নামটা বড়ই আকর্ষণ মায়া সভ্যতা- বিস্ময়নগরী চিচেন ইৎজা
grameen
মায়া সভ্যতার বিস্ময়নগরী – চিচেন ইৎজা
এক বর্ষপঞ্জি, একটি সরোবর, একজন ঈশ্বর।মায়া সভ্যতার নাম যখন প্রথমবারের মত শুনি, নামটা বড়ই আকর্ষণ করেছিল, কেমন একটা মায়ামাখা, মায়াকাড়া। পরে যদিও শুনেছিলাম সেটা কেবলই একটা নাম, হয়ত তাদের মধ্যে মায়ামমতার বেশ ঘাটতিই ছিল ! কেন, সে কথাই আসছি পরে।মায়া সভ্যতার কথা থাকলেই সেখানে থাকত এক পিরামিডের ছবি, আকাশ ছোঁয়া অদ্ভুত এক স্থাপত্য, কিন্তু মোটেও মিশরের পিরামিডের মত নয়, মায়ান পিরামিডের উপরে মনে হত একটা বিশাল চৌকো ঘর বসানো হয়েছে, সেই সাথে চমৎকার বাঁধানো সিঁড়ি আছে সবদিকেই ! কোথায় অবস্থিত এই পিরামিডটি?
কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারেরও আগে মায়া সভ্যতার একটি বড় শহর ছিল চিচেন ইৎজ়া। এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি মেক্সিকোর ইউকাতান রাজ্যের তিনুম মিউনিসিপ্যালিটির অন্তর্ভুক্ত। চিচেন ইৎজা ৬০০ খিষ্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মায়া সভ্যতার উত্তরাংশে অবস্থিত নিম্নভূমি অঞ্চলের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল।
এটি শুধু মায়াসভ্যতার মানুষদের বৃহত্তম শহরগুলোর মধ্যে অন্যতমই ছিল না, প্রত্নতাত্ত্বিক শহরগুলোর মধ্যেও ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আক্ষরিক অর্থ অনুযায়ী, চিচেন ইৎজ়ার অর্থ দাঁড়ায় ‘ইৎজ়ার কুয়োর মুখে’। ‘চি’ অর্থ মুখ, ‘চেন’ অর্থ কুয়ো। ইৎজ়া একটি গোত্রের নাম। আবার কারও কারও মতে, জলদেবতার নামও। কারণ সুপেয় জলের কূপগুলোর জন্যই প্রাচীন মেক্সিকানরা এখানে বসতি স্থাপন করেছিল। আশির দশকে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক মত দেন, মায়া সভ্যতার অন্য শহরগুলোর মতো চিচেন ইৎজ়ায় নির্দিষ্ট কোনও শাসক ছিলেন না। চিচেন ইৎজ়া মায়ানদের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর একটি ছিল। বলা হয়, মায়ানদের সময়ে বিভিন্ন গোত্রের মানুষ এখানে প্রার্থনা করত। শহরটিতে নানা ধরনের স্থাপত্যশৈলীর তৈরি পাথরের অনেক দালান রয়েছে। এসব দালান দেখতে প্রতিবছর ১০ লাখেরও বেশি মানুষ মেক্সিকো ভ্রমণ করে থাকেন। বর্তমানে চিচেন ইৎজ়া মেক্সিকোর রাষ্ট্রীয় সম্পদ, ইতিহাস ও নৃতত্ত্ব ইনস্টিটিউটের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে।
সেই সাথে থাকত গোলাকার এক ভাঙ্গাচোরা ঘরের ছবি, এক দিকে ধ্বসে পড়া, শুনতাম সেটি নাকি মায়াদের মানমন্দির, গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায় অসাধারণ দখল ছিল তাদের, হয়ত ছিল না কোন টেলিস্কোপ বা দূরবীন কিন্তু নক্ষত্র ও অন্যান্য মহাজাগতিক ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণের জন্যই নাকি নির্মিত হয়েছিল সেই গোলাকৃতি কক্ষ। এখনো কি সেখানে তারা দেখা হয় দেখা হয় বর্তমানের ধুলো-ধুয়োয় দূষিত আকাশে? সেখান গেলেই না জানতে পারব, কোথাই এই মান মন্দির?
একটি অদ্ভুত পাথুরে ভাস্কর্যের সাথে পরিচয় হয় মায়াদের মায়ায় জড়িয়ে গিয়ে, বিশাল দুটি কান তার, অদ্ভুত ভঙ্গীতে না শোয়া, না বসা অবস্থানে থেকে তাকিয়ে থাকে সে নির্নিমেষে, মাথাও তার দুইটা! কি আজব, কি তার পরিচয়? সে নাকি মায়াদের বৃষ্টিদেবতা, নাম তার চাক-মুল। কোথায় গেলে পাব চাক-মুলের দর্শন?
একটা অদ্ভুত সুন্দর সরোবরের ছবি দেখি মাঝে মাঝে, কেমন ঘন সবুজ জল, বেশ গভীর, চারপাশের উঁচু প্রাকৃতিক দেয়ালের চুনা পাথরের প্রবল অস্তিত্ব ভেদ করে নিজেদের জানান দিচ্ছে ছন্নছাড়া কিছু গাছ। শুনে ভেবড়ে গেলাম, অবাক হলাম, আতংকিতও হলাম বইতে পড়ে যে এই প্রাকৃতিক কুয়ো অতি গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র ছিল মায়ানদের কাছে, কারণ এইটি ছিল নরবলি দেবার স্থান! মুহূর্তে সবুজ সুন্দর স্থানটি কেন ধূসর পঙ্কিলতায় ছেয়ে গেল, চাপ চাপ বীভৎস রক্তের ছাপ যেন চারপাশে চুনাপাথরের দেয়ালে। কোথায় এই মৃত্যুপুরী?
জীবনের খুব সময় অল্প সময়ই আরাধ্য অনেক কিছু একসাথে মিলে যায়, অনেক বার হাঁটতে চাওয়া বেশ কিছু পথ এসে মিলে যায় এক কেন্দ্রবিন্দুতে। যে কারণেই এই গল্পের শুরু! উপরের উল্লেখিত চারটি আকর্ষণও বটেই, আরও অনেক অনেক কিছু একসাথে এসে ঠাই নিয়েছে বিশ্বের বিস্ময় মায়া সভ্যতার সবচেয়ে জনবহুল ও অন্যতম বৃহত্তম শহর মেক্সিকোর ইয়ুকাটান রাজ্যের চিচেন ইৎজায়। যাবেন, সেই খানে, খানিকক্ষণের জন্য প্রতিদিনের জীবন থেকে সত্যিকারের মায়ানগরীতে?
সকালে ঠেসে ঝাল মেক্সিকান নাস্তা খেয়ে চার মূর্তি ব্যাগবোঁচকা নিয়ে বাহির হয়ে পড়লাম চিচেন ইৎজার পথে, মেক্সিকোতে আজকেই আমাদের শেষ রাত, কাল ভোরে কানকুন বিমান বন্দর থেকে শুরু হবে অন্য মহাদেশের প্রান্তসীমা ছোঁয়ার নতুন উত্তেজনা। সেই হিসেবে প্রাচীন এই দেশটিতে অবস্থানের শেষ দিনটি আমরা বরাদ্দ রেখেছিলাম মায়ান শহর আর প্ল্যায়া ডেল কারমেনের সমুদ্র সৈকতের জন্য। প্রতি বছর বারো লক্ষ পর্যটক আসে এই বিস্ময়কর সৃষ্টি দেখতে, মানে মানে প্রতিদিনই সরগরম অবস্থা, তাই মানুষ কম এমন ছবি তুলতে চাইলে খুব সকাল সকাল সেখানে যাবার কোন বিকল্প নেই । কাজেই আমরা এখন আধুনিক প্রাচীর ঘেরা চিচেন ইৎজা কমপ্লেক্সের সামনে।
যদিও এমন আইন আমাদের জন্য হৃদয়বিদারক, তারপরও হয়ত পিরামিড সংরক্ষনের জন্য জরুরী, খেয়াল করে দেখি এক অতি বিরল মুহূর্তে এসেছি পিরামিডের সামনে, দেব দর্শনের চেয়েও দুর্লভতর এই সুযোগ, এর সামনে কোন জনমনিষ্যি নেই!
সব আলোকচিত্রেই দেখি মানুষের ভিড়ে পিরামিডের ভিত দেখা যাচ্ছে না, এখন সুযোগ পাওয়া গেছে কেবলমাত্র নিজেদের ছবি এই অমর কীর্তির সাথে তুলে রাখার, এর মধ্যেই উসাইন বোল্টের মত লম্বা লম্বা পা ফেলে ছোটা শুরু করেছে আমার মেক্সিকান ভাই ইসাইয়াস সেরণা, সেই মুহূর্তের কিছু ছবি তুলে পরে দেখি এক ভারী মজার ছবি এসেছে, যেখানে ছায়াসহ ইসাইয়াস শূন্যে ভাসমান বলে ভ্রম হচ্ছে!
চিচেন ইৎজার আক্ষরিক অর্থ ইৎজার কুয়ার মুখে, ইৎজার পরিচয় অবশ্য আজ পর্যন্ত জানা যায় নি, হতে পারে কোন গোত্রের নাম, অথবা জলদেবতার নাম, কারণ মায়ারা এই সমস্ত জায়গাতে বসতি স্থাপন করেছিল কেবলমাত্র সুপেয় জলের কূপগুলোর জন্যই।
টিকিট অফিসের সামনে বেশ একটা শোরগোল, বাতাসে মেছো গন্ধ না থাকলেও মাছ বাজারের আবহাওয়া ও উত্তেজনা, সাধে কি আর বলে বাঙ্গালী আর ল্যাতিনরা ঠিক জাত ভাই, কি আড্ডায়, কি জোর গলার খামোখা তক্কে!টিকিটের ব্যবস্থা হতেই সুড়ুৎ করে চালান হয়ে গেলাম ভেতরে, পিছনে পড়ে থাকল বর্তমান যুগের হৈ হল্লা, সামনের পানের কেবল মায়াদের নিস্তব্ধ জ্যান্ত ইতিহাস।
গাছের আড়াল থেকেই মনে হল বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেই অবিশ্বাস্য অবয়ব সেখানে আছে মেঘদল ছুয়ে, সমস্ত বিরান প্রান্তর দখল করে আছে ময় দানবের কারবার। সেই পিরামিড, যা কে বরাবরই ক্যামেরার কারসাজি বলে মনে হত বইতে দেখে। নীল আকাশকে পর্যন্ত আড়াল করে দিয়েছে ১৩০০ বছর আগের নির্মিত ৭৫ ফিট উচ্চতার এই স্থাপত্য।
আসলে এটি কিন্তু একটি মায়ান বর্ষপঞ্জি! কি বিশ্বাস হল না? পিরামিডটির মোট নয় ধাপের প্রতি ধাপ সিঁড়ি দিয়ে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, তাহলে মোট ধাপ হল ১৮ টি, যা কিনা মায়ান বর্ষপঞ্জির ২০ দিনের মাসের হিসেবে ১৮ মাসের প্রতীক! প্রতিটি সিঁড়িতে ৯১টি ধাপ রয়েছে, চারদিকের সিঁড়ির সাথে সর্ব উপরের কক্ষটির অবস্থান যোগ করুন, পাবেন ৩৬৫ ! মানে বছরের মোট দিনের সংখ্যা, এছাড়া প্রতি ধাপে ৫২টি প্রস্তর খন্ডের সমাহার মনে করিয়ে দেয় মায়াদের ৫২ বছরের বর্ষচক্রের কথা! আদতে এল ক্যাসতিয়ো বা কুকুলকানের পিরামিড নামে পরিচিত এই উপাসনালয় পাথরের তৈরি মায়ান বর্ষপঞ্জি।
কি অপূর্ব নির্মাণ শৈলী! মহাকাল, ভূমিকম্প, লুটেরাদের চোখ রাঙ্গানি উপেক্ষা করে আজো দাড়িয়ে আছে সগর্বে যেমনটি ছিল হাজার বছর আগেও। বছর কয়েক আগেও শুনলাম পিরামিড শীর্ষে ওঠার অনুমতি পাওয়া যেত, কিন্তু কয়েকজন ভ্রমনার্থী বেখেয়ালে পড়ে সরাসরি অন্য ভুবনে যাত্রা করতে বাধ্য হলে মানুষের এবং পিরামিডের, উভয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এখানে আরোহণ নিষিদ্ধ করা হয়।
বিশাল এলাকা জুড়ে এই শহর, এর মাঝেই বিশাল গাছপালা, হয়ত তার আড়ালেই আবার ঢাকা পড়ে আছে কোন সুপরিচিত স্থাপত্য! কিছুক্ষণ হেঁটে আরেক প্রান্তে যেতেই সেই অসাধারণ মানমন্দিরটির দেয়ালে দৃষ্টি ঠেকল, এর নাম দেওয়া হয়েছে কারাকোল বা শামুক, এর ভিতরের প্যাঁচানো সিঁড়ির জন্য!
ইয়াইয়াস চিচেন ইৎজায় এসেছিল বছর পনের আগে, সেই সময়ে এই সমস্ত স্থাপত্যেগুলোতে যথেচ্ছ আরোহণের নিয়ম ছিল, হাতে ছুয়ে অনুভবের অপার্থিব কল্পনা বাস্তবে পরিণত করা সম্ভব ছিল। নিশ্চয়ই কিছু লোভী মূর্খ মানুষ নিজেদের ড্রয়িংরুমে সাজাবার জন্য ছোট পাথরের টুকরো খুলে নিত আলগোছে, রাখত বিবেক বুদ্ধিহীনের মত নিজের নাম খোদাই করে, এই সমস্ত কারণেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এই শহরের সমস্ত আকর্ষণে প্রবেশ, কেবল দূর থেকে দেখতে হবে।
( অন্যদের আর কি দোষ দিব, চিচেন ইৎজার চেয়ে ঢের প্রাচীন নগরী মহাস্থানগড়ের ইট এখনো সুযোগ পাওয়া মাত্রই খুলে নিয়ে যাওয়া হয় দিনে দুপুরে, স্থানীয় অনেকের বাড়ীর অর্ধেক ইটই সেখান থেকে সংগৃহীত )। চোখে দূরবীন লাগিয়ে মানমন্দিরের মূল কক্ষটির নিচে একটি দরজা কেবলমাত্র দেখা গেল, তাতেই অভিভূত আমরা। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় হাজার বছর আগেও মহাকাশবিজ্ঞানে তাদের অগ্রগতির কথা ভেবে!
তবে এই বছরের ডিসেম্বরে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে বলে যারা জল ঘোলা করে দিব্যি পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে, তাদের মতের সাথে মায়াদের আকাশ বিষয়ক গভীর জ্ঞান এবং বর্ষপঞ্জির কোন মিল নেই, কাজেই- সাধু সাবধান! )
তার অদূরেই একটি অদ্ভুত দর্শন কুঁজো পিঠ পিরামিড, তার চূড়াটা কোন কারণে বাজে ভেবে ভেঙ্গে পড়েছে। কারণটিও জানা গেল তৎক্ষনাৎই, মানুষের মুর্খামি এবং লোভ, যাতে সামান্য সাহায্য করেছে ডিনামাইট নামের বিস্ফোরক! জনৈক পুরাতত্ত্ববিদ নামের কলঙ্ক ব্যক্তির উর্বর মস্তিষ্কে আসে এই পিরামিডের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা গুপ্তধনের আভাসের কথা। ব্যস, জ্ঞানার্জনের সঠিক পথ ছেড়ে সংক্ষিপ্ত কিন্তু ক্ষতিকারক পথ বেঁছে নিয়ে ধ্বসিয়ে দিলেন এমন চমৎকার কীর্তিকে!
আর গুপ্তধন, সেখানে জুটল লবডঙ্কা! আর যদি মিলতও বা কিছু সোনাদানা, তার মূল্যতো আর এর ঐতিহাসিক আবেদনের চেয়ে বেশী হত না কোনমতেই। সোজা ভাষায় বলি, এইযে অযুত-নিযুত পর্যটক ফি বছর এসে ঘুরে যাচ্ছে এই জায়গাগুলোতে, তাদের থেকে উপার্জিত অর্থ মেক্সিকোর সমস্ত সোনার তাল বা হীরক খণ্ডের মুল্যের চেয়ে বেশী, আসলে বিশ্বের সব দেশেই তাই।
বিশাল এক দরজা দেখতেই কেটে গেলে আধা ঘণ্টা, কি অপূর্ব সুক্ষ কারুকার্য তার শরীরে, আবিস্কার করলাম কিছু কিছু দেবতার মুখ, পশু পাখির আদল। কি করে এই বিশাল পাথরখণ্ডগুলো পরিবহনের ব্যবস্থা করেছিল তারা সে এক অমীমাংসিত রহস্য।
এর পরপরই এসে গেল বল খেলার ময়দান যা গ্রেট বল কোর্ট নামে খ্যাত। এমন চত্বর এই শহরেই ১৩টি থাকলেও এটিই সর্ববৃহৎ, দৈর্ঘ্য ৫৫১ ফিট, প্রস্থ ২৩০ ফিট! জানা যায় এটি সমগ্র মধ্য আমেরিকার বৃহত্তম বল খেলার ময়দান। প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে রবারের বলের ( ওজন ৪ কেজি) এই খেলাটি চলে আসছিল আমেরিকার অনেক জায়গাতেই, আজো কিছু কিছু রেড ইন্ডিয়ান গোত্রে প্রায় একই ধরনের খেলা চালু আছে, দেখা মিলল গোল দেবার স্থানটিরও!
মন্দিরের পর মন্দিরের সারি। সবই যে মায়াদের তা কিন্তু নয়, যুদ্ধবাজ টোলটেক গোত্রের কিছু দেবতাও ঢুঁকে গিয়েছিল যুদ্ধে হাড়ের খেসারৎ হিসেবে, আর মায়াদের অন্যতম প্রধান ঈশ্বর কুকুলকান বা পালকওয়ালা সরীসৃপের সাথে যে অ্যাজটেকদের প্রধান দেবতা কেতজালকোয়াটলের কি দারুণ মিল তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই, এর অর্থ আরো প্রাচীন কোন পুরাণ থেকে এসেছে এই সমস্ত দেবতার গালগল্প।
এক মন্দিরের গায়ে খোদাই করা ছিল কেবল জঙ্গলের রাজা জাগুয়ারের চমৎকার সব ছাপ,
আবার অন্য এক মন্দিরে ছিল ঈগল, জাগুয়ার এবং সর্প, মানে তিন ভুবনের তিন ঈশ্বরের প্রতীক ( এমনটি অবশ্য বিশ্বের অনেক জায়গাতেই আছে, পড়ে বিশদ আলোচনা করতে হবে এই ব্যাপারটি নিয়ে)।
বলকোর্টের এক জায়গা থেকে অপরূপ রূপে দেখা দিল কুকুলকানের মুখব্যাদান এবং তার মন্দির!
এবার চারপাশের পাথুরে আকর্ষণ ছেড়ে খানিকটা এবড়ো থেবড়ো মেঠো পথ ধরে নানা রঙিন পণ্যের দোকান
পেরিয়ে দর্শন মিলল মায়াদের পবিত্র কূপের। সবুজ জল, চুনা পাথরের সফেদ দেয়াল, হুবহু বইতে দেখা ছবির মতই।
আছে সেই পাথরটি যেখানে মূলত খরা থেকে রক্ষা পাবার জন্য বলি দেওয়া হত মানুষদের। প্রচলিত জনপ্রিয় ধারণা, মায়ারা কেবলমাত্র শিশু এবং কুমারী নারীদের বলি দিত দেবতার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। কিন্তু সত্য হচ্ছে তারা সব ধরনের মানুষকে নৈবদ্য হিসেবে ব্যবহার করত কল্পিত ঈশ্বরের মনরক্ষার জন্য। সেই সাথে সোনা, নানা মূল্যবান রত্ন-পাথর ইত্যাদি পাওয়া গেছে এই ভুতুড়ে জল সেঁচে।জানা গেছে, অনেক সময়ই বলির শিকারের শরীরে তারা পাথর বেঁধে দিত যেন সে সহজে ভেসে না উঠতে পারে। সেই সাথে কিছু কিছু ক্ষেত্রে জানা গেছে হাড়বজ্জাত পুরোহিত বলির শিকার বিশেষত শিশুদের হৃৎপিণ্ড উপড়ে নিয়ে জগতের বীভৎসতম দৃশ্যরচনা করত জিঘাংসা নিয়ে সেই হৃৎপিণ্ড চিবিয়ে চিবিয়ে।অথচ জলের উপরিভাগ কি শান্ত, সবুজ, মোহময়- বোঝার উপায় নেই কত রক্ত বন্যা বয়ে গেছে এইখানে অকারণেই।জায়গাটি দেখার খুব ইচ্ছা থাকলেও এই রক্তাক্ত নিষ্ঠুর ইতিহাস মনে পড়া মাত্র থাকার ইচ্ছে উবে গেল, বরং বেশ খানিকক্ষণ দেখলাম হাজার স্তম্ভের মন্দির।
অনেক অনেক স্তম্ভ দাড় করানো সব মন্দিরের বিশাল চত্বরে, কিন্তু বৃষ্টিশ্বর চাক-মুলের কোন পাত্তা নেই! কত আশা করে আছি চাক-মুলের সামনে যেয়ে তারমতই ভঙ্গিমায় আসন গেড়ে ছবি তুলব, এখন তো ভিতরে যাওয়ায় নিষেধ!
কিন্তু যতই আমরা হাজার স্তম্ভের মন্দির থেকে দূরে সরে যেতে থাকলাম কুকুলকানের পিরামিডের বিশাল মাঠের এক কোণে ততই দূর থেকে দৃশ্যমান হতে থাকল রক্তচোষা দেবতা ( তার সন্তুষ্টির জন্যই তো এত বলি, এত রক্তপাত)।
সেখানে রুমাল বিক্রি করতে থাকা এক মায়া দিদিমা জানালেন সেই মন্দিরের মাথাই যেমন যেমন চাক-মুল অবস্থান করছে, এই পিরামিডের উপরের কক্ষেও আছে তেমন এক লাল পাথরের তৈরি জাগুয়ারের মূর্তি, যা হয়ত ব্যবহৃত হত সিংহাসন হিসেবে! কিন্তু এখন আর তার দর্শন পাওয়া সম্ভব নয়!
যদিও অন্য জাগুয়ার ছিল আরেক মন্দিরে-
ভাগ্যিস দিদিমা বলেছিলেন, না হলে জানা হোত না হয়ত কোনদিনই। তার কাছেই শিখে নিলাম কি করে সুর করে শুদ্ধ ভাবে চাক—মূল বলতে হয়। পরে বই ঘেঁটে দেখি তার কথা ১০০ % ঠিক, কিন্তু চাক-মুল আসলে মায়ান কোন দেবতা নয়, এটি টোলটেক প্রভাবিত মায়ান অঞ্চলেই কেবল দেখা যেত। এর অর্থ—অজানা আজও।
আগেই শুনেছিলাম, এবার চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন হল স্থানীয় মায়াদের দেখে। তারা মেক্সিকো অন্যান্য জায়গায় দেখা মায়ানদের চেয়ে অনেক খর্বাকৃতির, এবং দেহের গঠন সেই অনুযায়ী অনেক শক্তিশালী।
সামনের এক চাতালে দেখি শুধু সারি সারি দাঁত বাহির করা মানুষের খুলি খোঁদাই করা! ইন্ডিয়ানা জোন্সের মুভিসেটও ফ্লপ এই বিস্ময় নগরীতে!
শেষের সময়টুকু পিরামিড চত্বরের চারপাশেই মূলত কাটালাম, এখনো বেশ শক্ত-পোক্ত থাকলেও একদিকে সিঁড়ি বেশ ভাঙ্গনের মুখে,
কিন্তু আশা করা যায় কিছু দিন আগেও বিশ্বের নতুন ভাবে নির্বাচিত সপ্তাশ্চর্যের একটি হওয়া চিচেন ইৎজা অনেক অনেক শতাব্দী রাজত্ব করে যাবে আমাদের মানসলোকে বিস্ময়ের আঁধার হয়ে।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ মন্দির অ্যাংকর ভাট (কম্বোডিয়া)
বিশ্বের সর্বোচ্চ ধর্মীয় স্থাপনায় কাসাব্ল্যাংকা’র এর গ্র্যান্ড মস্ক হাসান মসজিদ (মরক্কো)
বিশ্বের ঐতিহ্যস্থান হিসেবে খ্যাত হাম্পি সাম্রাজ্যে-বিজয়নগর
মিশর-পিরামিড ও মমির ইতিহাস:
শাহজাহান-মমতাজের প্রেমকাহিনী ও তাজমহলের ইতিহাস
ইংল্যান্ডের এক চিরন্তন রহস্য “স্টোনহেঞ্জ”
রহস্যঘেরা পাপল নিষিদ্ধ নগরী – ফরবিডেন সিটি বেইজিং
মায়া সভ্যতার এক বিস্ময়কর নগরী- চিচেন ইৎজা (মেক্সিকো)
রহস্যে ঘেরা ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান বা ঝুলন্ত বাগান (ইরাক)
প্রকৃতির অপার বিস্ময়কর ও ভয়ংকর সৌন্দর্যের আরেক নাম নায়াগ্রা জলপ্রপাত (আমেরিকা)
চীনের মহাপ্রাচীর (গ্রেট ওয়াল অব চায়না) এর ইতিহাস:
Undiscovered Southeast Asia : Hidden Treasures of Remote Towns and Secret Beaches
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন