বিস্ময়ের অলিগলির জলপথ ভেনিসকে নিয়ে গেছে সৌন্দর্যের এক অনন্য মাত্রায়।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
জলে ভাসমান শহর। নীল স্বচ্ছ পানির উপর দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন প্রাচীন প্রাসাদ। প্রাসাদের মাঝে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে নদী। স্বচ্ছ পানিতে তাকালেই প্রাচীন নান্দনিক শহরের প্রতিবিম্ব ভেসে উঠেছে, যেন শিল্পীর নিদারুণ কারুকার্যে আঁকা শহরের প্রতিবিম্ব। বলছি শেক্সপিয়ারের নাটক ‘মার্চেন্ট অব ভেনিসে’র সেই বিখ্যাত শহর অথবা এঞ্জেলিনা জোলি ও জনি ড্যাপের বিখ্যাত ‘দ্যা টুরিস্ট’ সিনেমার সেই শহর। ইতালির ভেনিস নগরী। হলিউড বলিউড সিনেমার হাজারো ছবির, গানের শুটিংয়ে যে শহরের সৌন্দর্য রূপ প্রতিনিয়ত ফুটে উঠেছে, ভূমধ্যসাগরের বুকের সেই শান্তিপূর্ণ রোমান্টিক শহর ইতালির ভেনিস নগরী। ভেনিসের সেইসব দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য সম্পর্কে জানতেই আমাদের এই আয়োজন।
ভে…নি…স – শহরটির নামেই যেন শতাব্দী প্রাচীন এক স্বপ্নময় ছবি জড়ানো, বহুবার বহু ভাবে ইংরেজি থেকে শুরু করে নানা ভাষার চলচিত্রে শহরটিকে এতো বার দেখানো হয়েছে, যে এই শহরের গলি পথ ধরে হাঁটা যেন কোন এক স্বপ্ন পথ ধরে হাঁটার মতো ব্যাপার, স্বপ্ন সত্যি হয়ে যাওয়ার মতো ব্যপার – শহরটির প্রতিটি জলজ গলিপথ গুলো যেন চলচিত্রের সাজানো সেট।
শুধু আধুনিক যুগের চলচিত্র শিল্প মাধ্যম কেন – আঠেরো, থেকে উনিশ শতাব্দীর রোম্যান্টিক যুগের কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদেরও যে প্রেরণা ছিল ভেনিস। Claude Monet ভেনিসের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে, ভেনিস সিরিজ এঁকে ভেনিসের সৌন্দর্যকে যেন আরও গভীর ভাবে প্রকাশ করেছেন। ভেনিস ছিল Monet এর বিখ্যাত ভেনিস সিরিজের প্রেরণা।
আর, তাই পৃথিবীর নানা দিকের টুরিস্টরাও ভেনিসের সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করে নিতে চায়, নিজের চোখে দেখে নিতে চায় এই শহরের রহস্যময় আশ্চর্য সৌন্দর্যকে – ভেনিসের জলপথ ধরে যেমন এই শহর দেখা যায়, তেমনি স্থলের গলিপথ ধরে হেঁটেও এই শহরের ছন্দকে আবিষ্কার করা যায়।
ভাসমান শহর ভেনিস:
ভূমধ্যসাগরের বুকে গড়ে উঠা এই সুন্দরতম ভাসমান শহরের আয়তন ৪১৪.৫৭ বর্গ কিলোমিটার। বিস্ময়ের অলিগলির জলপথ ভেনিসকে নিয়ে গেছে সৌন্দর্যের এক অনন্য মাত্রায়। ১১৮ টি দ্বীপের এই শহরে রয়েছে ১৭৭ টি খাল। প্রতিটি দ্বীপ একে অপরের সাথে সেতু দিয়ে সংযুক্ত। প্রতিটি দ্বীপের সংযুক্তির জন্য রয়েছে ৪০৯ টি সেতু। এমন অনেক দ্বীপ রয়েছে যেখানে পায়ে হেটে যাওয়ার কোন পথ নেই। পানির মধ্যে গেঁথে থাকা সব বাড়ি ঘর। এমন রূপে সজ্জিত এই শহরকে ‘ভাসমান শহর’ ও বলা হয়। ইউরোপের একমাত্র মোটর গাড়িহীন ও একবিংশ শতাব্দীতেও গাড়ির ধোঁয়াহীন শহর এই ভেনিস। নান্দনিক কারুকার্যে খচিত জলযানই এই ভাসমান শহরের একমাত্র যানবাহন।
ভেনিসের নদীতে একমাত্র জলযান।
কথিত আছে, প্রায় ১৫০০ বছর আগে আত্তিলা নামক এক দস্যু বাস করতো অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের উপকূলে। তার দস্যুবৃত্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উপকূলবর্তী জনগণ এই অসংখ্য দ্বীপে ঘেরা জলাভূমিতে এসে ঘরবাড়ি তৈরি করে। যাতে আত্তিলা ঘোড়ায় ছড়ে এই এলাকায় প্রবেশ করে দস্যুবৃত্তি করতে না পারে। সেই দ্বীপপূর্ণ জলাভূমি থেকেই ভেনিসের যাত্রা শুরু।
সিটি অব লাভ এন্ড লাইটস:
মহনীয় ও রোমান্টিক নগরী হিসেবে সকল পর্যটকের পর্যটন তালিকার শীর্ষে রয়েছে সিটি অব লাভ এন্ড লাইটসখ্যাত ভেনিস নগরী। ভেনিস বছরের ৩৬৫ দিনই পর্যটকের ভিড়ে লোকারণ্য থাকে। প্রতিদিন ভেনিসে অবস্থানরত লাখো মানুষের মধ্যে শতকরা ৭৫ ভাগই থাকে দর্শনার্থী।ভেনিসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের লক্ষে পৃথিবীর একেক প্রান্ত থেকে আসা দর্শনার্থী দের জন্য রয়েছে ভেনিসের ঐতিহ্যবাহী নানান স্থাপনা, জাদুঘর, ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট- এসব স্থাপনায় মন ছুঁয়ে যায় আগত দর্শনার্থী দের। এবার আসুন জেনে নেই সেইসব কিছু স্থাপনা এবং দর্শণীয় স্থান ও বস্তু সম্পর্কে-
গ্র্যান্ড ক্যানেল ও রিয়ালটো ব্রিজ:
মাকড়শার জালের মত পুরো ভেনিস জুড়ে চলে গেছে একেকটা সরু খাল। এরই মাঝে শহরকে দ্বিখণ্ডিত করা সেই বিখ্যাত খাল গ্র্যান্ড ক্যানেল। স্থাপনা জগতের এক বিস্ময়। নৌকা, স্পীড বোটের যাতায়াতের পথের এসব খাল থেকে দেখা যায় শহরের চোখ জুড়ানো রঙ, নকশা, স্থাপত্যশৈলীর। খালের উপরে নয়নাভিরাম সব সেতু। একটি সেতুতে সবার দৃষ্টি আটকে যায়, গ্র্যান্ড ক্যানেলের উপরই স্থাপিত বিখ্যাত, জমকালো সেতু রিয়ালটো ব্রিজ। এই সেতুর নিচ দিয়ে নৌকায় যাতায়াত পর্যটকদের অত্যন্ত জনপ্রিয়। সেতু থেকে খালের দৃশ্য যেমন মনোমুগ্ধকর, তেমনি খালের মধ্যে থেকে এই সেতুর কারুকার্য দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়। সেতুর চারপাশ সবসময় লোকারণ্য থাকে। কেউ সেতুর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে, আবার অনেকে সেতুর উপর দাঁড়িয়ে, এর অধিকাংশই অপেক্ষা করে গণ্ডোলায় চড়ে সেতুর নিচ দিয়ে পার হবে বলে।
ভৌজ প্যালেস জাদুঘর:
ভেনিস নগরীর এক গুরুত্বপূর্ণ, আকর্ষণীয় স্থান পিয়াজ্জা সান মার্কো তে অবস্থিত ভৌজ প্যালেস। ভেনিসের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির এক অন্যতম চর্চা কেন্দ্র। প্রাচীন স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত এই ভবন কে ১৯২৩ সালে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। প্রজাতন্ত্রের ঐশ্বর্য প্রদর্শনের এক অন্যতম স্থান এই ভৌজ প্যালেস। এ ছাড়াও ছোট ছোট আরো অনেক পুরনো মনোমুগ্ধকর স্থাপত্য প্রাসাদ, জাদুঘর রয়েছে। এর চারপাশে রয়েছে হরেক রকমের বুটিক, ক্যাফে ও রেস্তোরা।
ট্রেট্টোরিয়া ডি ফার্নি:
বিশ্বের অন্যতম ব্যয় বহুল শহর ভেনিস। প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রেস্টুরেন্ট এর সাথেও নতুন নতুন অনেক ক্যাফে রেস্তোরা রয়েছে এই ভাসমান নগরীতে। ভেনিসের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি রেস্টুরেন্ট ট্রেট্টোরিয়া ডি ফার্নি । এই রেস্টুরেন্ট টি একসময় বেকারি ছিলো। ১৯৭৩ সালে এটিকে রেস্টুরেন্টে রূপান্তরিত করা হয়। ভেনিসের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন সব খাবার, সবরকমের সামুদ্রিক খাবার এখানে পাওয়া যায়। সামুদ্রিক খাবারের মধ্যে শামুক, ঝিনুক থেকে শুরু করে অক্টোপাস, স্কুইড সবধরনের সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়।
মুখোশেরশহর
মুখোশের শহর নামেও পরিচিত ভেনিস নগরী। প্রতিবছর ভেনিসে কার্নিভাল অনুষ্ঠিত হয়। এই কার্নিভাল উপলক্ষে অসাধারণ কারুকার্য খচিত, শৈল্পিক রুচির সমন্বয়ে তৈরি হয় সব মুখোশ। ভেনিসের রঙ বেরঙের মুখোশগুলো জগদ্বিখ্যাত।
গণ্ডোলা ভ্রমণ:
ভেনিসে বসবাস করা প্রতিটি পরিবারের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে। বাড়ির সাথে বাঁধানো থাকে তাদের নিজস্ব নৌকা অথবা স্পীডবোট। ভেনিসের জলযানের একটি আকর্ষণীয় রোমান্টিক জলযান গণ্ডোলা।
নৌকা স্পীডবোটের পাশে যে জলযান টি সকল পর্যটকের দৃষ্টি কেড়ে নেয় তা ভেনিসের ঐতিহ্যবাহী গণ্ডোলা। যুগ যুগ ধরে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও আকর্ষণ বজায় রেখে চলছে বিশ্বের সবচেয়ে রোমান্টিক জলযান বলে খ্যাত গণ্ডোলা। নিদারুণ কারুকার্যে খচিত, শিল্পীর শৈল্পিক চোঁয়ায় দারুণ ভাবে ফুটে উঠা গণ্ডোলায় চড়ে নদীর জ্বলে ভাসতে ভাসতে দেখে নেয়া যায় ভেনিসের পর্যটন কেন্দ্রের প্রধান আকর্ষণ গুলো।
সামুদ্রিক খাবারের শহর:
জলনগরী ভেনিস সামুদ্রিক খাবারের জন্য পর্যটকদের কাছে স্বর্গরাজ্য। যারা সামুদ্রিক খাবার খেতে পছন্দ করেন তাদের জন্য রয়েছে ভেনিসের মাছের বাজারে অথবা রেস্টুরেন্টে সামুদ্রিক মাছের আকর্ষণ। ভূমধ্যসাগরের নানান সামুদ্রিক খাবারের সাথে সাথে আছে সুদূর উত্তর আটলান্টিক থেকে নিয়ে আসা অক্টোপাস, স্কুইডও। এসব সামুদ্রিক খাবার যেমন মাছের বাছারে পাওয়া যায়, তেমনি পর্যটকদের জন্য ভেনিসের রেস্টুরেন্টেও রয়েছে সামুদ্রিক খাবারের সুস্বাদু ব্যবস্থা।
দ্যা ফিনিক্স; ট্র্যাট্টো লা ফেনিস:
পৃথিবী বিখ্যাত অপেরা হচ্ছে ইতালির অপেরা। ইতালির সবথেকে বিখ্যাত অপেরা হাউজ গুলোর মধ্যে একটি এই ভেনিসে অবস্থিত। ট্র্যাট্টো লা ফেনিস প্রাসাদ টি দ্যা ফিনিক্স নামে পরিচিত। পৃথিবীর নানান প্রান্তের পর্যটক রা ভিড় করে এই অপেরা হাউজে ইতালির বিখ্যাত অপেরা শোনার জন্যে। এমন পর্যটক খুব কম পাওয়া যায়, যে ভেনিস গিয়ে অপেরা হাউজে যায়নি।
সেন্ট মার্কোর ক্যাথেড্রাল:
ভেনিসের বিখ্যাত স্থাপত্যের মধ্যে একটি সেন্ট মার্কোয় অবস্থিত ক্যাথেড্রাল। নেপোলিয়ন ক্যাথেড্রালের সামনের বিশাল চত্বরকে ইউরোপের সবচেয়ে সুদৃশ্য ড্রয়িংরুম বলেছিলেন। ক্যাথেড্রালের সিংহ দরজায় শোভা পাচ্ছে হাজার বছর আগে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র ইস্তাম্বুল থেকে লুট করে আনা চারটি অতুলনীয় শৈল্পিক সৌন্দর্যের ধাতব ঘোড়ার ভাস্কর্য। ক্যাথেড্রালের চার দিকের দেয়াল নানান সুসজ্জিত কারুকার্যে খচিত চিত্রকর্ম, অক্ষরে লিপিবদ্ধ নানানকাহিনী।
ফ্যাবরিক্স গিলিয়ানা:
পিয়াজ্জা সান মার্কোর পাশেই ফ্যাবরিক্স গিলিয়ানা। ফ্যাবরিক্স গিলিয়ানায় ভেনিসের সকল ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প কারুকার্যের সবকিছু পাওয়া যায়। হাতের তৈরি শো পীস, ক্যালিগ্রাফি পাওয়া যায়। সারাবছরই এখানে হাতের তৈরি মুখোশের সমাহার থাকে। এছাড়াও ভেনিসের সর্বত্রই রাস্তার পাশেই রয়েছে ছোট ছোট বুটিকের দোকান ও অন্যান্য বিপণী কেন্দ্র, যা খুব সহজেই পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ভেনিসের কাঁচ শিল্প:
ভেনিসের ঐতিহ্যবাহী শিল্পের মধ্যে একটি পৃথিবী বিখ্যাত শিল্প এই কাঁচ শিল্প। গলন প্রক্রিয়ার কাঁচের বাসনপত্র থেকে শুরু করে, এমনকি অপরূপ গয়নাও তৈরি করেন ভেনিসের দক্ষ কারিগর। ফুলদানি, ঝাড়বাতি সহ নানান নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিও কাঁচ দিয়ে তৈরি করেন। কাঁচ শিল্পে ভেনিসের দক্ষতায় মুগ্ধতা অবধারিত।
লিডো দ্বীপ:
লিডো দ্বীপ কে বলা হয় ভেনিসের সোনালি দ্বীপ। পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো চলচ্চিত্র উৎসব ‘ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’ এর আয়োজক এই সোনালি দ্বীপ। এ দ্বীপের সমুদ্র সৈকতে গোধূলি লগ্নের সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করতে পর্যটকরা উপস্থিত হয়।
ভেনিস নগরীর নিরাপত্তা কর্মী পুলিশ বাহিনীও তাদের চলাচলে স্পীডবোট ব্যবহার করে। স্পীডবোটে দ্রুত গতিতে এদিকে ওদিক টহল দিতে থাকে, সাথে যেকোনো প্রয়োজনে দ্রুত গতিতে পৌঁছানোর জন্য স্পীডবোটই একমাত্র যানবাহন।
ভেনিস নগরী ভ্রমণ পিপাসু দের জন্য এক স্বপ্নের শহর। ইউরোপের অত্যন্ত ব্যয়বহুল হলেও এই শহর সকল পর্যটকের স্বপ্নের শহরে পরিণত হয়েছে। ভেনিসের শিল্প সাহিত্য, বিশেষ করে স্থাপত্যশিল্পে যে কারো মন জুড়িয়ে যায়। প্রতিটি ঘর বাড়িও যেন এক একটি নান্দনিক রূপ, রঙবেরঙের কারুকার্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জলের মধ্যে। এ এক সত্যিই অপরূপ জলাভূমির শহর। গ্র্যান্ড ক্যানেলের পাড়ে বসে গোধূলি লগ্নের মৃদু আলো উপভোগ করার জন্য ভেনিস এক অনন্য নগরীতে পরিণত হয়েছে। সব মিলিয়ে ভেনিস যে পর্যটনের এক অনন্য নগরী তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন