পেরু ?আছে জনবিরল মরুভূমি, সবুজ মরূদ্যান, বরফাবৃত পর্বতমালা, উচ্চ মালভূমি এবং গভীর উপত্যকা।
পেরু হলো এমন একটি রাষ্ট্র যা আমেরিকার পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকুলে অবস্থিত। এখানে আছে জনবিরল মরুভূমি, সবুজ মরূদ্যান, বরফাবৃত পর্বতমালা, উচ্চ মালভূমি এবং গভীর উপত্যকা। পেরুকে প্রশান্ত মাহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত লিমার প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র ও রাজধানী হিসাবেও বিবেচনা করা হয়।
অতীতে দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তৃত ইনকা সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল এই পেরু। ধারণা করা হয়, ১৬শ শতকে স্পেনীয় বিজেতাদের হাতে ইনকা সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। আন্দেসের স্বর্ণ ও রূপার খনির আকর্ষণে স্পেনীয় খুব শীঘ্রই পেরুকে দক্ষিণ আমেরিকাতে তাদের সম্পদ ও শক্তির কেন্দ্রে রূপান্তরিত করে। পেরু ১৯শ শতকের শুরুতে স্বাধীনতা লাভ করে।
এখনও পেরুর অর্থনীতিতে খননশিল্প প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে। তাছাড়া পেরুর ইনকা সভ্যতার জন্য পর্যটনশিল্পও অর্থনীতির বড় অংশ। বিশেষ করে মাচু পিচু যা আন্দেস পর্বতমালার উপরে অবস্থিত। পেরুর বেশির ভাগ লোক ইনকা বা অন্য আদিবাসী আমেরিকান জাতির লোক। ইনকাদের ভাষা কেচুয়া ভাষা এবং এর সাথে সম্পর্কিত আরেকটি ভাষা আইমারা ভাষা স্পেনীয় ভাষার পাশাপাশি দেশটির সরকারি ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে।
ইনকা সভ্যতা ও এর পতনের ইতিহাস:
এক রহস্যময় সাম্রাজ্য হলো নেটিভ আমেরিকানদের এই ইনকা সভ্যতা। এই সভ্যতা সম্পর্কে আজো লিখিত কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। তবে নানা প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন থেকে এ সভ্যতা সম্পর্কে অনুমান করা হয়। তাদের স্থাপত্যশৈলী ছিল অসাধারণ। মিসরের পিরামিড যেমন আধুনিক মানুষকে বিস্মিত করে, ঠিক তেমনি নান্দনিক ছিল ইনকাদের স্থাপত্যশৈলী। ইনকা সাম্রাজ্য ‘কেচুয়া’নামক নেটিভ আমেরিকানদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যা ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় ৩০০ বছর ধরে রাজত্ব করে গেছে। কেচুয়া জাতির শাসকদের মর্যাদা দেবতাতুল্য বলে তাদের ইনকা বলা হতো। সূর্যদেবকে তারা ইনতি বলে ডাকত এবং সেই নামের প্রতিনিধিত্ব করত ইনকা শাসকরা। একটি উপজাতি হিসেবে বর্তমান পেরুর কোস্কো এলাকায় সুপ্রাচীন ইনকা সভ্যতার সূচনা হয়েছিল। ইনকা সাম্রাজ্য একসময় বিস্তৃত ছিল বর্তমান পেরুর কস্কো ভ্যালি থেকে উত্তরে ইকোয়েডর এবং সুদূর দক্ষিণে বলিভিয়া, চিলি এবং আর্জেন্টিনা পর্যন্ত। পেরুর কুস্কো ভ্যালিকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু মনে করা হচ্ছে বর্তমান প্রত্নতাত্তি্বক অনুসন্ধানকে ভিত্তি করে।
পেরুর কেস্কো অঞ্চলেই উপকথার প্রথম সাপা ইনকা মাংকো কাপাক ১২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে কোস্কো রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে মাংকো কাপাকের উত্তরসূরিদের অধীনে আন্দিজ পর্বতমালার অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীগুলোকে নিজেদের মধ্যে নিয়ে এসে এ রাজ্যটি বিস্তার লাভ করে। ১৪৪২ সালের মধ্যেই রাজা পাচকুতিকের অধীনে ইনকারা তাদের সাম্রাজ্য দূর-দূরান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত করে। পাচকুতিক নামের অর্থই হচ্ছে_ পৃথিবী কাঁপানো মানুষ। তিনিই ইনকা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, যা কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের আগে দুই আমেরিকা মহাদেশের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য ছিল বলে ধারণা করা হয়। ইনকাদের নির্মাণশৈলী খুবই নিখুঁত এবং সাদামাঠা। ইনকাদের সম্রাটরা ডেমিগড মর্যাদার অধিকারী ছিল। স্পা্নীয় দখলদারদের আক্রমণে ১৫৩২ সালে ক্ষমতাধর ইনকা সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায় এবং অনেক পরে তাদের ধ্বংসস্তূপ থেকে ইতিহাসের পাতায় তুলে আনেন একজন উত্তর আমেরিকান এক্সপ্লোরার হায়ার্যাম বিংগাম। ১৯১১ সালে হায়ার্যাম বিংগাম তার ব্যক্তিগত ভ্রমণ অনুসন্ধিৎসা থেকে চলতে চলতে মাচুপিচু দুর্গনগরী, ইনকাদের শেষ আশ্চর্য নিদর্শন আবিষ্কার করেন। যখন তিনি প্রথম সে জায়গাটি খুঁজে পান তখন তিনি অনুমান করতে পারেননি, তিনি একটি মূল্যবান প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু তার সহজাত অনুসন্ধিৎসা তাকে আবার সেখানে ফিরে নিয়ে যায় এবং পরবর্তীকালে পেশাদার প্রত্নতাত্তি্বকদের সহায়তায় তিনি হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের এই সভ্যতাকে আবিষ্কার করেন।
বিধ্বংসী স্প্যানিশ অভিযাত্রীরা বারবার আঘাত হেনেছিল ইনকাদের প্রাচুর্যে। তারা লুটপাট, হত্যাসহ আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে ইনকা সভ্যতার সমৃদ্ধ শহরগুলো। মূলত সেই ধ্বংসযজ্ঞের কারণে ইনকা সম্পর্কে খুব অল্পই তথ্য-প্রমাণ মিলেছে। ১৫২৭ সালে ইনকা সাম্রাজ্যে এক মহামারী দেখা দেয়। সেই মহামারিতে ইনকা রাজা ও তার উত্তরসূরি ছেলে মারা যান। রাজার অন্য দুই ছেলের মধ্যে সিংহাসনের লড়াইয়ে দেশজুড়ে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এদের একজন অ্যাটাহুয়ালপা জিতে গেলেও খুব বেশি দিন টিকতে পারেননি। ১৫৩২ সালে স্প্যানিশ যোদ্ধা ফ্রান্সিস পিজারো তাকে হারিয়ে দেন। পিজারো নামমাত্র রাজা হিসেবে সিংহাসনে বসান অ্যাটাহুয়ালপার শত্রু মানকোকে। নতুন রাজা অবশ্য কখনোই রাজার সম্মান পাননি। তাই প্রতিহিংসায় মেতে উঠে মানকো। ইনকা রাজার সোনার মূর্তি এনে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ভিলকাবাম্বা শহরের পাহাড়ে হারিয়ে যান মানকো ও তার শক্তিশালী সেনারা। এরপর বহু বছর ধরে মানকো ও তার ছেলেদের সঙ্গে ইনকা সভ্যতার সিংহাসন জয় নিয়ে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলতে থাকে স্প্যানিশ যোদ্ধাদের। এর মধ্যে কারও পক্ষেই আর সেই ভিলকাবাম্বা কিংবা ভিটেকাস নামের শহর দুইটিকে গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব হয়নি।
স্প্যানিশ কলোনির মানচিত্রেও শহর দুইটির উল্লেখ নেই। কিন্তু এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে ইনকা সভ্যতার বিশাল রত্নভাণ্ডার। ইনকাদের শেষ রাজা এ শহরেই পুঁতে রেখেছেন অমূল্য ধনসম্পদ। ইনকাদের ধন-সম্পদের আশায় বহু প্রত্নতাত্তি্বক বছরের পর বছর অনুসন্ধান করে গেছেন নিরলসভাবে। ধারণা করা হয়, আপুরিমাক নদীর অববাহিকায় চোককেকিরোই প্রাচীন ভিলকাবাম্বা শহরটি। এ ধারণা নিয়ে আমেরিকান বিশেষজ্ঞ বিংহাম গুপ্তধনের অনুসন্ধান শুরু করেন ১৯০৯ সালে।
বিংহাম ১৯০৯ সালে তার প্রথম অভিযানে বিফল হলেও থেমে যাননি। আবার ইতিহাস ঘেঁটে শুরু করেন দ্বিতীয় অভিযান। পথে দেখা হয় এক ইন্ডিয়ানের সঙ্গে। তার সহযোগিতায় উরুবাম্বা থেকে দুই হাজার ফুট ওপরে এক প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান বিংহাম। তবে এ শহরই যে ভিলকাবাম্বা, সেটার অবশ্য প্রমাণ নেই। ১৯৬৪-৬৫ সালে জেনারেল সাভোয় বিংহামের অভিযাত্রার শেষ থেকে তার অভিযান শুরু করেন। কিন্তু ধন-সম্পদের কিছুই আবিষ্কার করা যায়নি।
তবে এটা ঠিক খুঁজে বের করা গিয়েছিল যে, ইস্পিরিতো পাম্পা শহরটিই সেই ভিলকাবাম্বা। পরে আরেকটি হারানো প্রাচীন শহর আবিষ্কার হয়। কিন্তু কোথাও ইনকাদের ধনসম্পদের দেখা মেলেনি। তবে ইনকা সভ্যতার প্রাচুর্যের ঠিকানা মিলেছে। কিন্তু তাতেও তৃপ্তি মেলেনি। এ শহরগুলো কি ভিলকাবাম্বা? তবে কোথায় ইনকাদের ধন-সম্পদের পাহাড়। ইনকা সভ্যতা আরও নানা কারণে হাজার বছর ধরে মানুষের কাছে এক অপার রহস্যের ভাণ্ডার হয়ে রয়ে গেছে। ইনকা সাম্রাজ্যের পতনের পেছনে দায়ী ছিল স্প্যানিশ দখলদাররা। ১৫৩২ সালে স্প্যানিশ দখলদার ফ্রান্সিসকো পিজারো তারা দলবল নিয়ে ইনকা সাম্রাজ্যে আক্রমণ করে এবং তাদের সম্রাটসহ সবাইকে হত্যা করে। ইনকাদের বন্দুক, কামান জাতীয় আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না বলে তারা সহজেই স্প্যানিশ দখলদারদের হাতে পরাজিত হয়। মাচু পিচু দুর্গ নগরী মেঘাচ্ছন্ন পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত ছিল বলে তা একসময় হারিয়ে যায় মানুষের মন থেকে। সুবিস্তৃত ইনকা সাম্রাজ্য কয়েকজন ইনকা সম্রাটের অধীন ছিল। তারা হলেন টুপাক, ওয়াইনা কাপাক ও পাচাকুটেক।
মহামতী সম্রাট টুপা ১৪৯৩ সাল পর্যন্ত ইনকা শাসন করেছেন। এরপর সিংহাসনে আসীন হন তার উত্তরসূরি সম্রাট ওয়াইনা কাপাক, যিনি সাম্রাজ্য বিস্তারে বেশ মনোযোগী ছিলেন। এর কিছুদিনের মধ্যে অজ্ঞাত কারণে ওয়াইনা কাপাক এবং তার নিয়োজিত উত্তরাধিকার মারা যান। ধারণা করা হয়, ইউরোপীয়দের আমদানিকৃত কোনো সংক্রামক ব্যাধিতে তাদের মৃত্যু হয়। কাপাকের মৃত্যুর পর তার দুই ছেলে উয়াসকার ও আতাউয়ালপা ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় এবং ১৫৩২ সালে আতাউয়ালপা জয়ী হয়ে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তাদের নিজেদের অন্তর্কলহের কারণে তারা ইতিমধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এ সময় স্প্যানীয় দখলদার ফ্রান্সিসকো পিজারো ১৮০ জন সশস্ত্র সৈন্য নিয়ে আবির্ভূত হয় দক্ষিণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় পেরুর উপকূলে। ইনকা রাজধানী কুসকো থেকে দূরবর্তী কাহামার্কা শহরে সম্রাট আতাউয়ালপা সৈন্যদের নিয়ে ক্যাম্পিং করেছেন শুনে পিজারো সেদিকে এগিয়ে যায়। ১৫৩২ সালের ১৫ নভেম্বর পিজারো তার দলবল নিয়ে কাহামার্কায় উপস্থিত হন। তারা সম্রাটের সম্মানে ভোজের আয়োজন করে। সম্রাট দাওয়াত গ্রহণ করলেও পরদিন স্প্যানীয়রা কৌশলে সম্রাট ও তার যোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে এবং সৈন্যদের হত্যা করে। সম্রাট বন্দী হন। সম্রাট বন্দী অবস্থায় স্প্যানিশ ভাষা খানিকটা আয়ত্ত করলেন। এরপর তার মুক্তিপণ হিসেবে দুটি ঘরভর্তি রূপা ও একটি ঘরভর্তি স্বর্ণ দিতে চাইলেন। স্প্যানীয়রা সেই মুক্তিপণ হস্তগত করার পরপরই সম্রাটকে হত্যা করে। কারণ তারা ইতিমধ্যে বুঝে নিয়েছিল তারা স্বর্ণের অবারিত গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে। আতাউয়ালপাকে হত্যার পর সম্রাটের সৈন্যদের সঙ্গে স্প্যানীয়দের যুদ্ধে ইনকা যোদ্ধারা পরাজিত হয়।
এরপর থেকেই বস্তুত সেখানে স্প্যানীয় শাসন শুরু হয়। পরবর্তী বছরগুলোতে স্প্যানীয়রা তাদের ওপর জোরজুলুমসহ ইনকা সভ্যতার বড় বড় স্থাপত্য, মন্দির ও বাড়িঘর ধ্বংস করে দেয়। ইনকা সভ্যতার নিদর্শনগুলো, যা মূলত মূল্যবান ধাতুতে গড়া ছিল তা তারা গলিয়ে ফেলে স্বর্ণ-রৌপ্যের লোভে। এর মধ্যেই স্প্যানীয়রা সম্রাট আতাউয়ালপার ভাই মানকোকে সিংহাসনে বসায়। চলতে থাকে মানকোর পুতুল শাসন। অন্যদিকে লুটেরা স্প্যানিশদের মধ্যে স্বর্ণ-রৌপ্যের ভাগাভাগি নিয়ে হাঙ্গামা বাধে। মানকো তাদের এই হানাহানির সুযোগ নিয়ে পালিয়ে গিয়ে দুর্গম পাহাড়ি এলাকা ভিলকা বাম্বায় আশ্রয় নেন এবং নতুন রাজধানী পত্তন করেন। সেখান থেকে মানকো স্প্যানিশ রেজিমের বিরুদ্ধে গুপ্ত যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। এভাবে কয়েক দশক স্প্যানীয়দের সঙ্গে গুপ্ত যুদ্ধ পরিচালনা করার পর প্রায় চলি্লশ বছর পর ১৫৭২ সালে স্প্যানীয়রা ভিলকা বাম্বার অবস্থান খুঁজে পায় এবং ভিলকা বাম্বাও তারা ধ্বংস করে দেয়। মানকোর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সর্বশেষ ইনকা সম্রাট ও তার শহরের পতন ঘটে।
পিজারোর সৈন্যরা ভিলকা বাম্বা ধ্বংস করলেও মেঘাচ্ছন্ন পাহাড়ের উপত্যকায় নির্মিত মাচু পিচু তারা খুঁজে পায়নি। তাই মাচু পিচু অধরা ও অক্ষত থেকে যায়। কিন্তু এর রহস্যের কোনো কিনারা হয়নি আজও। হয়তো ইনকাদের অস্তিত্বকে জানান দিতেই এই দুর্গ নগরী অক্ষত রয়ে গিয়েছিল। কারণ পিজারো ভিলকা বাম্বার মন্দির থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ পাথুরে নগরী ধ্বংস করে ফেলেছিল। তারা বেছে বেছে স্থানীয় লোকদের সব ধর্মীয় তীর্থস্থানকে ধ্বংস করে। চারশ’ বছর পর ইনকাদের শেষ রাজধানী ভিলকা বাম্বা নগরীর খোঁজ করতে গিয়ে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক হায়ার্যাম বিংগাম ব্যক্তিগত অনুসন্ধিৎসার একপর্যায়ে দুর্গম পর্বত শৃঙ্গের সরু উপত্যকায় মাচু পিচু নগরী খুজেঁ পান ১৯১১ সালে।
মাচু পিচু ইনকাদের রাজধানী কোস্কো থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৩৫০ মিটার (৭৭১০ ফিট) উচ্চতায় মাচু পিচু পবর্তের চূড়ায় অবস্থিত। এটি দক্ষিণ আমেরিকার একটি অন্যতম প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্র এবং পেরুর সবচাইতে আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত।
ইনকাদের সবচেয়ে বিস্ময়কর নগরীর নাম হচ্ছে মাচুপিচু। মাচুপিচু শব্দটি নেটিভ আমেরিকান কেচুয়া জাতির ব্যবহৃত শব্দ। আর এর অর্থ প্রাচীন পর্বত। অধিকাংশ সময় মাচুপিচু নগরী মেঘের আড়ালে ঢাকা থাকে বলে একে মেঘের দেশের নগরী বলে। এমনকি উপর দিয়ে চলাচল করা বৈমানিকদেরও এটি চোখে পড়ে না। মাচু পিচুর এক পাশ চূড়া থেকে একেবারে খাড়া ভাবে ৬০০ মিটার নিচে উরুবাম্বা নদীর পাদদেশে গিয়ে মিশেছে। গিরিখাত ও পাহাড়পর্বতের দ্বারা প্রাপ্ত চমৎকার প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কারণে এই শহরের অবস্থান সামরিক কৌশলগত দিক থেকে গোপনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। উরুবাম্বা নদীর ওপর দড়ির তৈরি সেতু ইনকা সৈন্যদের গোপন প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হত। মাচু পিচুর পশ্চিম দিকে গাছের গুড়ি নির্মিত আরেকটি সেতু ছিল। এই সেতুর মাঝে ৬ মিটার (২০ ফুট) জায়গা ফাঁকা ছিল, প্রয়োজনমত গাছের তক্তা দিয়ে সেতুর দুই অংশকে সংযুক্ত করা যেত। সেতুটির নিচে ৫৭০ মিটার (১৯০০ ফুট) গভীর গিরিখাত, তাই গাছের তক্তা সরিয়ে দিলে কোনও শত্রুর পক্ষে তা অতিক্রম করা দুঃসাধ্য ব্যাপার হত। এই সেতুটি নির্মিত হয়েছিল উরুবাম্বা উপত্যকার ওপর।
নগরটি দুই পাহাড়ের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এখান থেকে নিচের উপত্যকা পরিস্কারভাবে দৃশ্যমান, যা সামরিক দিক সুবিধাজনক অবস্থান। এছাড়া শহরের পেছনের খাড়া পর্বত প্রায় অনতিক্রম্য। মাচু পিচুর পানি সরবরাহ ব্যবস্থা পাহাড়ি ঝরনার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল, যা সহজে বন্ধ করা যেত না। এছাড়াও যে পরিমাণ চাষযোগ্য জমি ছিল তাতে উৎপন্ন ফসলে শহরের মোট জনসংখ্যার চারগুণ মানুষের খাদ্যের সংস্থান সম্ভব ছিল। পর্বতের পাশগুলো ধাপকেটে সমান করা হয়েছিল। এতে একদিকে যেমন চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল, অন্যদিকে খাড়া ঢাল বেয়ে শহরে আসার পথটি আক্রমণকারীদের জন্য দুর্গম করা হয়েছিল। মাচু পিচু থেকে পাহাড়ের ওপর দিয়ে কোস্কো যাবার দুটি পথ আছে, একটি সূর্য দরজা” দিয়ে, এবং অন্যটি ইনকা সেতু” দিয়ে। শত্রুর আক্রমণের মুখে দুটি পথই সহজে বন্ধ করে দেয়া যেত। এই শহরের মূল উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল খুবই শক্তিশালী। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন ২০০৭ সালের ৭ জুলাই মাচুপিচুকে আধুনিক সপ্তাশ্চর্যের একটি বলে ঘোষণা দেয়। মাচুপিচু নগরীটি কোনো ধ্বংসাবশেষ নয় বরং একেবারে অব্যয় ও অক্ষত অবস্থায় কী এক অজ্ঞাত কারণে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। বর্তমান বিশ্বের কাছে ইনকা সভ্যতা বলতে মাচুপিচুর পরিচিতি সবচেয়ে বেশি।
প্রাচীন মাচু পিচু নির্মাণ তথ্য:
মাচু পিচুর প্রায় সকল স্থাপনাই ইনকাদের ঐতিহ্যবাহী নির্মাণ পদ্ধতিতে তৈরি করা। স্থাপনাগুলোর দেয়ালগুলো পাথরের দ্বারা নির্মিত এবং জোড়া দেবার জন্য কোনওরকম সিমেন্ট জাতীয় পদার্থ বা চুন-সুরকির মিশ্রন ব্যবহার করা হয় নি। অ্যাশলার জাতীয় পদার্থর এই নিমার্ণ কৌশলে ইনকারা খুবই দক্ষ ছিল। এই পদ্ধতিতে পাথরের খণ্ড এমন নিখুঁত ভাবে কাটা হত যেন কোন রকম সংযোগকারী মিশ্রণ ছাড়াই পাথরগুলো খাজে খাজে শক্তভাবে একটার ওপর আরেকটা বসানো যায়। ইনকারা পাথরের এই নির্মাণ পদ্ধতিতে পৃথিবীর সেরাদের সেরা ছিল বলে ধারণা করা হয়। তাদের নির্মিত পাথরের দেয়ালগুলোর জোড় এতই নিপুন যে একটা পাতলা ছুরির ফলাও সেগুলোর ভেতর দিয়ে প্রবেশ করানো যায় না।
মাচু পিচুর অন্যান্য স্থাপনাগুলো চুনসুরকির মিশ্রণ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে, তবে ইনকা নির্মাণশৈলীর মান বিচারে সেসব নিম্নমানসম্পন্ন এবং তড়িঘরি করে তৈরি করা হয়েছে। পেরু একটি অতি ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা এবং সিমেন্টজাতীয় মিশ্রণের গাথুনি দিয়ে তৈরি স্থাপনার চাইতে গাথুনি ছাড়া শুধুমাত্র খাজে খাজে পাথর বসিয়ে তৈরি স্থাপনা অনেক বেশি ভূমিকম্পপ্রতিরোধী। ইনকাদের তৈরি দেয়ালগুলোতে বিস্তারিত ভাবে প্রচুর সুক্ষ্ম নকশা দেখা যায় যেগুলো ভূমিকম্পের সময় দেয়াল ধ্বসে পড়া রোধ করে। দরজা এবং জানালাগুলো অসমচুতুর্ভুজ আকৃতির এবং নিচ থেকে ওপরে ক্রমে ভেতরের দিকে হেলানো। কোণাগুলো সাধারণতঃ গোলাকৃতির, ভেতরের দিকের কোণাগুলি মাঝে মাঝে কক্ষের ভেতরে অল্প হেলানো, এবং অনেক জায়গায় ইংরেজি “L” আকৃতির পাথর খণ্ড ব্যবহার করে বাইরের কোণাগুলিকে পরস্পর জোড়া দেয়া হয়েছে। মাচু পিচুর দেয়ালগুলো ওপর থেকে নিচে একদম সোজা নয়; বরং এক সারি থেকে অন্য সারি কিছুটা হেলানো এবং এভাবে দেয়ালগুলোর ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে।
ইনকারা কখনও ব্যবহারিক কাজে চাকার ব্যবহার করে নি। তাই তারা কীভাবে এত সংখ্যক বিশাল আকৃতির পাথর খণ্ড এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে গেছে সেটা এক রহস্যই রয়ে গেছে; যদিও সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, এই বিশার আকৃতির পাথর খণ্ডগুলো পাহাড়ের সমতল ঢাল দিয়ে ঠেলে ওপরে তুলতে তারা শত শত শ্রমিক ব্যবহার করেছিল। এখনও কিছু কিছু পাথরের গায়ে হাতলের মতো গাঁট রয়েছে যা পাথরগুলোকে নির্দিষ্ট স্থানে বসানোর জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। পাথর খণ্ডগুলো জায়গা মতো স্থাপনের পর ইনকারা হয়ত হাতলগুলোকে গুড়িয়ে সমান করে দিয়েছে।
স্থানীয় উপাখ্যান অনুসারে কোনও অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ যদি এই পাথরে তার কপাল ঘসে তাহলে আধ্যাত্মিক জগৎ দেখতে পাবে। ইন্তিউয়াতানা পাথর দক্ষিণ আমেরিকার পূজিত পবিত্র পাথরগুলোর একটি। স্পেনীয়রা ২০ শতকের আগে এই পাথরটি খুঁজে পায় নি; ফলে এটি ইনকাদের অন্যান্য পবিত্র পাথরের মতো ধ্বংস হবার হাত থেকে বেঁচে যায়।
এই পাথরগুলো এমন ভাবে স্থাপন করা হয় যাতে শীতকালে এগুলো সরাসরি সূর্যের দিকে নির্দেশ করে। একে “সূর্যের আকঁড়া বিন্দুও” বলা হয়, কেননা উপকথা অনুসারে এটি সূর্যকে তার জায়গায় আটকে রাখার উদ্দেশ্যে নির্মিত। ২১শে মার্চ ও ২১শে সেপ্টেম্বর, বছরে এই দুবার দিনের মাঝামাঝি সময়ে সূর্য ইন্তিউয়াতানা পাথরের একেবারে ওপরে থাকে; ফলে এর কোনও ছায়া তৈরি হয় না। প্রকৃতপক্ষে ইন্তিউয়াতানা একটি “মহাকাশ ঘড়ি”। এটি ২০০০ সাল পর্যন্ত অক্ষত অবস্থায় ছিল। সেই বছর একটি মদ কোম্পানির বিজ্ঞাপন নির্মাণের সময় ৯৯০ পাউন্ড ওজনের একটি ক্রেন এই পাথরের ওপর পড়ে গেলে কলমের আকারের একটুকরা ভেঙে যায়। কোম্পানিটির দাবী তারা এই ঘটনার জন্য দায়ী নয়। অনেক মানুষ মনে করে এই ঘটনার পর আত্মারা ইন্তিউয়াতানা ছেড়ে চলে গেছে।
আর এখন মাচু পিচু একটি ইউনোস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে বিবেচিত। পেরুর সবচাইতে জনপ্রিয় পর্যটন স্থান ও অন্যতম আয়ের উৎস হবার ফলে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কারণে হুমকির মুখে পড়েছে মাচু পিচু নগরটি। ১৯৯০ সালের শেষের দিকে পেরু সরকার এখানে যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধার জন্য একটি কেবল কার নির্মাণ এবং বুটিক, পর্যটকদের কমপ্লেক্স ও রেস্তোরাঁ সংবলিত একটি বিলাসবহুল হোটেল তৈরির অনুমতি দেয়। প্রতি বছরই মাচু পিচুতে পর্যটক সমাগম বাড়ছে, যা ২০০৩ সালে ৪ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে বলে জানা যায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন