ভানতাসেল: ঢাকার আকাশে প্রথম উড়েছিলেন যিনি


ভানতাসেল: ঢাকার আকাশে প্রথম উড়েছিলেন যিনি

১৮৯২ সাল, তখনও উড়োজাহাজ আসেনি। কিন্তু বেলুন নামের আশ্চর্য এক জিনিসে চড়ে মানুষ আকাশে ওড়ার স্বাদ নিতে শুরু করেছে। এমনই এক প্রেক্ষাপটে ঢাকার আকাশে প্রথমবারের মত উড়েছিলেন জিনেট ভানতাসেল নামের এক মার্কিন তরুণী। বেলুনে চড়ে মানুষকে আনন্দ দেয়াই ছিল যার পেশা। ঢাকায় এসে করুণ পরিণতি হয় তার। হাসন রাজার ছেলে গণিউর রাজার ডায়েরী থেকে এ সম্পর্কে জানা যায়।

বেলুনে ওড়া শুরু যেভাবে
বেলুনের মাধ্যমে আকাশে ওড়া প্রথম শুরু হয়েছিল ১৭৮২ সালে, ফ্রান্সে। দ্রুতই ইউরোপজুড়ে তা ছড়িয়ে পড়ে। আটলান্টিক পেরিয়ে আমেরিকায়ও সাড়া জাগায় বেলুনে চড়ে আকাশে ওড়ার এ পদ্ধতি। বলতে গেলে বেলুন ম্যানিয়া তৈরি হয়। কেউ হাইড্রোজেন বেলুন নিয়ে ওপরে ওঠে আবার কেউ হট এয়ার বেলুন নিয়ে। কে বেশি ওপরে উঠতে পারে বা বেশি সময় আকাশে থাকতে পারে সে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়।

হাইড্রোজেন বেলুন বনাম হট এয়ার বেলুন
হাইড্রোজেন বাতাসের চেয়ে হালকা। তাই বেলুনটা হাইড্রোজেন গ্যাস-পূর্ণ করলে সেটা ভেসে থাকে। তবে হাইড্রোজেন দাহ্য বা সহজে আগুন ধরে যায়। তাই এখন হিলিয়াম গ্যাস ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের বেলুনে বেশি সময় ভেসে থাকা যায়।

হট এয়ার বেলুনের ক্ষেত্রে একটি বার্নার বা চুলার সাহায্য জ্বালানি পুড়িয়ে ধোঁয়া তৈরি করা হয়। এই ধোঁয়া আটকে রাখা হয় বেলুনে। বার্নার জ্বলতে থাকে, এক পর্যায়ে বেলুন ওপরের দিকে ভেসে ওঠে। এরকম বেলুন পরিচালনা তুলনামূলকভাবে সহজ।
প্রথম দিকে বেলুন আকাশে ওড়ালেও দড়ি দিয়ে ভূমির সাথে আটকে রাখা হত যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়।

প্রথম দিকের কথা
১৭৮৫ সালে ফরাসী পদার্থবিজ্ঞানী রজার বেলুনে চড়ে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার উদ্যোগ নেন। তিনি হট এয়ার বেলুনের ওপর হাইড্রোজেন ভর্তি একটি বেলুন যুক্ত করেন। কিন্তু হাইড্রোজেনে আগুন ধরে যায়। রজার এবং তার কো-পাইলট মারা যায়। পরবর্তী ২০০ বছরে এ পদ্ধতির ব্যবহার খুব একটা হয় নি।

একই বছর অর্থাৎ ১৭৮৫ সালে জিন পিয়েরে ব্লানচার্ট এবং জন জেফ্রিস বেলুনে চড়ে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে সক্ষম হন। ব্লানচার্টই ১৭৯৩ সালে ফিলাডেলফিয়ায় বেলুন উড্ডয়নের মাধ্যমে আমেরিকায় বেলুন উড্ডয়ন শুরু করেন। ১৮৩৬ সালে ৮৫,০০০ ঘনফুটের একটি বিশাল বেলুন ১৮ ঘণ্টা ধরে ৫০০ মাইল উড়ে লন্ডন থেকে জার্মানির ভিয়েলবার্গে পৌঁছে।
বেলুন যেভাবে কাজ করে
ব্যাগটি সিল্ক, রাবার বা অন্য কোন উপযোগী পদার্থে তৈরি করা হয় যা বাতাস আটকে রাখতে পারে। বাতাসের চেয়ে হালকা গ্যাস-পূর্ণ এই ব্যাগের নিচে একটি ঝুড়িতে মানুষ থাকতে পারে।

হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, মিথেন, অ্যামোনিয়া, প্রাকৃতিক গ্যাস কিংবা কয়লা বা পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য থেকে তৈরি গ্যাসের মাধ্যমে বেলুন উড্ডয়ন করা হয়।

শুরুতে স্রেফ বিনোদনের জন্য ব্যবহার হলে পরে নানা ধরনের ব্যবহার শুরু হয়:

সামরিক কাজে
উনিশ শতক থেকে সামরিক কাজে বেলুনের ব্যবহার শুরু হয়। বিংশ শতকে এসে দু’টি বিশ্বযুদ্ধে শত্রুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণে বেলুনের ব্যবহার হয়। জাপানীরা যুক্তরাষ্ট্রে বোমাসহ মনুষ্যবিহীন বেলুন পাঠায়। এমনকি শীতলযুদ্ধের সময়ও রাশিয়ার ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে বেলুন ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে আধুনিক গোয়েন্দা বিমান এবং স্যাটেলাইট এখন বেলুনের জায়গা দখল করে নিয়েছে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা
বৈজ্ঞানিক গবেষণা বা অন্যান্য কাজেও এটি ব্যবহৃত হয়। ১৮০৩ সালে বেলুনের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে বিদ্যুতের পরিমাপের মধ্য দিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বেলুনের ব্যবহার শুরু হয়। ফরাসী রসায়নবিদ গে লুস্যাক বেলুনের মাধ্যমে বায়ুর বিভিন্ন উপাদানের পরিমাণ নির্ণয় করেন। উনিশ শতক এবং বিংশ শতকের শুরু পর্যন্ত বায়ুমণ্ডল নিয়ে গবেষণা চালাতে বেলুনই ছিল বিজ্ঞানীদের একমাত্র অবলম্বন। কেবল গবেষণার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেলুনের চড়েছেন তারা। সুইস পদার্থবিজ্ঞানী বেলুনে চড়ে ৫৫,৫৭৭ ফুট পর্যন্ত উঠেছিলেন। এজন্য একটি বিশেষ কেবিন ব্যবহার করতে হয়েছিল তাকে।

১৯৩৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বাহিনীর দু’জন ক্যাপ্টেন বেলুনে চড়ে ৭২,৪৪০ ফুট ওপরে ওঠেন। উদ্দেশ্যে ছিল বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন উচ্চতা থেকে বায়ুর নমুনা সংগ্রহ করা। এখনও বেলুন নিয়ে বায়ুমণ্ডলের নানা পরীক্ষা চালানো হয়। কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মির বিষয়টি নিশ্চিত করার পরীক্ষাটি চালানো হয়েছিল বেলুনের মাধ্যমেই। সম্প্রতি গুগল বেলুনের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। 

পার্ক ভানতাসেল ও ভানতাসেল পরিবারের কথা
ভানতাসেলের গল্প শুরু হয়েছিল ১৮৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোয় অবস্থিত আলবাকারকি শহরে আর শেষ হয়েছিল অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় ১৮৯২ সালে। দশ বছরে বেলুন উড়িয়ে ভানতাসেল পরিবার মাতিয়ে তুলেছিল যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চল, হাওয়াই, অস্ট্রেলিয়া এবং শেষ পর্যায়ে এসে ঢাকা।

পার্ক ভানতাসেল ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রর ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের লোক। পশুর নাড়ি-ভুঁড়ি দিয়ে তৈরি একটি বেলুন তিনি কিনে নেন ৮৫০ ডলারে। নিউ মেক্সিকোর ইতিহাসে প্রথমবারের মত বেলুন ওড়ানোর উদ্যোগ নেন তিনি। ৩০ হাজার ঘনফুট কোল গ্যাস প্রয়োজন হত বেলুনটির উড্ডয়নে।
বেলুন ওড়ানোর কাজ করতে করতে অভিজ্ঞতা অর্জন করে এক পর্যায়ে নিজেকে প্রফেসর বলে পরিচয় দিতে শুরু করেন। আরও পরে পরিচয় দিতে শুরু করেন ক্যাপ্টেন হিসেবে। প্রথম দিককার উড্ডয়নগুলো সেভাবে সফল ছিল না। নান ছলচাতুরীর আশ্রয়ও তিনি নিতেন। তিনি, তার পরিবারের সদস্যগণ এবং দলের অন্যরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রদর্শনী করতে থাকেন। বেলুন থেকে নেমে আসার জন্য প্যারাসুটের ব্যবহারও শুরু করেন। অভিধানে প্যারাসুটের নকশা দেখেই প্যারাসুট বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি।

১৮৮৯ সালে সান ফ্রান্সিসকোয় একটি প্রদর্শনীর সময় সমুদ্রে প্রায় ডুবে মরতে বসেছিলেন তিনি। শেষ মুহূর্তে প্যারাসুট খুলতে পারায় তিনি বেঁচে যান। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সফর করতে থাকেন। একবার খবর বেরোয় যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে হাঙরের উপদ্রব আছে সমুদ্রের এমন একটি এলাকায় তিনি পড়েছেন এবং হাঙরের আক্রমণে মারা গেছেন। পরে জানা যায় ওটা পার্ক ভানতাসেল ছিলেন না। সান ফ্রান্সিসকো দুর্ঘটনার পর থেকেই তার বদলে অন্যরা ঝাঁপ দেয়ার কাজটি করছিল।

বিতর্ক ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ায়
ভারতে প্রদর্শনী করতে গিয়ে সেখানকার মানুষের রোষানলে পড়েন পার্ক ভানতাসেল, হুমকিও দেয় অনেকে। স্থানীয় অনেকে ভাবছিলেন আকাশে ওভাবে বেলুন উড়াবার ফলে ওপর থেকে শয়তান চলে আসতে পারে।

অস্ট্রেলিয়ার প্রদর্শনীটি কুইন্সল্যান্ডে সামরিক বাহিনীর সব সদস্যই প্রত্যক্ষ করে। পার্ক ভানতাসেলের দলের মেয়েরা আঁটসাঁট পোশাক পরত। আর সমালোচকরা বলতে শুরু করে এটা সৈন্যদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
জিনেট ভানতাসেল, প্রথম উড়লেন ঢাকার আকাশে
১৮৯২ সাল, ঢাকার নওয়াব পরিবারের উদ্যোগে পূর্ববঙ্গে প্রথম বেলুন উড্ডয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। ১০ হাজার টাকায় চুক্তি হয়। ঢোল পিটিয়ে শহরের সবাইকে জানানো হয়েছিল প্রদর্শনীর কথা। অসংখ্য মানুষ জড় হয় বুড়িগঙ্গার দু’পাড়ে। অনেকে নৌকায় করে নদীতেই অবস্থান নেয়। এ প্রদর্শনীতে ঝাঁপ দেবার কথা ছিল জিনেট ভানতাসেলের। বোঝা যাচ্ছে তিনি ভানতাসেল পরিবারের সদস্য। কিন্তু তিনি পার্ক ভানতাসেলের মেয়ে নাকি দ্বিতীয় স্ত্রী তা জানা যায় নি।

মার্চের ১৬ তারিখ, তাদের পরিকল্পনা ছিল বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পাড় থেকে বেলুন উড়িয়ে নদী পার হয়ে উত্তর দিকে এসে প্যারাসুটের মাধ্যমে আহসান মঞ্জিলের ছাদে নামবেন। নওয়াবের সাথে ইউরোপীয় অতিথিরাও সেদিন আহসান মঞ্জিলের ছাদে বসে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেন। কাঠ এবং কেরোসিনের ধোঁয়ায় বেলুন ফোলানো হল। সন্ধ্যা ৬:২০ মিনিটে উড়লেন তারা। আবহাওয়া তাদের অনুকূলে ছিল না। প্যারাসুটের মাধ্যমে জিনেট ভানতাসেল নেমে আসেন। বাতাসের টানে আরও উত্তরে রমনা এলাকায় চলে আসেন তারা। উঁচু একটি গাছে আটকে যায় ভানতাসেলের প্যারাসুট।

পুলিশ এসে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করে। বাঁশ জোড়া দিয়ে ১৫-২০ ফুট ওপর থেকে তাকে নামানোর চেষ্টা করা হয়। তিনি বাঁশ বেয়ে নামতে ভয় পাচ্ছিলেন। কিন্তু উপায়ান্তর না দেখে ওভাবেই নামার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাঁশ ভেঙে যায় কিংবা বাঁধন খুলে যায়, তিনি পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পান। জ্বরে ভুগে ১৮ মার্চ তিনি মারা যান। সারা দুনিয়ার পত্রপত্রিকায় খবর হয় ঘটনাটি।
আমেরিকান এই নারী যেন ঢাকাবাসীর আপন মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। সে সময়ের পত্রপত্রিকায় বেশ হৈচৈ শুরু হয়। অভিযোগ করা হয় ইংরেজ পুলিশ কর্মকর্তার ব্যর্থতার কারণেই জিনেটের এই পরিণতি হয়েছে।

আর ইংরেজ প্রশাসনের সমর্থক ইংরেজি পত্রিকাগুলো ঢাকার মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে, বলে তারা গুজব ছড়াচ্ছে।

শোনা যায় জিনেটের মা পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু নওয়াব অর্থের বিনিময়ে মীমাংসা করে দেন।
জিনেট ভানতাসেলকে কবর দেয়া হয় নারিন্দার খ্রিস্টান কবরস্থানে। জন্ম হয়েছিল ১৮৬৪ সালে। এ মর্মান্তিক ঘটনার পর পার্ক ভানতাসেল আর প্রদর্শনী করেছেন এমন শোনা যায় নি। মারা যান ১৯৩০ সালে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

The national flag Cambodia

world map

Schengen Visa Types & Validity- Visa Fees --Travel Insurance-statistics