ঐতিহ্যে মোড়া হাওরের গান-হাওর টানে পর্যটনে

হাওর টানে পর্যটনে

কেউ যদি সমুদ্র ভালোবাসে, ভালোবাসে সমুদ্রের পানি, তাহলে ভালোবাসতেই হবে হাওর। হাওরের পানি। ভাষা বিজ্ঞানীরা বলেন- হাওর সমুদ্রের প্রতিরূপ। হাওর শব্দের উৎপত্তিও সাগর থেকে। কেননা সাগরের সব রূপ বৈশিষ্ট্য হাওরের মাঝে পাওয়া যায়। সাগর থেকে সায়র আর সায়রের অপভ্রংশ হাওর হয়েছে বলে মনিষিরা বলে থাকেন।
হাওর হলো একটা বিশাল চ্যাপ্টা বাটির মতোন বেসিন বিশেষ। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে হাওরের ঋতু আসে দু’টি। বছরের ৫ থেকে ৬ মাস হাওরে থাকে বর্ষাকাল। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠে শুরু হওয়া বর্ষাকালের সমাপ্তি হয় আশ্বিন-কার্তিক মাসে। শীতকাল ও বর্ষাকালের দু’রূপের হাওর একটি অপরটির প্রতিরূপ।
বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্রায় ২৫% এলাকা জুড়ে রয়েছে হাওরের অবস্থান। উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় ৭টি জেলা যেমন- নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অংশ বিশেষ নিয়েই হাওরাঞ্চলের অবস্থান। বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড এর তথ্য অনুযায়ি বাংলাদেশে হাওরের সংখ্যা ৪১৪টি। আবার এর সাথে দ্বিমত পোষণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে এর সংখ্যা ৪২৩টি।
‘অষ্টগ্রাম, মিঠামইন, ইটনা খালিয়াজুড়ির বড় হাওর, অষ্টগ্রামের সুমাই হাওর, বাজিতপুরের হুমাই, মিঠামইনের বাড়ির হাওর, বাজিতপুর নিকলী সুরমা হাওর, সুনামগঞ্জের শনির হাওর, সিলেট ও মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর, নেত্রকোনার জারিয়া হাওর, ছিলনীর শাপলা ও পাতলা বোড়া হাওর, নুরপুর ও কাতিয়ার কোনা হাওর, এলংজুরির চিমনীর হাওর, ইটনার বনপুর হাওরসহ এদেশে যে সকল ছোট-বড় হাওর রয়েছে তা প্রায় ৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার।
দুই ঋতুর অপরূপ বৈশিষ্ট্য ধরে রাখা হাওরের রূপ সাগর অবগাহনের অপার সম্ভাবনা হাতছানি দিয়ে ডাকবেই। এই আট হাজার বর্গ কিলোমিটার জোড়া হাওরের টান অস্বীকার করার স্পর্ধা কারো নেই। হাকালুকি হাওরের কথাই ধরা যাক। এই হাওরেই রয়েছে ছোট বড়ো মিলে ২৪০টির মতো বিল। আর নদীর অবস্থান ছোট বড় মিলে ১০টি। এই হাওর বর্ষাকালে ১৮ হাজার হেক্টর এলাকায় পরিণত হয়। এই হাওরের প্রশস্ততা এতো বেশি যে, মৌলভীবাজার জেলায় ৪০%, কুলাউড়ার ৩০%, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের ১৫%, গোলাপগঞ্জের ১০% এবং বিয়ানীবাজারে ৫০% এলাকাজুড়ে এর গঠন। 
হাওরের উত্তরে ভারতের মেঘালয় পাহাড় এবং পূর্বে ত্রিপুরা পাহাড়ের পাদদেশ। হাওরটি ৫টি উপজেলা ও ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে অবস্থিত। উল্লেখযোগ্য বিলগুলি হলো- চাতলা বিল, চৌকিয়া বিল, ডুলা বিল, পিংলার কোনা বিল, ফুটি বিল, তুরাল বিল, তেকুনি বিল, পাওন বিল, জুয়ালা বিল, কাইয়ার কোনা বিল, বালিজুড়ি বিল, কুকুর ডুবি বিল, কাটুয়া বিল, বিরাই বিল, রাহিয়া বিল, চিনাউরা বিল, দুধাল বিল, মায়াজুরি বিল, বারজালা বিল, পারজালা বিল, মুছনা বিল, লাম্বা বিল ও দিয়া বিল। তাইতো বর্ষায় চতুর্দিকে থৈ থৈ করা পানি দেখলেই মনে হয় যেনো বর্ষার পানি জমে ধরেছে সাগরের রূপ। শুধু সাগরের পানির ফুলে উঠা ও আছড়ে পড়াকে আমরা ঢেউ নামে ডাকি। আর হাওর পারের মানুষ হাওরের ঢেউকে আফাল নামে এই যা পার্থক্য। বর্ষাকালে হাওর এলাকায় থাকা গ্রামগুলোকে মনে হয় দূরে দূরে গজিয়ে ওঠেছে ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জ। আর গ্রামবাসীর ঘরগুলোকে মনে হবে যেনো পানির ওপরে ভাসমান এক একটি কন্টেইনার। সমুদ্রে সূর্য ওঠা সূর্য ডুবা দেখা যায়, হাওরও ব্যতিক্রম নয়। হাওরের সূর্য ওঠা এবং সূর্য ডুবা দেখলেও মনে হবে এই বুঝি সমুদ্রে চলে এলেন। হাওরের সাথে সমুদ্রের পার্থক্য হলো-সমুদ্রের গভীরে সাঁতার কাটা যাবে না। ডুব দেওয়া, মাছ ধরা অথবা সারাটি সমুদ্র ঘুরা যাবে না। কিন্তু হাওরে যাবে। ইচ্ছে করে যদি পানির মধ্যভাগে সাঁতার কেটে পাঁতি হাঁসের সাথে বাজি ধরা যায়। কেননা বর্ষকালে পানির গভীরতা হয় ২ থেকে ৬ মিটার। যদি ইচ্ছে করে মাছ শিকারীর সাথে টং ঘর বানিয়ে বান্দইরা জাল সহ বিভিন্ন পদের জাল, বড়শি অথবা অমাবশ্যার রাতে টেটা বা কোছ দিয়ে মাছ শিকার দেখারও অপার সুযোগ হাতছাড়া হয় না।
শীত মৌসুমে সারা দিগন্ত জুড়ে মাঠের পর মাঠ সেজে ওঠে, যেনো সবুজ আর সবুজের কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে কেউ। এখানে আবার ধানের ক্ষেত হাওয়ায় হাওয়ায় মাথা দোলায়। এ যেনো এক অপরূপ রূপে সেজেছে বাংলার প্রকৃতি। শুধু তাই নয়, শীতের হাওরের দিগন্ত জুড়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য ও বিলের কান্দিগুলো দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়। চতুর্দিকে গজিয়ে ওঠা সবুজ ঘাস গালিচায় মোড়া থোড়া-থোড়া উঁচুভূমি বিলের পানিতে প্রতিচ্ছবি পড়ে সৃষ্টি করে এক অপরূপ দৃশ্যাবলির। এছাড়াও শীত এলে সাইবেরিয়া ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান হতে পাখি এসে মেলা বসিয়ে দেয়, পাখিদের মেলা। যেনো কতো মায়াবি পাখিগুলো। বড়ো আত্মীয়, বড়ো বন্ধু বৎসল-আমাদের অতিথি পাখি। সেই প্রাচীন কাল থেকেই পাখিরা খাবার সন্ধানে আসে হাওরে। তাই হয়তো প্রাচীন গাছ পাঠে জানা যায়-পূর্ববঙ্গের নাম উড়া পাখির দেশ। 
এখনো আদর করে হাওরকে অনেকেই উড়া পাখির দেশ নামে ডাকে। শীত এলেই এক হাকালুকির হাওরেই সুদূর সাইবেরিয়া থেকেই প্রায় ২৫ প্রজাতির পাখি আসে। সাথে আছে আরো ১০০ জাতের পাখি। আবার সারা বছরের বাড়ি তৈরি করে থাকে চখা চখি, বক, শামুক, রাজসরালি, গরাদ মালা, রাজহাঁস, ধলা বেলে হাঁস, গাড়ওয়াল, ইউরেসীয়, সিথী হাঁস, টিকি হাঁস, পাঁতি হাঁস, ম্যার্গেঞ্জার ছাড়াও দেশি প্রজাতির বেগুনি, কালেম, পানমূরসী, পাতিকুট, ডাহুক, মুরগি চ্যাগা, ল্যাঞ্জা চ্যাগা, ভুবন চিল, শঙ্খ চিল, কুড়াল, ঈগল, রাঙা চ্যাগা, জলাপিপি, ময়ুর লেজা পিপি, পাতিজিরিয়া, হাট্রিটি, বড় খোপা, ডুবুরী পানকৌড়ি, শামুক খোল সহ নানান ভিন্ন অভিন্ন প্রজাতি। 
হাওরে এলে কান পেতে দিতে হয়। মন পুঁতে দিতে হয় প্রকৃতির কাছে। এখানে এলে শোনা যায় সন্ধ্যা বেলা পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার কল কাকলি। এখানে এলে দেখা যায় শীত সকাল আর শীত বিকালে আকাশের উদর ঢেকে দেওয়া পাখিদের শরীর। এজন্য হাওরকে ঘিরে মানুষের আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। বেশি দিন আগের কথা নয়। নব্বই দশকের শুরুর দিকে হাতে গুনা কিছু ভ্রমণ বিলাসী মানুষের পদভারে নত হয় হাওর অঞ্চল। এর পর থেকে আর থেমে থাকেনি হাওরে মানুষের পদভার। ২০০০ সালের দিকে অনাকাক্সিক্ষত ভাবে বাড়তে থাকে আরো বেশি মানুষের আনাগুনা। 
আর এই মানুষরাই জাগিয়ে তোলে আরো কিছু মানুষের চেতনা। যাকে আমরা হাওরবাসি মানুষ বলে জানি। তারা দাবি তোলেন- হাওরাঞ্চলের জন্য অচিরেই দরকার পর্যটন কর্পোরেশনের সুনজর। এ জন্য দরকার হাওরাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য উন্নত যানবাহন। পর্যটকদের জন্য রাত্রি যাপনের নিরাপদ ব্যবস্থা ও আশ্রয় দান। কারণ রাতের হাওর আরো বেশি সুন্দর। আকাশ আর চাঁদের সাথে মিতালী ঘটিয়ে কেটে যায় রাত। বিভিন্ন পয়েন্টে গড়ে তুলতে হবে ভালো ভালো হোটেল মোটেল। নৌ-বিহারের জন্য ছোট-মাঝারি এসি-নন এসি নৌযান। পর্যটকদের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে সুস্থ বিনোদনের। এজন্য পেশাদার শিল্পী দিয়ে আমাদের দেশীয় লোকসংস্কৃতি তুলে ধরতে হবে। 
ঐতিহ্যে মোড়া হাওরের গান- যেমন, যাত্রাগান, পালাগান, বাউল গান, কীর্তন, গাজির গান, ঘেটুগান, ভাটিয়ালীগান, ধামাইলগান, মালসিগান, বারোমাসি গানের সাথে করিয়ে দিতে হবে পরিচয়। হাওরের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ব্যাপারে প্রচারণা চালাতে হবে বেশি বেশি। পর্যটকদের বুঝাতে হবে যে, সমুদ্র দেখতে হলে খালি কক্সবাজার, পতেঙ্গা নয়- হাওরেও সমুদ্রের স্বাদ নেওয়া যায়। উঁচু করে দিতে হবে- হাওরের বুক চিরে বহমান সর্পিল মেঠো পথ। দেখাতে হবে বড় বড় হাওরের মাঝে মাঝে কচুরিপানার মতো ভাসমান দ্বীপ গ্রাম। আর কাকে চক্ষুর মতো কালো কালো জলরাশির মাঝখানে ভাসমান দ্বীপের ছবি। আরো দেখাতে হবে- পুঁটি মাছ ঠোকর দেবার আশায় এক পায়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমান বকের সারি। মাছ নিয়ে কাড়াকাড়ি গাঙ্গচিলের। পানকৌড়ির ডুব। মেঘমুক্ত দিগন্ত ছোঁয়া নীল আকাশ। সন্ধ্যাবেলায় মুক্তো ডানা মেলে জংলি পাখির ওড়াওড়ি।
পর্যটকদের জানাতে হবে ময়মনসিংহ গীতিকার চারণভূমি হাওর। হাওরের আলো বাতাস, জলজ পরিবেশ ও বর্ষার অফুরন্ত অলস সময় মানুষকে কিভাবেই বা ভাবুক করে তুলে? কিভাবে জন্ম নেয় চারণ কবি গীতিকার, সুরকার আর বাউল মনীষীর? ভাটি অঞ্চলের বীর ঈষাখার মতো স্বাধীনচেতা মানুষ বা সাধক শাহ আব্দুল করিম, হাসন রাজার মতো মহামনীষীদের কেনই বা ধরে রেখেছিলো হাওর অঞ্চল। মাত্র কয়েক লক্ষ নৃ-গোষ্ঠির জন্য উপজাতি কালচারাল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে তাকে লালন পালন ও টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। ড. দিনেশ চন্দ্র বা ড. হুমায়ুন আহমেদ হাওরের কালচারাল খনি থেকে কিছু সংগ্রহ করতে পারলেও এখনো ১০০ গুণিই বাকি রয়ে গেছে, এগুলো উদ্ধার করে সংগ্রহ করতে হবে। হারিয়ে যাওয়া পানামি নৌকা হয়তো ফিরিয়ে আনা যাবে না কিন্তু বড় বড় গয়না নাও, ট্রলার বা লঞ্চ বা স্টিমার জাতীয় খুব কম শব্দের জলযান বাড়াতে হবে। আমরা চাই দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব হাওরকে পর্যটনের আওতায় এনে হাওরের প্রতি মানুষের নির্ভেজাল টান বাড়িয়ে তোলা হোক।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

২০০০ সালে এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৫৯০ দুর্ঘটনার মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে কনকর্ড যুগের।

বাংলাদেশের সকল রাজবাড়ী ও জমিদার বাড়ীগুলির ইতিহাস ও বর্তমান অবস্হা কি (ভিডও সহ )