জীব-বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ, ঘন সবুজ এবং রহস্যময় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ক্রান্তীয় রেইনফরেস্টের নাম আমাজন রেইনফরেস্ট।


পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ক্রান্তীয় রেইনফরেস্টের নাম আমাজন রেইনফরেস্ট। জীব-বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ, ঘন সবুজ এবং রহস্যময় এই স্থান সম্পর্কিত বেশ কিছু তথ্য দিয়ে সাজানো আমাদের আজকের আয়োজন।

আমাজন শব্দের উৎপত্তি

বলা হয়ে থাকে, আমাজন শব্দের উৎপত্তি ঘটে ‘ফ্রান্সেস্কো দে অরেলানা’ এর সাথে “তাপুয়াস” এবং অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। রীতি অনুযায়ী পুরুষদের সাথে সাথে নারীরাও সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আর সেই কারণে ফ্রান্সেস্কো গ্রীক মিথলজির ‘আমাজন’দের সাথে মিলিয়ে ‘আমাজনাস’ নামকরণ করেন।


আমাজন বন কোন দেশে অবস্থিত?

আমাজন নদীর অববাহিকায় অবস্থিত অ্যামাজনিয়া বা অ্যামাজন জাঙ্গল নামে পরিচিত এই বনভূমি দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় বেশিরভাগ অংশ জুড়ে বিস্তৃত। মোট  ৭,০০০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জায়গার মধ্যে ৫,৫০০,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাই আমাজনের দখলে। আমাজন বন এতটাই বড় যে, যুক্তরাজ্য এবং আয়ারল্যান্ড এর মত ১৭ টি দেশের সমান এর আয়তন। এপার বাংলা- ওপার বাংলার সুন্দরবনের মত আমাজন বনের অংশীদার ৯ টি দেশ- ব্রাজিল, বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, কলোম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, গায়ানা, সুরিনাম এবং ফ্রেঞ্চ গায়ানা। এই ৯ টি দেশের মধ্যে আমাজন বনের ৬০% অংশ অবস্থিত ব্রাজিলে, ১৩% পেরুতে, ১০% কলোম্বিয়াতে এবং বাকি ১৭% অংশ অবস্থিত বাকি ৬ টি দেশে।
আমাজন বন
Source: eddiesproject.weebly.com
আমাজন বনের জীবনীশক্তি হল আমাজন নদী, যা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী। প্রায় ১,১০০ টির বেশি উপনদী নিয়ে আমাজন নদী গঠিত যার মধ্যে ১৭ টি নদীর দৈর্ঘ্য ১০০০ মাইলের বেশি। আমাজন বনের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া আমাজন নদী এই বনের বিস্তৃতির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আমাজন বনের ইতিহাস

আমাজন বনের সৃষ্টি হয়েছিল ইওসিন (Eocene) যুগে। বিশ্বব্যাপী যখন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় তাপমাত্রা হ্রাস পায় এবং আটলান্টিক মহাসাগরের বিস্তৃতির ফলে আমাজন বেসিনে উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুর আবির্ভাব ঘটে, তখন আমাজন বনের উদয় ঘটে। কমপক্ষে ৫৫ মিলিয়ন বছর ধরে আমাজন বনের অস্তিত্ব বিরাজমান। ধরে নেয়া হয়, মধ্য-ইওসিন যুগে আমাজন এর নিষ্কাশন অববাহিকা এবং মহাদেশের মধ্যভাগ বিভক্ত হয় ‘পুরুস আর্ক’ দ্বারা। পূর্ব দিকের পানি প্রবাহিত হত আটলান্টিকে এবং পশ্চিমের পানি প্রবাহিত হত আমাজনাস অববাহিকা হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে। আন্দিজ পর্বতমালার উত্থানের সাথে সাথে আরও একটি অববাহিকার সৃষ্টি হয় যার নাম ‘সলিমোয়েস বেসিন’। আর এই অববাহিকা সৃষ্টির কারণে পুরুস আর্ক ভেঙ্গে যায় এবং পূর্ব দিকের প্রবাহের সাথে যুক্ত হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের দিকে প্রবাহিত হয়।

আমাজন বন

আমাজন নদী অববাহিকার এই পরিবর্তন প্রমাণ করে যে, গত ২১,০০০ বছরে বিভিন্ন কারণে আমাজন রেইন ফরেস্ট এর বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। ‘আইস এজ’ এর সময় ‘সাভানা’ বা নিষ্পাদপ প্রান্তরের কারণে রেইন ফরেস্টগুলো কোথাও কোথাও ‘দ্বীপের’ মত করে বিভক্ত হয়ে যায় যার ফলে সেখানে থাকা জীব-বৈচিত্র্যের মাঝেও বিভাজন ঘটে। ‘আইস এজ’ শেষ হয়ে গেলে বিভাজিত অংশগুলো পুনরায় এক হয়ে যায় এবং বিভাজিত প্রজাতিগুলোও আলাদা ভাবে সেই পরিবেশের সাথে যুক্ত হয়। তবে আমাজন বনের কি পরিমাণ পরিবর্তন হয়েছিল তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিতর্কের শেষ নেই। অনেক বিজ্ঞানীদের মতে, উন্মুক্ত তৃণভূমিগুলোর কারণে আমাজন বন অনেকগুলো ছোট ছোট, বিচ্ছিন্ন অংশে হ্রাস পায়। আর আরেক দলের মতে, আমাজন বিভক্ত হয়নি, বরং উত্তর, দক্ষিণ এবং পূর্ব দিকে বিক্ষিপ্তভাবে বৃদ্ধি পায় যেমনটা বর্তমানে দেখা যায়। তবে এই বিতর্কের শেষ কোথায় তা বলা কিছুটা মুশকিল কারণ দুইটি ব্যাখ্যাই বেশ যুক্তি সম্পন্ন এবং সংগৃহীত তথ্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত।

আমাজন বনের জীব-বৈচিত্র্য

আকারের বিশালতার মতই আমাজনের প্রাণীকুল এবং উদ্ভিদকুলের মাঝেও আছে অবিশ্বাস্য বিচিত্রতা। জীব-বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ আমাজন বনে আছে প্রায় ৪০,০০০ জাতের গাছ, ১,২৯৪ জাতের পাখি, ২,২০০ জাতের মাছ, ৪২৭ জাতের স্তন্যপায়ী, ৩৭৮ জাতের সরীসৃপ, ৪২৮ জাতের উভচর প্রাণী এবং ২.৫ মিলিয়ন জাতের পোকামাকড়।
আমাজন বন


অনিন্দ্য সৌন্দর্যের পাশাপাশি বিপজ্জনক অনেক কিছুরই বাস আমাজন জঙ্গলে। চিতাবাঘ, বৈদ্যুতিক ইল, মাংস-খেকো পিরানহা, বিষাক্ত ডার্ট ফ্রগসহ অসংখ্য বিষাক্ত জাতের সাপের বসবাস আমাজন বনে। আমাজনে পাওয়া যায় এমন আকর্ষণীয় এক মাছের নাম ‘পিরারুকু’ যার অপর পরিচিতি ‘আরাপাইমা’ বা ‘পাইচে’। ভয়াবহ মাংস-খেকো পিরারুকু অন্য মাছগুলোকে নিমেষেই খেয়ে ফেলতে পারে এবং এই মাছ ৩ মিটার পর্যন্ত বড় হয়। আর এই মাছের মুখের ভেতরের তালু, এমনকি জিহ্বাতেও দাঁত আছে যার কারণে একে ‘প্রাণঘাতী’ উপাধি দেয়া হয়েছে।

আমাজন বনের মানুষ

আমাজন বনের সাথে মানবকুলের সম্পর্ক বেশ পুরনো। গাছপালা ও জীব-জন্তু ছাড়াও আমাজন বনে প্রায় ৪০০-৫০০ টি  আমেরি-ইন্ডিয়ান আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস। ধারণা করা হয়, এদের মধ্যে প্রায় ৫০ টি আদিবাসী গোষ্ঠীর সাথে বাইরের পৃথিবীর কোন সম্পর্ক নেই। অতীতে আমাজন বনে যে সকল মানুষের বসবাস ছিল তারা প্রচলিত বিশ্বাস এবং কর্মক্ষমতার ভিত্তিতে বিভিন্ন সমাজে বিভক্ত ছিল। তারা কৃষিকাজের জন্য বনের স্থান পরিষ্কার করতো, তৈজস পত্র তৈরি করতো এবং শিকার করতো। ১৬শ শতাব্দীতে আমাজনে ইউরোপিয়ানদের আগমনের ফলে অ্যামাজোনিয়ানদের জনসংখ্যা হ্রাসের কারণ হয়ে ওঠে। গবেষণায় দেখা যায় যে, আমাজনের ১১.৮ শতাংশ জায়গা সেখানকার আদিবাসীদের দ্বারা জীব-বৈচিত্র্যের দিকে লক্ষ্য রেখে অত্যন্ত যত্ন সহকারে তৈরি করা একটি ব্যবস্থাপনা। আমাজনে বসবাসরত বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী তাদের আবাস গড়ে তুলেছিল নদী ঘেঁষা অঞ্চলগুলোতে, যাতায়াত, মাছ ধরা এবং জমির উর্বরতার ভিত্তিতে। কিন্তু ইউরোপিয়ানদের আগমনে তা ব্যাহত হয়। পরবর্তীতে তারা বনের ভিতরের অংশে বসবাস শুরু করে।
বর্তমানে জনসংখ্যা কমে গেলেও বেশ কিছু আদিবাসী এখন আমাজনে বসবাস করে, যদিও পাশ্চাত্যের ছোঁয়ায় অনেকেই এখন আধুনিক। প্রায় সব বাসিন্দা এখন কৃষিকাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে, অনেকে ধাতব পাত্র বানায়, অনেকে পর্যটকদের কাছে হাতের তৈরি জিনিস বিক্রি করে, আর বাকিরা শহর থেকে নিয়মিত প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র এবং খাবার সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে।

আমাজন বন
Source: Cronica del Noa

আমাজন বনের রহস্য

ব্রাজিলিয়ান আমাজনের বুকে বেশ কিছু বৃত্তাকার নকশা দেখতে পাওয়া যায়। নকশাগুলো আজ পর্যন্ত রহস্যে ঘেরা এবং নৃতাত্ত্বিকগণ এই ধাঁধার উত্তরের সন্ধান এখন পাননি। ধারণা করা হয়, নকশাকৃত অংশগুলো সমাধি ক্ষেত্র হিসেবে অথবা সুরক্ষা ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হত। এই নকশার সাথে নাজকা রেখার মিল রয়েছে একটি বিষয়ে- নকশাগুলো কেন সেখানে রয়েছে সেই কারণটি অজানা। আরেকটি ধারণা প্রচলিত যে, প্রাচীন অ্যামাজোনিয়ানরা এই নকশার শিল্পী ছিলেন। তবে প্রশ্ন হল, প্রাচীন লোকেরা এই নকশা আঁকার জন্য যন্ত্রপাতি কোথায় পেল? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়াও কিছুটা কষ্টকর হবে কারণ গবেষণা করে তেমন কোন যন্ত্রপাতির তথ্য পাওয়া যায়নি যা এই নকশা তৈরির কাজে ব্যবহৃত হতে পারে।

বর্তমান আমাজন বন

সারা বিশ্বে যেখানে বৃক্ষ নিধনের খেলা চলছে, আমাজন বনের চিত্রও এর বিপরীতে নয়। আমাজনে বৃক্ষ নিধনের প্রধান কারণ হল বসতি স্থাপন। ১৯৬০ সালের আগে আমাজনের ভিতরে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ ছিল। সে সময়ে যে সকল জমিতে চাষ করা হত সেখানে অতীতের পদ্ধতি প্রয়োগ করা হত। কিন্তু আমাজনের জমিগুলো কেবল অল্প সময়ের জন্যে উর্বর থাকে আর সে কারণে চাষিরা সর্বদা নতুন জমির খোঁজে বন উজাড় করতে শুরু করে। ১৯৭০ সালে শুরু হয় ট্রান্স-অ্যামাজোনিয়ান হাইওয়ে নির্মাণের কাজ- আমাজন রেইনফরেস্টের জন্য যেটা ছিল হুমকি স্বরূপ। তবে সৌভাগ্যবশত হাইওয়ে এর কাজ সম্পন্ন হয়নি যার ফলে আমাজন কিছুটা
হলেও কম দূষণের শিকার হবে। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সালের মাঝে আমাজন বনের উজাড় হওয়া অংশের পরিমাণ ৪১৫,০০০ থেকে বেড়ে ৫৮৭,০০০ বর্গকিলোমিটারে উন্নীত হয়, আর সেই অংশগুলো পরিণত হয়েছিল গৃহপালিত প্রাণীদের চারণভূমিতে।

আমাজন বন








পরিবেশবিদরা আমাজনের এই অবস্থার কারণে অত্যন্ত চিন্তিত। পৃথিবীর ফুসফুস হিসেবে পরিচিত আমাজনের সমৃদ্ধ বৃক্ষরাজি পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের ২০% তৈরিতে ভূমিকা পালন করে এবং বাতাস থেকে কার্বনডাই অক্সাইড গ্রহণ করে। আমাজনে যে হারে বনাঞ্চল নিধন চলছে, তাতে করে আরও দ্রুত বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটার সম্ভাবনা আছে। আমাজন বনকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে ব্রাজিলিয়ান আমাজন বেশ কিছু ব্যয়বহুল উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং আশা করা যায়, তাদের উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

The national flag Cambodia

world map

Schengen Visa Types & Validity- Visa Fees --Travel Insurance-statistics