উজবেকিস্তান : লৌহ যবনিকার অন্তরালে

উজবেকিস্তান : লৌহ যবনিকার অন্তরালে



Image result for উজবেকিস্তান map

মধ্য এশিয়ার কাজাখস্তানের পর উজবেকিস্তানই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যে ভরপুর দেশটি। যেমন বিখ্যাত রেশমপথের শহর সমরখন্দ, বুখারা ও খিভা এদেশেই অবস্থিত। রয়েছে মোজাইকে আবৃত অসংখ্য মসজিদ। আছে রেশম পথে চলাচলকরী বাণিজ্যবহরের স্মৃতিবাহী অগণিত ক্যারাভান সরাই। তাছাড়া দেশটির মাটির নিচেও আছে সম্পদের পাহাড়-ইউরেনিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল ভাণ্ডার। আছে সোনার খনিও।


এছাড়া বিশ্বের অন্যতম তুলা রপ্তানিকারক দেশও এটি। এর বাইরে ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও এ দেশের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। তিন কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই দেশটির অবস্থান নতুন স্নায়ুযুদ্ধের ফল্ট লাইনে। ফলে এর সুবিধা নিতে তৎপর রাশিয়া, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের শাসক পরিবারের ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্বের খবর বেশ কয়েকবছর আগে গণমাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছিল।

তখন বলা হয়েছিল এ শুধু দ্বন্দ্ব নয়। রীতিমত নাটক। এ নাটক ছিল ক্ষমতার, হাজার কোটি ডলারের এবং দুর্নীতির। এ নাটকের কেন্দ্রে ছিলেন এক প্রবল একনায়ক। যিনি আপন বজ্রমুষ্টিতে ক্ষমতা আঁকড়ে আছেন গত ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে। আছেন একনায়কের কন্যা, যাকে পরবর্তীতে ক্ষমতার উত্তরসূরী হিসেবে দেখা হয়, আছেন একনায়কের পত্নী যিনি আবার আপন কন্যাকে দেশের পরবর্তী শাসক বানাতে ঘোর বিরোধী। তিনি এ পরিকল্পনাটি ভণ্ডুল করার জন্য হাত মিলিয়েছেন সে দেশের গোয়েন্দাপ্রধানের হাতে। এ হলো উজবেকিস্তান। এ হলো তার শাসক পরিবারের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের রূপরেখা।




বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে দেখা যাক, দেশটি কি ভাবে চলছে। চলুন, যাওয়া যাক, মধ্য এশিয়ার আই ওয়েইওয়েই নামে খ্যাত শিল্পী ভায়াচেস্নাভ ওখুনভের গোপন স্টুডিওতে। ৬৬ বছর বয়সী এই শিল্পীর শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে প্যারিসের বিখ্যাত লমাদু’ সেন্টারে। কাসেলে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ডকুমেন্টো আর্ট শো’তে এবং ভেনিস বিয়েন্নানে। তাঁর একটি বিখ্যাত স্থাপনা শিল্প হচ্ছে নেতার খাঁচা, এতে আছে জেলাখানার মতো লোহার শিকে ঘেরা একটি বাক্যে লেলিনের আড়াই শ’ আবক্ষ মূর্তি।




ওখুনভের স্টুডিওটি উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দের অপেক্ষাকৃত অনুন্নত এলাকায় চার দিকে কমিউনিস্ট যুগের কংক্রিটে তৈরি করা অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক। রাস্তায় কাদা ও জঞ্জাল। অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকগুলোর সিমেন্টের আস্তরণ এখানে ওখানে খসে গেছে। যতোদূর চোখ যায়, এই একই দৃশ্য। শিল্পী ও ওখুনভের গালে উজ্জ্বল ধূসর দাড়ি। কথা বলেন কম। অনেক কথার জবাব দেন মাথা নাড়িয়ে বা ইশারায় শ্রাগ করেন। মুখখানা হাসি হাসি। সেই মানুষটিই তার স্টুডিওর তালা খোলার আগে চোখে বেশ সন্দেহভরা। চোখে একবার একদিক ওদিক তাকিয়ে নিলেন সরকারের কোনো গোয়েন্দা আছে কিনা। সেদিন ওরা কেউ ছিল না। ওখুনভ স্টুডিওতে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, কিছু মনে করবেন না। সব একেবারে যাচ্ছে তাই অবস্থা। ফ্লোর ভেঙে গেছে। বৃষ্টি হলে ছাদ থেকে পানি পড়ে। আসলেই, তবে এছাড়াও বিশৃঙ্খলা আছে। তাহলো শৈল্পিক বিশৃঙ্খলা। দেখা গেল। স্টুডিওর অনেক ক্যানভাস ও ভাস্কর্যে খচিত হয়ে আছে মুসলিম ও খ্রিষ্টীয় প্রতীক। দেয়ালে ঝুলছে হরিণের শিং।





এই হলো উজবেকিস্তানের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীর কর্মক্ষেত্র। শাসকগোষ্ঠীর সমালোচনা করার অপরাধে যার বিদেশ ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাখা হয়েছে। ওখুনভেরের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তিনি রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী কিনা। জবাব দিতে একটু ইতস্তত করলেন এই শিল্পী। বললেন, আসলে আমার ব্যাপারটাই এরকম যে, আমি সবসময় কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরোধী, ইসলাম করিমভ একজন স্বৈরাচারী শাসক। তিনি আমাদের সবাইকে ভয় দেখিয়ে চেপে রেখেছেন। কিন্তু তাতে সব কিছু ভেঙে পড়েছে। শিল্পী ওখুনভ একটুও ভুল বলেননি।





২০১৫ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করিমভ প্রায় ৯০% ভোট ছিনিয়ে নিয়েছিল, ভোটের ফলাফল নিয়ে সে সময় গোপনে উজবেকরা এবং বিশ্বসম্প্রদায় প্রকাশ্যে ব্যঙ্গের হাসি হেসেছিল। এ অবস্থায়ও ওখুনভ নিঃসঙ্গ সারথীর মত প্রতিবাদ করেই যাচ্ছেন কমিউনিস্ট চীনে যেমন ক্ষীণকণ্ঠ ও কোণঠাসা হলেও একটি নাগরিক সমাজ আছে, উজবেকিস্তানে তাও নেই। ফলে ওখুনভ আক্ষরিক অর্থেই নিঃসঙ্গ, একা। তবুও তিনি করিমভের অপশাসনের বিরুদ্ধে ব্লগে লিখে চলেছেন।



আর তৈরি করেছেন স্থাপনাশিল্প। তার একাকীত্ব কতোটা ভয়াল তা তার একটি কথায় বুঝা যায়। তিনি বলেন আমি একটি চিত্র প্রদর্শনীতে গিয়েছিলাম। সেটা ছিল একটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সবাই আমাকে দেখে দূরে সরে যায়। কেউ আমার সাথে হ্যান্ডশেক করার সাহসটি পর্যন্ত করেনি। এই হলো উজবেকিস্তান এ হলো প্রেসিডেন্ট ইসলাম করিমভের দেশ শাসন। শুধু নির্বাচন নয়, দেশ শাসনের সব ক্ষেত্রেই এ অবস্থা।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো মানবাধিকার সংগঠন অসংখ্য অভিযোগ করেছে ইসলাম করিমভের বিরুদ্ধে। তারা বলেন, রাজনৈতিক নিপীড়নের এমন কোনো পন্থা নেই, যা এই শাসক অবলম্বন করেন না। হাত-পায়ের নখ উপড়ে ফেলা, নগ্নদেহে গরমপানি ঢেলে দেয়া এবং ধর্ষণ এসব এখন নিয়মিত ঘটনা। ট্রান্সাপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত একটি দেশের যে তালিকা করেছে, উজবেকিস্তান তারও অন্যতম।




এতো কিছুর পরও ২০১১ সালে ব্রাসেলসে ইসলাম করিমভকে সাদর অভ্যর্থনা জানান ইইউ এর প্রেসিডেন্ড হোমে ম্যানুয়েল ব্যারেসো। আর তাসখন্দে লিয়াঁজো অফিস খোলে ন্যাটো। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ভূমিকাটি পালন করে জার্মানি। এই দেশটি উজবেকিস্তানের বিরুদ্ধে ইইউর একটি অবরোধ নস্যাৎ করে দেয়। ২০০৫ সালে আবিদজানে জনতার বিক্ষোভে গুলি চালিয়ে পাঁচ শতাধিক লোককে হত্যা করে উজবেক সরকার।



এর প্রতিবাদে দেশটির ওপর অবরোধ আরোপ করে ইইউ। কিন্তু তাতে শামিল হতে অস্বীকার করে জার্মানি। ফলে অবরোধ কার্যত ব্যর্থ হয় এবং এক সময় তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে জার্মান সরকার উজবেক সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়। উজবেকিস্তানের তারমিজে একটি সেনা ঘাঁটি ব্যবহারের বিনিময়ে প্রতিবছর দেয় কয়েক কোটি মার্ক।


উল্লেখ্য, উজবেকিস্তানের এই ঘাঁটি ব্যবহার করে আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েন এবং বর্তমানে প্রত্যাহারের সুবিধা পায় জার্মানি। এছাড়াও মধ্য এশিয়ার ওপর দিয়ে প্রাকৃতিক গ্যাস সঞ্চালন লাইন বসানোর পরিকল্পনা চলছে। জার্মানি আশা করছে যে এর সুবিধা তারাও পাবে। উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইসলাম করিমভ আসলেই একজন পাকা খেলোয়াড়। তিনি নিজ পরিবারের সদস্যদের একে অন্যের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে সেটা প্রমাণ করেছেন। স্বদেশ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসিত রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলিশার ইলখামভ বিষয়টিকে বর্ণনা করেন ঠিক এভাবে-উজবেকিস্তানের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সংঘাতকে যদি আপনি একটি বয়ামে (জার) ভরতি মাকড়সার সাথে তুলনা করেন, তাহলে করিমভ এর ক্ষমতার মডেলটি অনুধাবন করতে পারবেন। তিনি মাঝে মাঝেই বয়ামটি খালি করছেন এবং সেখানে নতুন মাকড়সা ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট করিমভের নিজের পরিবারও অবিচ্ছিন্নভাবে এই খেলায় জড়িত। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের ফাঁক গলে যে দু একটি ছোটখাটো খবর বেরিয়ে আসে তাতে জানা যায় প্রেসিডেন্ট করিমভের উত্তরসূরী হবেন তার পরিবারেরই কোনো সদস্য। এক্ষেত্রে ফেবরিট নামটি হচ্ছে প্রেসিডেন্টের কন্যা গুলনারা করিমোতা। গুলনারা লেখাপড়া করেছেন তাসখন্দ ও হার্ভার্ডে তরুণ বয়সে কিছুদিন কাজ করেছেন উজবেকিস্তানের মস্কো দূতাবাসে।




মনে করা হয়, বর্তমানে অনেকগুলো তেল ও তুলা রফতানিকারক কোম্পানিতে তার বিপুল শেয়ার রয়েছে। তিনি পিতার আশির্বাদ পাবেন এমনটাই স্বাভাবিক। শিল্পী ওখুনভ বলেন নিজের অতীতকে ছাড়া এই স্বৈরাচারীর আর ভয় পাওয়ার কিছু আছে বলে মনে করি না। এই শিল্পীর সর্বসাম্প্রতিক শিল্পকর্ম একটি ভিডিও স্থাপনা। তিনি এর নাম দিয়েছেন কানাগালি। প্রশ্ন হলো কানাগলিতে আটকে গেছে কে উজবেকিস্তান, এর জনগণ নাকি শাসকগোষ্ঠী?

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

২০০০ সালে এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৫৯০ দুর্ঘটনার মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে কনকর্ড যুগের।

বাংলাদেশের সকল রাজবাড়ী ও জমিদার বাড়ীগুলির ইতিহাস ও বর্তমান অবস্হা কি (ভিডও সহ )