পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত ভাস্কর্য ও মায়াবি সৌন্দর্যের প্রতীক-ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার (ব্রাজিল)

পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত ভাস্কর্য ও মায়াবি সৌন্দর্যের প্রতীক-ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার (ব্রাজিল)

পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত ভাস্কর্য ও মায়াবি সৌন্দর্যের প্রতীক-ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার (ব্রাজিল)
ব্রাজিল:
ব্রাজিল নামটির বুৎপত্তি সঠিকভাবে পরিষ্কার নয়। প্রাচীনগতভাবে ধারণা করা হয় ব্রাজিল নামটি এসেছে ব্রাজিলউড থেকে, যা এক প্রকার কাঠ উৎপাদনকারী গাছকে বুঝায়। ব্রাজিলকে বলা হয়, দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র। এছাড়াও জনসংখ্যা ও ভৌগোলিক আয়তনের দিক থেকে এটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম দেশ হিসেবে বিবেচিত। আর এ দেশটিই হচ্ছে আমেরিকার একমাত্র পর্তুগিজভাষী দেশ, এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ পর্তুগিজভাষী রাষ্ট্র। ব্রাজিলের পূর্বভাগ সরাসরি আটলান্টিক মহাসাগর দ্বারা বেষ্টিত রয়েছে।
এই ব্রাজিলেই রয়েছে পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত ভাস্কর্য ও মায়াবি সৌন্দর্যের প্রতীক-ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার। যেটি মানবজাতির শ্রেষ্ঠ উদ্ধারকর্তা ‍যিশুমুর্তি হিসাবে ব্যাপক-ভাবে পরিচিত। চলুন জেনে নেই, ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার এর সম্পর্কে কিছু জানা-অজানা তথ্য:
ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার অবস্থান:

ব্রাজিলের দক্ষিণ-পূর্বের একটি প্রধান শহর হলো রিউ দি জানেইরু। আর এটি হলো এ শহরের রাজধানী। শহরটি এক-সময়ে ব্রাজিলের অর্থাৎ(১৭৬৩ খেকে ১৯৬০)সালে এবং পর্তুগিজ সাম্রাজ্যের (১৮০৮ খেকে ১৮২১) খ্রিষ্টাব্দে রাজধানী ছিল। শহরটি শুধুমাত্র “রিউ” নামেই বেশি পরিচিত। আর এ ক্রাইস্ট দ্য রিডিমারটি অর্থাৎ যিশুমুর্তিটি “রিউ” শহরের ‍তিজুকা ফরেস্ট ন্যাশনাল পার্কের কর্কোভাদো পহাড়ের চূড়ায় স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে। যিশুমুর্তিটি এখন ব্রাজিলীয় খ্রিস্টান ধর্মের একটি প্রতীক যা রিউ দি জানেইরু এবং ব্রাজিলের জন্য একটি প্রতিমায় পরিণত হয়েছে। মুর্তিটিকে বিশ্বের বৃহত্তম আর্ট ডেকো মূর্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যা কিনা বিশ্বের নতুন সপ্তাশ্চর্যের একটি।
ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার ইতিহাস:
“রিউ” শহরটিকে আড়াল করে রাখা ৭০০ মি:(২২৯৬ ফুট)উচ্চতার কর্কোভাদো পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই মূর্তিটির ভাস্করক ছিলেন ফ্রান্সের পল ল্যান্ডোস্কি। ব্রাজিলের প্রকৌশলী হেইতর ডা সিলভা কস্তা এর তত্ত্বাবধানে এবং ফ্রান্সের প্রকৌশলী আলবার্ট কেকোয়াত এর সহযোগিতায় মূর্তিটি ১৯২২ থেকে ১৯৩১ সালের মধ্যে নির্মিত হয়।
রাজকুমারী ইসাবেলের সম্মানে ক্যাথলিক যাজক পেড্রো মারিয়া বস কর্কোভাদোর উপরে একটি বড় মূর্তি নির্মাণের প্রস্তাব দেন ১৮৫০ সালে। কিন্তু ব্রাজিলে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর এ প্রকল্পটি সফল হতে পারেনি। পরবর্তিতে রিও-র ক্যাথলিক সার্কেলরা ১৯২০ সালে আবারও দ্বিতীয়বারের মতো পাহাড়ে একটি ল্যান্ডমার্ক মূর্তি বানানোর প্রস্তাব দেয়। তারা একটি ইভেন্টের আয়োজন করে যেটি “Semana do Monumento” (Monument Week) বা ভাস্কর সপ্তাহ নামে পরিচিত ছিলো বলে জানা যায়। আয়োজকদের লক্ষ্য ছিলো দাতা ও স্বাক্ষর সংগ্রহ করা যেটি কিনা মূর্তিটি নির্মাণে সহায়তা দিবে। আর এ দানের অধিকাংশই ক্যাথলিকদের কাছ থেকে এসেছিলো। তাদের প্রস্তাবনা ছিলো, মূর্তিটি যীশু খ্রিস্টের হবে এবং সেটি খ্রিস্টানদের “ক্রস” প্রতীককে তুলে ধরবে। আর যীশুর হাতে থাকবে একটা গ্লোব এবং নিচে একটি ভিত্তি যেটি আমাদের পৃথিবীকে চিহ্নিত করবে। কিন্তু পরবর্তীতে প্রসারণ করা হাতের ধারণাটি গ্রহণ করা হয় শান্তির প্রতীক হিসেবে।
ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার এর নির্মাণ তথ্য:
রেইনফোর্সড কংক্রিট ও শ্বেত পাথর এবং মানব হাত দ্বারা নির্মিত ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১৯২২ সালে এবং এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিল ১৯৩১ সালে। মূর্তিটি তার ৮ মিটার (২৬ ফুট) ভিত্তি ছাড়াই ৩০ মিটার (৯৮ ফুট) উঁচু। মূর্তিটি দুই পাশে হাত প্রাসারিত করে দাঁড়ানো। তার এই প্রসারিত হাত দুটির মোট দৈর্ঘ্য ২৮ মিটার (৯২ ফুট)। মূর্তিটির সর্বমোট ওজন ৬৩৫ মেট্রিক টন। যে ভিত্তিটির উপর মূর্তিটি স্থাপন করা হয় তারই উচ্চতা ৬ মিটার বা ২০ ফুট। মূর্তিটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন যিশু তার দুই হাত প্রসারিত করে শহরটিকে আলিঙ্গন করছেন। মূর্তিটি তৈরীর উদ্দেশ্য ছিল পর্তুগালের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের প্রথম শতবার্ষিকী উদযাপন করা। এছাড়া ব্রাজিলের খ্রিস্ট ধর্মের প্রতীক এই মূর্তিটি রিও ডি জেনিরো এমনকি ব্রাজিলেরও অন্যতম প্রতীক।
মূর্তিটি বানানাতে খরচ হয় ২ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার (২০১৫ সালে যার পরিমাণ হয় ৩৩ লাখ মার্কিন ডলার। ৯ বছর ধরে নির্মাণকাজ শেষে ১৯৩১ সালের অক্টোবরের ১২ তারিখ মূর্তিটি সবার জন্যে উন্মুক্ত করা হয়। উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে মূর্তিটিকে ফ্লাডলাইটের আলোয় আলোকিত করা হয় ৫,৭০০ মাইল (৯,২০০ কিলোমিটার) দূরের রোম থেকে মারকোনির উদ্ভাবিত দূরনিয়ন্ত্রিত শর্টওয়েব রেডিও দ্বারা।
ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার এর সংস্কার তথ্য:
১৯৯০ সালে মূর্তিটি সংস্কারের কাজ হাতে নেওয়া হয়। কয়েকটি সংস্থা মূর্তিটি সংস্কারের কাজের জন্যে চুক্তি করে, সেগুলি হলো Archdiocese of Rio de Janerio, মিডিয়া কোম্পানি Rede Globo, তেল কোম্পানি Shell do Brazil, পরিবেশ নিয়ন্ত্রক সংস্থা IBAMA, National Institiute of Historic and Artistic Heritage এবং রিও ডি জেনিরো স্থানীয় সরকার। ২০০৩ সালে পাহাড়ের চূড়ায় সহজে পৌঁছানোর জন্য সুবিধার্থে চলন্ত সিঁড়ি, হাঁটাপথ ও লিফট যুক্ত করা হয়েছে।
২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারীর ১০ তারিখে মূর্তিটি বড় ধরণের বজ্রপাতের শিকার হয়। এর ফলে মূর্তিটির আঙ্গুলগুলি, মাথা এবং ভ্রু ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যাপকভাবে। রিও ডি জেনিরো সরকার মূর্তিটি সংস্কারের ব্যবস্থা হাতে নেয়। ২০১০ সালে মূর্তিটিতে বড় ধরণের সংস্কারের কাজ করা হয়। এটিকে ধোয়া হয়, প্লাস্টার ও শ্বেত পাথরগুলি প্রতিস্থাপন করা হয় নতুনভাবে। পানি নিরোধী এবং নতুন করে রং করা হয়। মাথা এবং বাহুতে থাকা লাইটগুলি মেরামত করা হয়। তাছাড়া মূর্তিটির পাদদেশে নতুন লাইটও স্থাপন করা হয়। প্রায় চার মাস ধরে এই সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত হয়।
ব্রাজিলের যীশু খ্রিস্টের এই মূর্তিটি দেখতে প্রতি বছর ১৮ লাখের মতো পর্যটক ব্রাজিল যাতায়াত করে। পর্যটকের এই সংখ্যাটি দিন দিন বেড়েই চলেছে। ২০১১ সালের ইস্টারের দিনে রেকর্ড করা ১৪ হাজার পর্যটক সেখানে উপস্থিত হন। ২০১৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের সময়েও অনেক পর্যটক সেখানে ভিড় জমিয়েছিলেন। ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিকে এর থেকেও প্রচুর পর্যটকের সমাগম ঘটবে বলে রিও ডি জেনিরো সরকার আশা করছে বলে জানা যায়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

২০০০ সালে এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৫৯০ দুর্ঘটনার মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে কনকর্ড যুগের।

বাংলাদেশের সকল রাজবাড়ী ও জমিদার বাড়ীগুলির ইতিহাস ও বর্তমান অবস্হা কি (ভিডও সহ )