প্রাচীন আরব এর ঐতিহাসিক নগরী পেত্রা (জর্দান)





প্রাচীন আরব এর ঐতিহাসিক নগরী পেত্রা (জর্দান)

ট্রেজারি ( আল-খাজেনি )
ট্রেজারি ( আল-খাজেনি )
পেত্রা  একটি প্রাচীন আরব শহর। বর্তমান জর্দানের দক্ষিণ-পশ্চিমের গ্রাম ওয়াদি মুসা-র ঠিক পূর্বে হুর পাহাড়ের পাদদেশে এর অবস্থান। ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এটি ছিল নাবাতাইন রাজ্যের রাজধানী। পেত্রা নগরী মূলত একটি অত্যন্ত সুরক্ষিত দুর্গ ছিল। এটি বিখ্যাত এর অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিস্তম্ভগুলোর জন্য। এটি তৈরি হয়েছে গুহার মধ্যে যা কোথাও কোথাও মাত্র ১২ ফুট চওড়া, মাথার ওপরে পাথরের দেয়াল। গুহার পাশেই রয়েছে কঠিন পাথরের দেয়ালের গায়ে গ্রথিত সেই প্রাচীন দালানগুলো যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল ‘খাজনেত ফিরাউন’ নামের মন্দিরটি। মন্দিরটি ফারাওদের ধনভান্ডার নামেও পরিচিত। আরো রয়েছে একটি অর্ধগোলাকৃতির একটি নাট্যশালা যেখানে প্রায় ৩০০০ দর্শক একসাথে বসতে পারে।
রক সমাধি অ্যাড-দির, "মঠ"
রক সমাধি অ্যাড-দির, “মঠ”

পেত্রা নগরী ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। পেত্রার চারধারে ছিল উঁচু পাহাড় আর একটি অফুরন্ত ঝরনাধারা। পশ্চিমের গাজা, উত্তরের বসরা ও দামাস্কাস, লোহিত সাগরের পাশের আকুয়াবা ও লিউস এবং মরুভূমির উপর দিয়ে পারস্য উপসাগরে যাওয়ার প্রধান সব বানিজ্যিক পথগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতো পেত্রা।
রোমান শাসনের সময় সমুদ্রকেন্দ্রিক বাণিজ্য পুরোদমে শুরু হলে পেত্রা দ্রুত ধ্বংস হতে থাকে। ১০৬ এডি তে রোমানরা এটিকে দখল করে তাদের ‘আরব পেত্রাইয়া’ প্রদেশের অংশীভূত করে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকে শহরটির প্রভূত উন্নতি হলেও পরবর্তীকালে প্রতিদ্বন্দী শহর ‘পামিরা’ পেত্রার অধিকাংশ বানিজ্যই দখল করে নিলে তখন পেত্রার গুরুত্ব কমে যায়। মুসলমানেরা এটিকে তাদের দখলে নেয় সপ্তম শতকে এবং পরবর্তীতে দ্বাদশ শতকে আবার ক্রুসেডাররা এটিকে দখল করলে ক্রমেক্রমে এটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এছাড়া ৩৬৩ সালে এক ভূমিকম্প ধ্বংস করে দেয় এর দালানগুলো, নষ্ট করে দেয় এর পানি সঞ্চালন ব্যবস্থাকে। মধ্যযুগে পেত্রার ধ্বংসাবশেষ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়, ত্রয়োদশ শতকের দিকে পেত্রা দেখতে যান ইজিপ্টের সুলতান বাইবারস।
মনিস্টারি ( আল-দির )
বহু বছর অজানা থাকার পর এই প্রাচীন শহরটিকে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে উন্মোচন করেন সুইস পরিব্রাজক জোহান লুডিগ বুর্খার্দত, ১৮১২ সালে। জন উইলিয়াম বার্গন তার নিউডিগেট পুরস্কার বিজয়ী বিখ্যাত এক সনেটে একে বর্ননা করেছেন “a rose-red city half as old as time” বলে। বার্গন কিন্তু পেত্রাতে যাননি। বলা যেতে পারে যেতে পারেননি। কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পর্যন্ত শুধুমাত্র ইউরোপীয়ানরাই সেখানে যেতে পারতেন। স্থানীয় লোক আর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যেতে হত সেখানে। ইউনেস্কো এটিকে ‘বৈশ্বিক ঐতিহ্যবাহী স্থান’ ঘোষনা করে ১৯৮৫ সালে। ঘোষনায় পেত্রাকে বলা হয় “one of the most precious cultural properties of man’s cultural heritage”। পেত্রা সংস্কৃতি, সম্পদ আর ক্ষমতায় একসময় যে কত সমৃদ্ধ ছিল তা প্রমাণ করতে পেত্রার ধ্বংসাবশেষই যথেষ্ট।

প্রাচীন আরব এর ঐতিহাসিক নগরী পেত্রা (জর্দান)
জর্দান:
মধাপ্রাচ্যের একটি রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলো হাশেমীয় জর্দান রাজ্য। জর্দানের রাজবংশরা মূলতঃ নিজেদেরকে হযরত মুহাম্মদের পিতামহ হাশেমের বংশধর বলে মনে করে। জর্দানের ভূপ্রকৃতি ঊষর মরুভূমিময়। এখানে প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণও কম। তুবও মধ্যপ্রাচ্যের রাজ্য হিসেবে দেশটি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশটি ছিল উসমানীয় সাম্রাজ্যের একটি অংশ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে ব্রিটিশরা অঞ্চলটি দখলে নেয়। এক সময়ে জর্দান নদীর পূর্বতীরের ট্রান্সজর্ডান এবং পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিন উভয়ই ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ১৯৪৬ সালে ট্রান্সজর্ডান অংশটি একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৪৯ সালে এর নাম বদলে শুধু জর্দান রাখা হয়।
বর্তমানে জর্দানের উত্তরে সিরিয়া, পূর্বে ইরাক ও সৌদি আরব, দক্ষিণেও সৌদি আরব ও আকাবা উপসাগর এবং পশ্চিমে ইসরায়েল ও পশ্চিম তীর। জর্দানের বৃহত্তম শহর বা রাজধানীর নাম হলো আম্মান।
ঐতিহাসিক নগরী পেত্রা এর অবস্থান:
পেত্রা নগরী হলো একটি প্রাচীন আরব শহর। ধারনা করা হয় য়ে, এটি প্রায় দুই হাজার বছর পুরনো একটি নগরী। এই নগরটি লোহিত বা মৃত সাগর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে বর্তমান জর্দানের দক্ষিণ-পশ্চিমের গ্রাম ওয়াদি মুসা-র ঠিক পূর্বে হুর পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এটি ছিল নাবাতাইন রাজ্যের রাজধানী। এটি বিখ্যাত এর অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিস্তম্ভগুলোর জন্য।
ঐতিহাসিক নগরী পেত্রা এর ইতিহাস:
তখনকার সময় আরবে অনেক জাতীর বসবাস ছিলো, তার মধ্যে একটি হলো নাবাতিয়ান। এই নাবাতিয়ান জাতির রাজধানী ছিলো পেত্রা শহর। আর এই শহর দিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বাণিজ্যিক রাস্তা গিয়েছিলো। শহরটি মূলত সেই বাণিজ্য পথকে কেন্দ্র করেই বানানো হয়েছিলো। পথের যাত্রীদের নির্ভর করে শহরটি হয়ে উঠেছিলো রমরমা।
রাজার দেওয়ালের গর্তে কবর
একসময় নগরীটিতে অত্যন্ত সুন্দর সুরক্ষিত একটি দুর্গ ছিল। যার চারধারে উচু পাহাড়ি দেয়াল, কিছুদুর পরপর বর্গাকার, গোলাকার উচু উচু স্তম্ভ, পাহাড়ের গায়ে খোঁদাই করা পাথুরে কারুকার্য, পাহাড় কেটে কেটে নিপুন ভাবে ১২ ফিট কোথাও কোথাও আরও উচু রুম তৈরির ব্যাপার গুলো বিশ্বের মানুষের কাছে আজও রহস্যময় এবং বিখ্যাত করে রেখেছে যায়গাটিকে। এক সময় এই নগরীর চারপাশের উচু পাহাড় গুলিতে প্রচুর পরিমানে ঝর্নাও ছিল, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানা যায়।
পেত্রা নগরীর মুল গুহার ঠিক পাশেই রয়েছে কঠিন পাহাড়ের উপর কারুকার্জ করা দালান গুলো। যার মাঝে ‘খাজনেত ফেরাউন’ নামের মন্দিরটি অন্যতম। মন্দিরটি আবার একসময় ফারাও রাজাদের ধনভান্ডার নামেও পরিচিত ছিল। দালান, মন্দির ছাড়াও এই নগরীতে বিনোদনের জন্য স্টেডিয়ামের মতো তৈরি করা একটি নাট্যশালাও রয়েছে, যেখানে প্রায় ৩ হাজার দর্শক একসাথে বসতে পারবে।
নগরীটি এমন সুবিধাজনক যায়গায় নির্মিত হয়েছিল, যেখান থেকে পশ্চিমের গাঁজা, উত্তরের বসরা ও দামেস্ক, মৃত/লোহিত সাগরের পাশের আকুয়াবা ও লিউস সহ মরুভূমির উপর দিয়ে পারস্য উপসাগরে যাওয়ার প্রধান সব বাণিজ্যিক পথ গুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো পেত্রারা। মূলত একারণেই নগরীটি অর্থনৈতিক ভাবে বেশী সমৃদ্ধ এবং নিরাপত্তার দিক দিয়েও অনেক সুরক্ষিত ছিল।
ঐতিহাসিক নগরী পেত্রার পতন:
প্রথমদিকে পেত্রা নগরীটি সম্পূর্ণ সমৃদ্ধ নগরীরূপে ছিল আর সবথেকে শক্তিশালীও ছিল। পরবর্তিতে রোমান শাসনের সময় রোমানরা সমুদ্র কেন্দ্রিক বাণিজ্য শুরু করলে পেত্রাদের আধিপত্য কমে যায়, একইসাথে অর্থনৈতিক ভাবে পেত্রারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে এবং ১০৬ খ্রিটাব্দে এসে রোমানরা এটিকে দখল করে তাদের ‘আরব পেত্রাইয়া’প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলে।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকে শহরটির কিছুটা উন্নতি সাধন করা হলেও, পরবর্তীতে পেত্রার প্রতিদ্বন্দ্বী শহর ‘পামিরা পেত্রাদের অধিকাংশ বাণিজ্য দখল করে ফেললে পেত্রার গুরুত্ব একেবারেই কমে যায়। সপ্তম শতকের দিকে মুসলমানরা এটিকে দখল করলেও দ্বাদশ শতকে ক্রুসেডারটা এটিকে দখল করে। এভাবে সময়ের ব্যাবধানে, যুদ্ধ বিদ্রোহ এর মুখোমুখি হয়ে পেত্রা নগরী একসময় প্রায়ই ধ্বংস হয়ে যায়। তাছাড়া ৩৬৩ সালে এক ভূমিকম্পে ধ্বংস করে দেয় এর দালানগুলো, নষ্ট করে দেয় সব কিছু। ভেঙ্গে গেছে অনেক সুন্দর আর গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মাটিতে মিশে গেছে কত ধন দৌলত। যার হিসেব খুঁজে পাওয়া মনে হয় আজও সম্ভব না।
ঐতিহাসিক নগরী পেত্রার পুনরুদ্ধার:
পেত্রা নগরীটি খুঁজে বের করেছিলো বারখাট নামের একজন লোক। যার পুরো নাম হচ্ছে সুইচ পরিব্রাজক “জোহান লুডিগ বারখাট”। ১৮১২ সালে বারখাট পেত্রা নগরী খোঁজার জন্য বেড়িয়ে পরেন। কিন্তু পেত্রা নগরী যে ঠিক কোন জায়গায় আছে তার সঠিক হুদিস তার কাছে ছিলো না। আর যে জায়গায় অনুমান করা হয়েছিলো, যে এখানে পেত্রা থাকতে পারে সেখানে যাওয়ার জন্য লোকাল গাইডের প্রয়োজন হতো। কিন্তু সে তো ঐ অঞ্চলের ছিলো না যে অনায়াসে যেতে পারবে। তাছাড়া ধরা পরলে গুপ্তচর বলে জেলেও পাঠাতে পারে। অনেক ভাবার পর বারখাট একটা অভিনব বুদ্ধি বের করলো। সে নিজের দাড়ি বড় করতে শুরু করলেন। যাতে তাকে দেখতে স্থানীয়দের মতন মনে হয়। তারপর সে অনায়াসে গাইড পেয়ে গেলেন, আর শুরু করলেন পেত্রা উদ্দেশ্যে যাত্রা।
দিনের পর দিন হেঁটে যেতে লাগলো তারা। তারপর একদিন তারা মরুভূমি থেকে দেখতো পেলো একটি গিরিখাত। সেই গিরিখাতের দুই পাশে উঁচু উঁচু সব পাহাড়, মাঝ দিয়ে রাস্তা। সেখান দিয়ে হাঁটতে এক সময় বারখাটের চোখে পরলো একটা পাথরের ভবন। তা দেখেই বারখাট বুঝে গেলো তারা এসে পরেছে পেত্রা, আর খুঁজে পেয়েছে সে ইতিহাসে বিলীন হয়ে যাওয়া সেই নগরটিকে। তিনি ফিরে এলেন আর ফিরে এসেই বিশ্ববাসীকে জানানেল তার আবিষ্কারের কথা। কিন্তু মরুভূমির ঠিক কোন জায়গায় সেই গিরিখাত, কোন জায়গায় সেই ভবন আর কোন জায়গায় ই বা সেই নগরী তার কোনটাই সঠিকভাবে বলতে পারলো না বারখাট।
নীল চ্যাপেল
কিন্তু বারখাট এর পর দুই ফরাসী লিনো বেলফুঁ এবং লিউন দ্য ল্যাবঘদের ১৮২৮ সালে তারা শহরটির অনেক স্কেচ তৈরি করেন। পরে সেগুলো একত্রে করে প্রকাশ করা হয়। তারপর থেকেই সকল মানুষ জানা শুরু করলো পেত্রা নগর সম্পর্কে। পৃথিবীর অসংখ্য পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এই পাথুরে নগরী পেত্রা। জন উইলিয়াম বার্গান তার “নিউডিগেট”পুরষ্কার বিজয়ী বিখ্যাত এক সনেটে এই পেত্রা নগরীকে বর্ণনা করে লিখেছেন, “A rose-red city half as old as time”. পেত্রা সংস্কৃতি, সম্পদ, ঐতিহ্যে আর ক্ষমতায় কতটা যে উন্নত ছিলো তার প্রমাণ পাওয়া যায় এর ধ্বংসাবশেষ দেখেই। ইউনেস্কো একে “ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট” ঘোষণা করেছে ১৯৮৫ সালে। ঘোষণায় পেত্রাকে বলা হয়, One of the most precious cultural properties of man’s cultural heritage.

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

২০০০ সালে এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৫৯০ দুর্ঘটনার মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে কনকর্ড যুগের।

বাংলাদেশের সকল রাজবাড়ী ও জমিদার বাড়ীগুলির ইতিহাস ও বর্তমান অবস্হা কি (ভিডও সহ )