছে পৌছাল, যা পরবর্তীতে বিঙাম নামকরণ করেন “মাচুপিচু” ।
যখন তিনি এই ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন, তখন এই শহর সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না। আসলে বাহিরের পৃথিবীর কেউই কিছু জানত না, কারণ তখনকার স্প্যানিশ ইতিহাস এবং জার্নালে এই শহরের কোনও উল্লেখ নেই। তাই ঠিক কোন শহর এটা, সেটা নিয়ে বিঙাম কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলেন। তাঁর দলের অন্যান্যদের মতে, সম্ভবত এটা ছিল হারানো শহর “ভিটকস” অথবা “ভিকাবাম্বা দ্যা ওল্ড”। কিন্তু বিঙাম ততটা নিশ্চিত ছিলেন না। তাই তিনি ভিটকস এবং ভিকাবাম্বার অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে থাকেন।

“ভিটকস” অনুসন্ধানঃ

পরবর্তী মাসে, আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বিঙাম লোয়ার উরুবাম্বা এবং ভিকাবাম্বা নদীর দিকে যাত্রা শুরু করেন। একসময় তাঁরা একটি চাষাবাদের বাগানের কাছে পৌছল। স্থানীয় ইন্ডিয়ান শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে ইনকা ধ্বংসাবশেষের উপরে যেকোন তথ্যের জন্য বিঙাম আকর্ষণীয় পুরষ্কার ঘোষণা করলেন। অনেকে অনেক তথ্য দিল এবং বিঙাম সবগুলো তথ্য যাচাইয়ের জন্য স্থানগুলোতে ভ্রমন করলো, কিন্তু তেমন গুরুত্তপূর্ণ কোন কিছুর সন্ধান পাওয়া গেলনা। সবশেষে তাঁর সাথে পরিচয় হয় ইভারিস্তো মগ্রোভেজোর সাথে, যিনি ছিল স্থানীয় একজন গ্রামপ্রধান। সে বিঙামকে তাঁর গ্রামে আমন্ত্রন জানায়। সেখানে বিঙাম গ্রামের আদিবাসীদেরকে নদীর ধারে একটি বড় সাদা পাথরের কথা জিজ্ঞেস করেন, যেই পাথরের কথা বিঙাম পড়েছিলেন পুরনো পুঁথি এবং জার্নালে। হঠাৎ একজন আদিবাসী বলল, অনেক বছর আগে নদীর কাছাকাছি পর্বতে সে এরকম একটি পাথর দেখেছিল। বিঙাম তাঁর দল নিয়ে সেই পাথরের অনুসন্ধানে বেড়িয়ে পরলেন। একটি ছোট জলধারার স্রোত অনুসরণ করে বিঙাম পৌছে গেলেন সেই বড় সাদা পাথরের কাছে এবং খুঁজে পেলেন হারানো শহর ভিটকস

“ভিকাবাম্বা দ্যা ওল্ড” অনুসন্ধানঃ


মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যাবধানে বিঙাম মাচুপিচু এবং ভিটকস খুঁজে পেয়েছিলেন। তারপরও তিনি সন্তুষ্ট ছিলেননা। ভিকাবাম্বা খুঁজে পাওয়ার জন্য তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু এইবার, ব্যাপারটা ছিল অনেক কঠিন। ঘন জঙ্গল এবং কঠিন পার্বত্য উপত্যাকার মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর অভিযান চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু কিছুই পাওয়া গেলনা। একজন ইন্ডিয়ান তাঁকে জানায় যে একটি জায়গা আছে, যেখানে কিছু ধ্বংসাবশেষ পাওয়ার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে, কিন্তু সেই জায়গায় যাওয়াটা অনেক বেশি কঠিন। তাঁকে ভয়ংকর ইন্ডিয়ানদের এলাকা দিয়ে যেতে হবে, এবং এরা বাহিরের আগন্তুকদের একদমই পছন্দ করেনা। তারা সর্বদা বিষাক্ত তীর-ধনুক নিক্ষেপ করে। কিন্তু বিঙামের কাছে এই ঝুঁকিটা নেয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প রাস্তা ছিলনা। তাঁরা সেই ইন্ডিয়ানদের উপত্যাকার দিকে এগিয়ে গেল। অবিশ্বাস্যভাবে ইন্ডিয়ানরা তাঁদেরকে আক্রমণ তো করলোই না, বরং ইশারা ইঙ্গিত এবং ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভাষায় তাঁদেরকে তথ্য উপাত্ত দিয়ে সাহায্য করলো। সব বাধা অতিক্রম করে যখন তাঁরা পর্বতের দূর কোনায় পৌছায়, তখন “এস্পিরতো পাম্বা” নামক এক জায়গায় অল্প কিছু ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান বিঙাম। তিনি ধরে নেন ভিকাবাম্বা দ্যা ওল্ড খুঁজে পেতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। সেখানে আর বেশি সময় ব্যয় না করে তিনি ফিরে চলে আসেন। পরবর্তীতে তিনি সিদ্ধান্ত নেন মাচুপিচুই হচ্ছে ভিকাবাম্বা দ্যা ওল্ড। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বিঙামের মৃত্যুর পর এটা জানা যায় যে এস্পিরতো পাম্বাই হচ্ছে আসল ভিকাবাম্বা দ্যা ওল্ড, যা তিনি খুঁজে গিয়েছেন সারা জীবন। খুব বেশি ধ্বংসাবশেষ পরে আর সেখানে পাওয়া যায়নি, কারণ তাঁদের অভিযানের পরে স্প্যানিয়ার্ডরা বেশীরভাগ ভগ্নস্তূপই ধ্বংস করে দিয়েছে।

পরবর্তী এক্সপিডিশনঃ

প্রথম অভিযানের সার্থকতার পরে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ন্যাশনাল জিওগ্র্যাফির যৌথ অর্থায়নে ১৯১২ সালে বিঙাম পুনরায় পেরুতে অভিযান চালান। মূলত প্রথম অভিযানের ধ্বংসাবশেষ বিশ্লেষণ করাই ছিল এই অভিযানের উদ্দেশ্য। কিন্তু নতুন আর কোন ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন বিঙাম পরবর্তীকালে খুঁজে পাননি। ১৯৫৬ সালের ৬ জুন, ওয়াশিংটনে তাঁর নিজ বাড়িতে মৃত্যু হয় অসমসাহসী এই অভিযাত্রীর।

মাচু পিচুর অবস্থান।

মাচু পিচু ইনকাদের রাজধানী কোস্কো থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৩৫০ মিটার (৭৭১০ ফিট) উচ্চতায় মাচু পিচু পবর্তের চূড়ায় অবস্থিত। এটি দক্ষিণ আমেরিকার একটি অন্যতম প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্র এবং পেরুর সবচাইতে আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান।
মাচু পিচুর এক পাশ চূড়া থেকে একেবারে খাড়া ভাবে ৬০০ মিটার নিচে উরুবাম্বা নদীর (স্পেনীয়: Río Urubamba) পাদদেশে গিয়ে মিশেছে। গিরিখাত ও পাহাড়পর্বতের দ্বারা প্রাপ্ত চমৎকার প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কারণে এই শহরের অবস্থান সামরিক কৌশলগত দিক থেকে গোপনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। উরুবাম্বা নদীর ওপর দড়ির তৈরি সেতু ইনকা সৈন্যদের গোপন প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হত। মাচু পিচুর পশ্চিম দিকে গাছের গুড়ি নির্মিত আরেকটি সেতু ছিল। এই সেতুর মাঝে ৬ মিটার (২০ ফুট) জায়গা ফাঁকা ছিল, প্রয়োজনমত গাছের তক্তা দিয়ে সেতুর দুই অংশকে সংযুক্ত করা যেত। সেতুটির নিচে ৫৭০ মিটার (১৯০০ ফুট) গভীর গিরিখাত, তাই গাছের তক্তা সরিয়ে দিলে কোনও শত্রুর পক্ষে তা অতিক্রম করা দুঃসাধ্য ব্যাপার হত। এই সেতুটি নির্মিত হয়েছিল উরুবাম্বা উপত্যকার ওপর।
শহরটি দুই পাহাড়ের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এখান থেকে নিচের উপত্যকা পরিস্কারভাবে দৃশ্যমান, যা সামরিক দিক সুবিধাজনক অবস্থান। এছাড়া শহরের পেছনের খাড়া পর্বত প্রায় অনতিক্রম্য। মাচু পিচুর পানি সরবরাহ ব্যবস্থা পাহাড়ি ঝরনার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল, যা সহজে বন্ধ করা যেত না। এছাড়াও যে পরিমাণ চাষযোগ্য জমি ছিল তাতে উৎপন্ন ফসলে শহরের মোট জনসংখ্যার চারগুণ মানুষের খাদ্যের সংস্থান সম্ভব ছিল। পর্বতের পাশগুলো ধাপকেটে সমান করা হয়েছিল। এতে একদিকে যেমন চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল, অন্যদিকে খাড়া ঢাল বেয়ে শহরে আসার পথটি আক্রমণকারীদের জন্য দুর্গম করা হয়েছিল। মাচু পিচু থেকে পাহাড়ের ওপর দিয়ে কোস্কো যাবার দুটি পথ আছে, একটি “সূর্য দরজা” দিয়ে, এবং অন্যটি “ইনকা সেতু” দিয়ে। শত্রুর আক্রমণের মুখে দুটি পথই সহজে বন্ধ করে দেয়া যেত। এই শহরের মূল উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল খুবই মজবুত।


iStock
মাচু পিচুর বেশির ভাগ স্থাপনাই ইনকা বাস্তুকলার ঐতিহ্যবাহী নির্মাণ পদ্ধতিতে তৈরি। স্থাপনাগুলোর দেয়াল পাথর নির্মিত এবং জোড়া দেবার জন্য কোনওরকম সিমেন্ট জাতীয় পদার্থ বা চুন-সুরকির মিশ্রন এখানে ব্যবহার করা হয় নি। অ্যাশলার (ইংরেজি: ashlar অ্যাশ্‌লার্‌) নামক এই নিমার্ণ কৌশলে ইনকারা খুবই দক্ষ ছিল। এই পদ্ধতিতে পাথরের খণ্ড এমন নিখুঁত ভাবে কাটা হত যেন কোনওরকম সংযোগকারী মিশ্রণ ছাড়াই পাথরগুলো খাজে খাজে শক্তভাবে একটার ওপর আরেকটা বসে যায়। ইনকারা পাথরের এই নির্মাণ পদ্ধতিতে পৃথিবীর সেরাদের সেরা ছিল। তাদের নির্মিত পাথরের দেয়ালগুলোর জোড় এতই নিপুন যে একটা পাতলা ছুরির ফলাও সেগুলোর ভেতর দিয়ে প্রবেশ করানো যায় না।
মাচু পিচুর অন্যান্য স্থাপনাগুলো চুনসুরকির মিশ্রণ ব্যবহার করে তৈরি, তবে ইনকা নির্মাণশৈলীর মান বিচারে সেসব নিম্নমানসম্পন্ন এবং তড়িঘরি করে তৈরি করা। পেরু একটি অতি ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা এবং সিমেন্টজাতীয় মিশ্রণের গাথুনি দিয়ে তৈরি স্থাপনার চাইতে গাথুনি ছাড়া শুধুমাত্র খাজে খাজে পাথর বসিয়ে তৈরি স্থাপনা অনেক বেশি ভূমিকম্পপ্রতিরোধী। ইনকাদের তৈরি দেয়ালগুলোতে বিস্তারিত ভাবে প্রচুর সুক্ষ্ম নকশা দেখা যায় যেগুলো ভূমিকম্পের সময় দেয়াল ধ্বসেপড়া রোধ করে। দরজা এবং জানালাগুলো অসমচুতুর্ভুজ আকৃতির এবং নিচ থেকে ওপরে ক্রমে ভেতরের দিকে হেলানো। কোণাগুলো সাধারণতঃ গোলাকৃতির, ভেতরের দিকের কোণাগুলি মাঝে মাঝে কক্ষের ভেতরে অল্প হেলানো, এবং অনেক জায়গায় ইংরেজি “L” আকৃতির পাথর খণ্ড ব্যবহার করে বাইরের কোণাগুলিকে পরস্পর জোড়া দেয়া হয়েছে। মাচু পিচুর দেয়ালগুলো ওপর থেকে নিচে একদম সোজা নয়; বরং এক সারি থেকে অন্য সারি কিছুটা হেলানো এবং এভাবে দেয়ালগুলোর ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে। ফলে মাচু পিচু শহরটি অনেকগুলো ভূমিকম্প সহ্য করে এখনও ভালোভাবে টিকে আছে।
This is the great tourist influx
ইনকারা কখনওই ব্যবহারিক কাজে চাকার ব্যবহার করে নি। তাই তারা কীভাবে এত সংখ্যক বিশাল আকৃতির পাথর খণ্ড এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে গেছে সেটা এক রহস্য; যদিও সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, এই বিশার আকৃতির পাথর খণ্ডগুলো পাহাড়ের সমতল ঢাল দিয়ে ঠেলে ওপরে তুলতে তারা শত শত শ্রমিক ব্যবহার করেছিল। এখনও কিছু কিছু পাথরের গায়ে হাতলের মতো গাঁট রয়েছে যা পাথরগুলোকে নির্দিষ্ট স্থানে বসানোর জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। পাথর খণ্ডগুলো জায়গামতো স্থাপনের পর ইনকারা হয়ত হাতলগুলোকে গুড়িয়ে সমান করে দিয়েছে।
শহরটিতে ১৪০ টি স্থাপনার মধ্যে রয়েছে কিছু মন্দির, পবিত্র স্থান, উদ্যান এবং আবাসিক ভবনসমূহ (আবাসিক ভবনগুলো খড়ের ছাউনি দেয়া ছিল)। মাচু পিচুতে রয়েছে ১০০টিরও বেশি সিড়ি যার মধ্যে কিছু কিছু একটি মাত্র গ্রানাইট পাথরের খণ্ড কুদে তৈরি করা হয়েছে। এখানে আরও রয়েছে প্রচুর সংখ্যক ঝরনা, যেগুলো পাথর কেটে তৈরি করা ছোট ছোট খালের মাধ্যমে পরস্পর সংযুক্ত এবং এসব মূলতঃ সেচ কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, এই সেচ ব্যবস্থা ব্যবহার করে একটি পবিত্র ঝরনা থেকে পানি প্রতিটি বাড়িতে সঞ্চালনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, মাচু পিচুর শহর ব্যবস্থা তিনটি বড় বিভাগে বিভক্ত ছিল, এগুলো হল:
This is the great tourist influx
পবিত্র এলাকা
জনসাধারণের এলাকা; এ দুটি শহরের দক্ষিণে অবস্থিত। এবংপুরোহিত ও অভিজাত শ্রেনীর এলাকা।পবিত্র এলাকায় মাচু পিচুর প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদগুলো অবস্থিত, যেমন: ইন্তিউয়াতানা পাথর, সূর্য মন্দির এবং তিন জানালা ঘর। এসব স্থাপনা উৎসর্গ করা হয়েছিল ইন্তি, তাদের সূর্য দেবতা এবং মহান দেবতার প্রতি। জনসাধারণের এলাকার সাধারণ নিম্ন শ্রেনীর লোকজন বাসবাস করত। এই এলাকার স্থাপনা গুলোর মধ্যে রয়েছে গুদামঘর এবং বসত বাড়ি।
অভিজাত এলাকায় সম্ভ্রান্ত শ্রেনীর থাকার জন্য একটি অংশ ছিল। এ অংশের বাড়িগুলো একটি ঢালের ওপর কয়েক সারিতে অবস্থিত। হামাউতা বা বিচক্ষণ ব্যক্তিদের বাড়িগুলোর দেয়াল কিছুটা লালচে রঙের। অন্যদিকে নিউস্তা বা রাজকুমারীদের  অংশের ঘরগুলো অসম আয়তাকার। স্মৃতিসৌধ একটি খোদাইকৃত ভাস্কর্য যার ভেতর একটি নকশাকৃত কক্ষ রয়েছে। এটি যজ্ঞ এবং উৎসর্গের কাজে ব্যবহার করা হত।
সড়ক ব্যবস্থার অংশ হিসাবে ইনকারা মাচু পিচু পর্যন্ত একটি রাস্তা তৈরি করেছিল। বর্তমানে হাজার হাজার পর্যটক ইনকাদের পথে পায়ে হেঁটে মাচু পিচু ভ্রমণ করে। তবে এর জন্য আগে কোস্কোতে যাত্রাবিরতি করে স্থানীয় আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিয়ে তারপর উরুবাম্বা উপত্যকা হয়ে আন্দেস পর্বতমালার ওপর দিয়ে দুই থেকে চার দিনের এই পদযাত্রায় বের হতে হয়।
LUXURY TOUR – COMFORTABLE PERU 7 DAYS: LIMA – SACRED VALLEY – CUSCO – MACHU PICCHU
স্থানীয় উপাখ্যান অনুসারে কোনও অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ যদি এই পাথরে তার কপাল ঘসে তাহলে আধ্যাত্মিক জগৎ দেখতে পাবে। ইন্তিউয়াতানা (কেচুয়া: Intiwatana) পাথর দক্ষিণ আমেরিকার পূজিত পবিত্র পাথরগুলোর একটি। স্পেনীয়রা ২০ শতকের আগে এই পাথরটি খুঁজে পায় নি; ফলে এটি ইনকাদের অন্যান্য পবিত্র পাথরের মতো ধ্বংস হবার হাত থেকে বেঁচে যায়। এই পাথরগুলো এমন ভাবে স্থাপন করা হয় যাতে শীতকালে এগুলো সরাসরি সূর্যের দিকে নির্দেশ করে। একে “সূর্যের আকঁড়া বিন্দুও” বলা হয়, কেননা উপকথা অনুসারে এটি সূর্যকে তার জায়গায় আটকে রাখার উদ্দেশ্যে নির্মিত। ২১শে মার্চ ও ২১শে সেপ্টেম্বর, বছরে এই দুবার দিনের মাঝামাঝি সময়ে সূর্য ইন্তিউয়াতানা পাথরের একেবারে ওপরে থাকে; ফলে এর কোনও ছায়া তৈরি হয় না[৪]। প্রকৃতপক্ষে ইন্তিউয়াতানা একটি “মহাকাশ ঘড়ি”। এটি ২০০০ সাল পর্যন্ত অক্ষত অবস্থায় ছিল। সেই বছর একটি মদ কোম্পানির বিজ্ঞাপন নির্মাণের সময় ৯৯০ পাউন্ড ওজনের একটি ক্রেন এই পাথরের ওপর পড়ে গেলে কলমের আকারের একটুকরা ভেঙে যায়। কোম্পানিটির দাবী তারা এই ঘটনার জন্য দায়ী নয়। অনেক মানুষ মনে করে এই ঘটনার পর আত্মারা ইন্তিউয়াতানা ছেড়ে চলে গেছে।
মাচু পিচু একটি ইউনোস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। পেরুর সবচাইতে জনপ্রিয় পর্যটন স্থান ও অন্যতম আয়ের উৎস হবার ফলে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কারণে হুমকির মুখে পড়েছে। ১৯৯০ সালের শেষের দিকে পেরু সরকার এখানে যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধার জন্য একটি কেবল কার নির্মাণ এবং বুটিক, পর্যটকদের কমপ্লেক্স ও রেস্তোরাঁ সংবলিত একটি বিলাসবহুল হোটেল তৈরির অনুমতি দেয়। বিজ্ঞানী, শিক্ষাবীদ ও পেরুর জনগণ এই পরিকল্পনার তীব্র প্রতিবাদ করে, তাদের সংশয় ছিল এর ফলে মাচু পিচুতে পর্যটকের সমাগম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধিপাবে এবং তা এই পুরাকীর্তির অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করবে।
প্রতি বছরই মাচু পিচুতে পর্যটক সমাগম বাড়ছে, যা ২০০৩ সালে ৪ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। ফলে মাচু পিচুতে আর কোনও ধরনের সেতু নির্মানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত আছে] এবং বর্তমানে মাচু পিচুর উপর দিকে কোনওধরনের উড়োজাহাজ চালানো নিষিদ্ধ[৭]। ইউনেস্কো একে বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তভাবনা করছে। তা সত্ত্বেও, অতিরিক্ত ব্যবহার ও লোকসমাগমের ফলে মাচু পিচুর বেশ ক্ষতিসাধন হয়েছে। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মাচু পিচুর শতাব্দী প্রাচীন ইন্তিউয়াতানা পাথর বা “সূর্য ঘড়ি” এর উপর ১০০০ পাউন্ড ওজনের ক্রেন পড়লে এটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জে ওয়াল্টার টমসন (ইংরেজি: J. Walter Thompson) বিজ্ঞাপন এজেন্সির তত্ত্বাবধানে ক্রিস্টাল বিয়ারের বিজ্ঞাপনের চিত্রায়নের সময় দুর্ঘটনাটি ঘটে। ফেদেরিকো কাউফমান দোইগ (স্পেনীয়: Federico Kaufmann Doig ফেদ়েরিকো কাউফ়্‌মান্‌ দোইগ্‌) নামক পেরুর একজন পুরাতত্ত্ববিদ বলেছেন – “মাচু পিচু আমাদের পুরাতাত্মিক ঐতিহ্যের কেন্দ্রবিন্দু এবং ইন্তিউয়াতানা মাচু পিচুর হৃদয়। তারা আমাদের সবচাইতে পবিত্র ঐতিহ্যকে আঘাত করেছে। এছাড়াও ১৯৮০র দশকে হেলিকপ্টারের অবতরণস্থান তৈরির জন্য মাচু পিচুর কেন্দ্রস্থল থেকে একটি বড় পাথর অন্যস্থানে সরানো হয়। উল্লেখ্য, ১৯৯০ সাল থেকে কোনও ধরনের উড়োজাহাজে মাচু পিচুতে যাতায়াত বন্ধ করা হয়েছে।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে দ্বন্দ্ব
View of Machu Picchu in Peru a Peru family adventure
প্রথমদিকে হাইরাম বিঙাম পেরুর সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তাই পেরুতে ঘুরে বেড়ানো ও পুরাতাত্ত্বিক সামগ্রী ধার করার অনুমতি পেতে তাঁর কোনও সমস্যাই হয় নি। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার সময় তিনি সাথে করে প্রায় ৫০০০ পুরাকীর্তি নিয়ে আসেন এই উদ্দেশ্যে যে পেরুর সরকার সেগুলো ফেরত না চাওয়া পর্যন্ত তা ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে থাকবে।
বিতর্ক নতুন করে দানা বাধে যখন the Hartford Courant পত্রিকার ১৪ই মার্চ, ২০০৬ তারিখের একটি রিপোর্টে বলা হয় পেরুর সাবেক প্রেসিডেন্ট আলেহান্দ্রো তোলেদোর (স্পেনীয়: Alejandro Toledo) স্ত্রী অভিযোগ করেছেন যে, মাচু পিচু থেকে ১৯১২ সালে হাইরাম বিঙাম কর্তৃক অপসারিত ২৫০টি জাদুঘরমানের প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশণের সত্ত্ব দাবী করে নিজেদের কাছে রেখে এবং সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের Peabody Museum এ প্রদর্শণীর মাধ্যমে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় মুনাফা করছে। হাইরাম বিঙাম কর্তৃক সংগৃহীত মাচু পিচুর কিছু কিছু নিদর্শণ পেরুর কাছে হস্তান্তার করা হয়েছে, কিন্তু বাদবাকি নিদর্শণ সমূহ ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছে এই বলে যে, পেরুর প্রত্নসম্পদ সম্পর্কিত কেন্দ্রীয় আইনে এর সমর্থন আছে 
১৪ই আগস্ট, ২০০৭ তারিখে the Hartford Courant পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয় ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের কাছে সংরক্ষিত ৩০০টির মত জাদুঘরমানের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শণ পেরুর কাছে হস্তান্তরে সম্মত হয়েছে। এ ঘটনার পরপরই পেরুর নতুর প্রেসিডেন্ট আলান গার্সিয়া (স্পেনীয়: Alan García) একটি প্রতিনিধিদল নিয়োগ দেন যাতে করে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আলোচনা চালিয়ে নেয়া যায় এবং কোন রকম আইনী জটিলতা ছাড়াই এই সমস্যার সমাধান এবং বিতর্কের অবসান ঘটানো যায়।
পরবর্তীতে ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০০৭ সালে the Hartford Courant পত্রিকা তাদের প্রতিবেদনে বলে যে, বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে হাইরাম বিঙাম কর্তৃক অপসারিত মাচু পিচুর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শণ সমূহের হস্তান্তরের ব্যাপারে পেরু এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় একটি ঐকমত্য্যে পৌঁছেছে। এর আওতায় পেরু সরকার এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে ভ্রাম্যমাণ প্রত্নতাত্ত্বিক প্রদর্শণীর আয়োজন করবে এবং কোস্কো শহরে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় পরামর্শে একটি জাদুঘর ও গবেষণাগার নির্মিত হবে। ইয়েল মাচু পিচু থেকে অপসারিত সকল নিদর্শণের ওপর পেরুর স্বত্ত্ব স্বীকার করেছে, তবে গবেষণার জন্য ব্যবহৃত নিদর্শণ সমূহের ওপর পেরুর সাথে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়েরও অধিকার থাকবে, যার একটি অংশ চলমান গবেষণার উপাদান হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে থাকবে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

The national flag Cambodia

world map

TOP 10 REASONS TO VISIT THAILAND