মানবাধিকার আজ বস্তাবন্দী ও সিন্দুকে তালাবদ্ধ। তাই এ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সচেতনতা
ইসলাম
পরিপূর্ণ জীবন বিধান। জীবনের সকল দিক ও বিভাগ কিভাবে পরিচালিত হবে, তার একমাত্র
সমাধান নিশ্চিত করতে পারে ইসলাম। মানব রচিত কোন আদর্শ মানুষের জীবনের সমস্যার
সমাধান দিতে পারে না। তা হতে পারে সমাজতান্ত্রিক মতবাদ, হতে পারে পুঁজিবাদ, কার্ল
মার্কস এর মতবাদ বা লেলিনের মতবাদ। এসব মতবাদ বা আদর্শের নাম রাখা হয়েছে, কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠাতা,
গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের নামের সাথে মিলিয়ে। যেমন- খৃষ্টান ধর্মের নামকরণ করা হয়েছে
ঐ ধর্মের প্রচারক হযরত ঈসা (আ:) এর নামের সাথে মিলিয়ে। বৌদ্ধ ধর্মের নামকরণ করা
হয়েছে, তার প্রতিষ্ঠাতা মহাত্মা বুদ্ধের নামানুসারে। ইহুদী ধর্মের জন্ম হয়েছিল ইয়াহুদা নামক এক বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষের
মধ্যে।
তাই ঐ
গোষ্ঠীর নাম অনুসারে ইয়াহুদী ধর্মের নাম রাখা হয়েছে। পৃথিবীতে আরও যে সব ধর্ম
বিদ্যমান, সেগুলো ঠিক এভাবেই নামকরণ করা হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মহাগ্রন্থ
আল-কোরআন নির্দেশিত ধর্ম বা জীবন ব্যবস্থা ‘ইসলাম’ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের
অধিকারী। কোন বিশেষ জাতি, গোষ্ঠী, বা ধর্মের প্রচারকের নামের সাথে এর কোন সম্পর্ক
নেই।‘ইসলাম নাম থেকেই সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এটি কোন এক জন ব্যক্তির নয়। কোন
জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, কোন গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং ইসলাম হচ্ছে
সর্বজনীন একটি জীবন ব্যবস্থা যা সকলের জন্য উন্মুক্ত।
এ ধর্মের তার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মাঝে ইসলামের গুণাবলি সৃষ্টি করা। যুগে যুগে যে
সব সম্প্রদায়ের সৎকর্মশীল লোকের মধ্যে এসব গুণাগুণ পাওয়া গেছে, তারা ছিলেন মুসলিম।
ইসলাম মানুষের সকল প্রকার মৌলিক অধিকার পুরোপুরি নিশ্চিত রয়েছে। বিশ্বের মহামনীষী
বৈদগ্ধ্য ও পন্ডিত ব্যক্তিরা তাদের লিখিত বিভিন্ন গ্রন্থ ও Theory-তে মানবাধিকার
সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। বিভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তিবর্গের দৃষ্টিতে
মানবাধিকার সম্পর্কে মতামত, বক্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইসলামের নির্দেশনা ও
দৃষ্টিভঙ্গি এ লেখার মাধ্যমে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হবে। তাই প্রথমে ইসলাম ও
মৌলিক মানবাধিকারের সংজ্ঞা আলোচনা করা প্রয়োজন।
ইসলামের
অর্থ ও সংজ্ঞা : ইসলাম শব্দটি আরবি
‘সিলমুন’ শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ হচ্ছে শান্তি। কিন্তু সে শান্তি শুধু কতকগুলো
নীতিবাক্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অথবা শুধু কিছু শান্তিমূলক উপদেশবাণীর মধ্যেও
গন্ডিবদ্ধ নয়। ইসলাম শব্দের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে- আনুগত্য বা আনুগত্যের বিধান,
আত্মসমর্পণ করা, কোন কিছু মাথা পেতে গ্রহণ করা ইত্যাদি। ইসলাম শব্দের মাসদার
(মূলধাতু) সীন-লাম-মীম। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়- মহান আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (স)
প্রদর্শিত বিধি-বিধান ও জীবন যাপন পদ্ধতি অনুসরণ করা এবং এর মাধ্যমে বিপরীত সকল
প্রকার মতবাদ, চিন্তা-চেতনা, ভাবধারা, দর্শন ও পথ পরিহার করে জীবন পরিচালনাকেই বলা
হয় ইসলাম। আর যিনি কোরআন-হাদীস বা আনুগত্যের বিধান অনুযায়ী জীবন
যাপন করেন তাকে বলা হয় ‘মুসলিম’। মানুষের ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির
একমাত্র গ্যারান্টি হচ্ছে ইসলাম। তাই ইসলামকে ইহকালিন শান্তি ও পরকালিন মুক্তির
‘সনদ’ বলা হয়।
মানুষ
ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে লেন-দেন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একে
অন্যের সাথে চুক্তি সম্পাদন করে কাজ করে থাকে। এ চুক্তি হচ্ছে ইহলৌকিক চুক্তি।
কিন্তু আসল চুক্তি তো হয়ে থাকে মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে।
পৃথিবীর মানুষগণ নানা প্রকার ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা, দর্শন ও মতবাদে বিশ্বাসী।
যে সকল মানুষ ইসলামী দিক-দর্শন ও আদর্শ গ্রহণ করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি
অর্জন করতে চায় তারা মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে একটা উববফ বা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। আর
সে চুক্তিটাই হচ্ছে- জান্নাতের বিনিময়ে জান ও মাল আল্লাহর নিকট বিক্রয় করার
চুক্তি। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন-
‘আল্লাহ
তায়ালা ঈমানদারদের জান ও মাল জান্নাতের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়েছেন। এখন তাদের
একমাত্র কাজ হচ্ছে- আল্লাহর পথে সংগ্রাম করার মাধ্যমে জীবন দেয়া এবং নেয়া’১। পূর্বেই
বলা হয়েছে, ইসলাম শুধু কিছু শান্তিমূলকউপদেশ বাণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রকৃতপক্ষে
ইসলাম অর্থ শান্তি এজন্য বলা হয়েছে যে, মানুষের সামগ্রিক জীবন ও সমাজের সর্বত্র
অশান্তি বিরাজ করছে ইসলাম ও ইসলামী জীবন-পদ্ধতি জারি না থাকার কারণে। সমাজ জীবনে
অশান্তির মূল কারণ হচ্ছে- আল্লাহর দাসত্ব ও গোলামীর পরিবর্তে মানুষ মানুষের দাসত্ব
ও গোলামীতে নিমজ্জিত। জীবনের সকল শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা
অব্যাহত রেখে সমাজকে অশান্তির বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার তাকিদ ইসলামে এসেছে। তাই
ইসলামকে শান্তির বাহক বলা হয়েছে। ইসলাম মানুষের জন্য একটি
পরিপূর্ণ জীবন বিধান। ইংরেজিতে বলা হয়েছে- Islam is the complete code of life.’
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- অর্থাৎ: ‘ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন
ব্যবস্থা’২। এখানে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রনীতি,
পররাষ্ট্রনীতি সবকিছুর সমাধান বিদ্যমান। তাই অন্য কোন মানব রচিত দর্শন বা মতবাদ বা
আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় শামীল থাকা কোনভাবেই সঙ্গত নয়। বরং মানুষকে মানুষের
প্রভুত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রভুত্ব ও
সার্বভৌমত্ব অনুযায়ী মানুষকে সুখী-সুন্দর ও সুশৃঙ্খল জীবন যাপনের সুযোগ প্রতিষ্ঠার
নামই ইসলাম। অতএব বলা যায়, মানুষের সার্বিক জীবনের প্রকৃত শান্তি, সুখ, সমৃদ্ধি,
মুক্তি মৌলিক মানবাধিকার প্রকৃত স্বাধীনতা ও আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার
আন্দোলনই হচ্ছে ইসলাম।
মানবাধিকারের
অর্থ ও সংজ্ঞা :
মানবাধিকার কথাটি বাংলাদেশের তথা বিশ্বের প্রতিটি
মানুষের নিকট অতি সুপরিচিত ও তাৎপর্যপুর্ণ একটি শব্দ। মানবাধিকার শব্দের ইংরেজি
প্রতিশব্দ হচ্ছে Human rights. বাংলা ভাষার দুটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দের সমন্বয়ে
মানবাধিকার শব্দটি গঠিত হয়েছে। একটি শব্দ ‘মানব’ অপরটি ‘অধিকার’। প্রথমটির অর্থ
হচ্ছে- মানুষ আর দ্বিতীয়টির অর্থ হচ্ছে যারা মানুষ তাদের অধিকার। অর্থাৎ
মানবাধিকার কথাটির পরিপূর্ণ অর্থ দাঁড়ায় মানুষের অধিকার। এ অধিকার মানুষের জন্মগত
মৌলিক অধিকার। যা স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত। তাই এ অধিকার সংরক্ষণ ও প্রতিষ্ঠার
সংগ্রামে কাজ করা সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। অতএব মানবাধিকারের
সংজ্ঞায় বলা যায়, মানুষের জীবনধারনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকার নিয়ামকের ওপর
যৌক্তিক ও ন্যায় সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে মানবাধিকার বা Human rights.
আমাদের দেশের অনেক জ্ঞানী-গুণি, পন্ডিত ও বৈদগ্ধ্য
ব্যক্তিবর্গ বলে থাকেন; অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসা হচ্ছে -
মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু এগুলোই শুধু মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণ করবার
ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। আমি মনে করি, এগুলোর পাশাপাশি মানুষের সুষ্ঠু জীবনধারনের
প্রয়োজনে আরও অনেক অধিকার রয়েছে। যেগুলো মানুষের মৌলিক অধিকার হিসাবে পরিগণিত।
যেমন : বাকস্বাধীনতার অধিকার, নির্ভয়ে স্বাধীনভাবে
চলাফেরা করার অধিকার, জীবনধারণের অধিকার, সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিবার পরিচালনার
অধিকার, রাষ্ট্রে শান্তিতে বসবাস করার অধিকার, চুরি- ডাকাতি ও সন্ত্রাসীদের হাত
থেকে বাঁচার অধিকার, জুলুম-অত্যাচার ও নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার অধিকার, মিথ্যা
ও বানোয়াট মামলা থেকে বাঁচার অধিকার, নিজের জমি-জমা,গাছ-পালা ও বাগান-বাড়ি
সন্ত্রাসীদের লুট-পাট থেকে রক্ষার অধিকার, অন্যায়ভাবে কারো হামলা থেকে বাঁচার
অধিকার, স্বাধীনভাবে চাকরি-বাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার, শাসকগোষ্ঠীর
অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে বাঁচার অধিকার, আইন-শৃংঙ্খলা বাহিনীর অনৈতিক হামলা থেকে
নিজেকে আত্মরক্ষার অধিকার, সন্তানদের নৈতিক শিক্ষায় গড়ে তোলার পরিবেশ পাবার
অধিকার, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অধিকার, দেশ জাতি সমাজ ও রাষ্ট্রকে
কল্যাণ রূপে গড়ে তোলার অধিকার, মানব সেবার অধিকার, পেট্রোল বোমার আঘাত থেকে বেঁচে
থাকার অধিকার জনসভা ও সভা-সমাবেশ করার গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সর্বোপরি
জননিরাপত্তার অধিকারও মানুষের মৌলিক মানবাধিকার। মোটকথা মানুষের মৌলিক জীবনধারণের
জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকার নিয়ামকের ওপর যৌক্তিক ও ন্যায় সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠাই
হচ্ছে মানবাধিকার।
মনুষ্যত্বের বা The quality of being human- এর
পরিপূর্ণ বিকাশে মানবাধিকারের গুরুত্ব অপরিহার্য। মৌলিক চাহিদা পুরণসহ
নিরাপত্তামূলক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা বিধান করা সরকার ও মানবাধিকার সংরক্ষণ
সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের প্রধান লক্ষ হওয়া উচিত। এছাড়া মানবতার পরিপূর্ণ বিকাশের
মাধ্যমেই মানবাধিকার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস। তাই শুধু অন্ন,
বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা নয়; বরং এগুলোর পাশাপাশি অন্যান্য সকল অধিকার
যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল মানবাধিকার নিশ্চিত হবে। আইনের শাসন
প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিতে জীবনযাপন করার
অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে মানবাধিকার
সুরক্ষিত হতে পারে। নির্যাতিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায়
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) আজীবন
সংগ্রাম করে গেছেন।
গোটা পৃথিবীর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় তিনি
সংগ্রাম করেছেন। আমাদের মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে
দ্ব্যর্থহীনভাবে নির্যাতিত- নিপিড়ীত মানবাত্মার পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা করেছেন। তিনি
বলেছেন; ‘কি কারণে তোমরা সেসব নারী, পুরুষ ও শিশুদের খাতিরে আল্লাহর অনুসৃত পথে
সংগ্রাম করছ না? অথচ যারা নির্যাতিত, নিপিড়ীত ও দুর্বল হবার কারণে আমার নিকট
ফরিয়াদ করছে এবং বলছে; হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে এ জালিমদের অত্যাচার থেকে বের করে
নাও, অথবা তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য কোন দরদী-বন্ধু ও সাহায্যকারী পাঠিয়ে দাও’
৩। আমাদের দেশে অতীত নেতৃত্ব দানে যাঁরা স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন, তারাও আমরণ
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। শেরে বাংলা এ. কে.
ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমান, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আমাদের দেশের
পবিত্র সংবিধানেও গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা সন্নিবেশিত আছে।
সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে- “The
Republic Shall be a democracy in which fundamental human rights and freedoms
and respect for the dignity and worth of the human person shall be guaranteed,
and in which effective participation by the people through their elected representatives in administration at all level shall be
ensured’’ অর্থাৎ ‘প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও
স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্ত্বার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ
নিশ্চিত হইবে, এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের
কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে’৪। আমাদের দেশের সরকারও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও
রক্ষায় অত্যন্ত যতœশীল বলে আমি মনে করি।
তাই সংবিধানের ধারায় বর্ণিত বিধান অনুযায়ী আমাদের দেশের গণতন্ত্র বর্তমান অবস্থার
তুলনায় আরো শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন।
কোথায়
আজ ন্যায় বিচার, কোথায় আইনের শাসন, কোথায় প্রশাসনের সকল পর্যায়ে জনগণের কার্যকর
অংশগ্রহণ? মানবাধিকার আজ বস্তাবন্দী ও সিন্দুকে তালাবদ্ধ। তাই এ অধিকার প্রতিষ্ঠার
জন্য প্রয়োজন সচেতনতা এবং মৌলিক মানবীয় গুণাবলী অর্জন। যা মানুষের বু্িদ্ধদীপ্ত
বিবেককে উজ্জীবিত করবে, বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে জাগ্রত করবে।বর্তমানে বিশ্বের প্রায়
সবগুলো দেশে মানবাধিকার আন্দোলন দিন দিন জোরদার হচ্ছে। তাছাড়া মানব সভ্যতাকে
সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলার জন্য অন্যতম দিকনির্দেশক হচ্ছে- জাতিসংঘ কর্তৃক সর্বজনীন
মানবাধিকার ঘোষণাপত্র। এ ঘোষণাপত্র অনুযায়ী বিশ্বের ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র প্রায় সকল
দেশ এখন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ভুমিকা পালন করছে।
আমাদের
প্রিয় জন্মভুমি বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণও চায় এদেশে সঠিকভাবে মানবাধিকার
প্রতিষ্ঠিত হোক। প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজ নিজ অধিকার ফিরে পাক। কারণ
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে সংবিধান ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। গণতন্ত্র তার আসল
রূপ ফিরে পাবে। প্রশাসন নির্বিঘ্নে প্রশাসনিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতে সক্ষম হবে।
বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে তার বিচারিক কার্যাবলী সম্পন্ন করতে পারবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তাদের ওপর
অর্পিত দায়িত্ব ও ক্ষমতাবলী নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হবে।
মৌলিক
মানবাধিকার সম্পর্কে দার্শনিকদের অভিমত : মৌলিক
মানাবাধিকার সম্পর্কে একেক জন একেক ধরণের অভিমত পোষণ করেছেন। কিন্তু কোরআনের
স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গিই হচ্ছে আসল দৃষ্টিভঙ্গি। মৌলিক মানবাধিকার সম্পর্কে পাশ্চাত্য
চিন্তাবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি ও দার্শনিকদের অভিমত তুলে ধরা হল এ কারণে যে, যাতে
ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অনুধাবন করা সহজ হয়। পাশ্চাত্য সভ্যতার পন্ডিতগণ ও অনুজগণ
যারা অন্যান্য দেশের নাগরিক তারা কি পরিমাণ জান মাল, ইজ্জত-আব্রু, ন্যায় ইনসাফ
প্রতিষ্ঠা, মান-সন্মান সংরক্ষণ, চিন্তা-চেতনা, ও কর্মের স্বাধীনতা উপভোগ করতে
পারছেন সেটাও বিবেচনা করে দেখা প্রয়োজন।
মূলত পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ মৌলিক মানবাধিকরের Concept- এর
সূচনা করেন খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে
গ্রীস থেকে। তার পরে খৃষ্টীয় পঞ্চম শতকে রোমান স¤্রাজ্যের
পতনের সময় থেকে রাজনৈতিক চিন্তার সূত্র যোগ করে খরগোশের মতো উর্ধ্বলম্ফে খৃষ্টীয়
একাদশ শতকে প্রবেশ করার প্রয়াস পান তারা। তাহলে বাকী পাঁচশত বছর কোথায় গায়েব হল?
আমার মনে হয় গায়েব হওয়ার কারণ হতে পারে, ঐ শতকগুলো হয়ত ইসলামের স্বর্ণযুগ ছিল। যে
কারণে শতকগুলো ইতিহাসের পাতা থেকে নির্মূল হয়ে যায়। আমার জানামতে, গ্রীক
দার্শনিকগণ সন্দেহাতীতভাবে আইনের শাসন ও ন্যায়-বিচারের ওপর অপরিসীম গুরুত্ব আরোপ
করেছেন।
এগুলোর প্রয়োজনীয়তা ও Potentiality সম্পর্কে তারা অনেক জ্ঞানগর্ভ
পুস্তকাবলী প্রকাশ করেছন। কিন্তু ঐ সব পান্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থে আমরা মানবীয় সভ্যতা,
সংস্কৃতি, মানবাধিকার ও সমতার কোন ইঙ্গিত পাই না। তারা ঐ সব গ্রন্থে মানব জাতিকে
ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রীয়, নমশুদ্র বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। দার্শনিক plato
(খৃ:পূ: ৪২৭-৩৪৭) তার Republic গ্রন্থে লিখেছেন, ‘শাসন কর্তৃত্ব শুধু দার্শনিকগণ
ভোগ করবেন। সমাজের অন্যান্য লোকদেরকে তিনি দাস-দাসী, কৃষক, শ্রমিক, সৈনিক ইত্যাদি
শ্রেণিভূক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন; ‘নাগরিকগণ! তোমরা অবশ্যই পরস্পর পরস্পরের ভাই,
কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তোমাদের বিভিন্ন অবস্থায় সৃষ্টি করেছেন।
তোমাদের মধ্যে কারো কারো রাজত্ব করার যোগ্যতা আছে এবং
তাদেরকে খোদা তায়ালা হিরণ্য দিয়ে তৈরি করেছেন। কারো কারো রূপা দিয়ে তৈরি করেছেন।
যারা হবে পূর্বোক্তদের সাহায্যকারী। তারপর আছে কৃষক ও হস্তশিল্পী, যাদের তিনি
পিতল ও লোহা দিয়ে তৈরি করেছেন’৫। প্লেটোর আরো একটি ন্যায়বিচার দর্শন আমরা জানার
চেষ্টা করি। তিনি বলেছেন; “আমি ঘোষণা করছি যে, ন্যায়বিচার শক্তিমানদের স্বার্থ
ছাড়া আর কিছুই নয়। পৃথিবীর সর্বত্র ন্যায়বিচারের কেবল
একটিই মূলনীতি রয়েছে, এবং তা হচ্ছে শক্তিমানদের স্বার্থ’৬। প্লেটোর দর্শনে
গণতন্ত্র সম্পর্কে আরো একটি নমুনা আমরা জানতে পারি। তার মতে, গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড়
দোষ (great fault) তাতে
সকল নাগরিককে সমান মর্যাদা দেয়া হয়। গণতন্ত্র বিভেদের জন্মদানকারী প্রকৃতির একটি
সরকার যা বিশৃঙ্খলা ও বাড়াবাড়িতে পরিপূর্ণ এবং সমান ও অসমান লোকদের মাঝে সমতা
বিধানের চেষ্টা করে”৭।
প্লেটোর
অন্য একটি দর্শনের কথা আমি উল্লেখ করতে চাই। তা হলো-
“ন্যায়বিচার এমন একটি বিষয়, যা বন্ধুদের প্রতিপালন
করে এবং শত্রুদের পশ্চাদ্ধাবন করে”৮। এ হচ্ছে প্লেটোর মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও
গণতন্ত্রের দর্শন তত্ত্বের নমুনা। এখন আমরা
প্লেটোর অনুসারী নামকরা দার্শনিক এরিস্টোটল (খৃ:পূ ৩৮৪-৩২২) এর দর্শন তত্ত্বের দিকে অগ্রসর হবো। এরিস্টোটল এর ন্যায়বিচার সম্পর্কিত Concept তারই গুরু প্লেটোর এপিঠ-ওপিঠ। তিনি
তার politics গ্রন্থে বলেছেন, “ন্যায়বিচার হচ্ছে
সেই গুণ যার সাহায্যে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ মর্যাদা অনুযায়ী এবং আইন অনুযায়ী
অধিকার লাভ করে”৯। এরিস্টোটলের এ তত্ত্ব অনুযায়ী এটা
পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করা যায় যে, তিনি কিছু লোককে দাসত্বের শিকলে চিরকাল আবদ্ধ
রাখতে চেয়েছেন এবং কিছু লোককে সব সময় রাজত্বের আসনে বসিয়েছেন।
এটা মৌলিক মানবাধিকারকে সমর্থন করে না,
বরং সম্পূর্ণ বিপরীত। এরিস্টোটল একই গ্রন্থে লিখেছেন; “বুুদ্ধিমান ও প্রশস্ত
হৃদয়ের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণের এ অধিকার রয়েছে যে, তারা ক্রীতদাসদের নিজেদের মধ্যে
ভাগ-বাটোয়ারা করে নেবে, কর্মে নিয়োগ করবে এবং তাদের প্রয়োজন পূরণ করে দেবে”১০। এরিস্টোটল গরীবদের সম্পর্কে বলেছেন, “গরীব লোকেরা
জন্মগত ভাবেই ধনীদের গোলাম। সে (গরীব লোক) তার স্ত্রী, তার সন্তানরাও গোলাম”১১।
মানুষ, মানুষের ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার সম্পর্কে গুরু প্লেটো ও শিষ্য এরিষ্টোটলের
এসব attitude থেকে অনুধাবন করা যায় যে, ইউরোপের পথ নির্দেশনার উৎস গ্রীসে মৌলিক
মানবাধিকারের অবস্থা অত্যন্ত করুন ও বিপর্যস্ত। প্রখ্যাত পাশ্চাত্য
দার্শনিক রবার্ট এ. ডেবি গ্রীকদের এ মতাদর্শ, চিন্তাধারা ও মতবাদের পর্যালোচনা
করতে গিয়ে লিখেছেন; “লক্ষ ক্রীতদাস এবং ৯০ হাজার নাম মাত্র স্বাধীন নাগরিকদের শহরে
বসে Plato কত মাহাত্ম্যপূর্ণ ও অভিযোগপূর্ণ
বাক্যে Freedom-এর গুণকীর্তন করেছেন ১২। এ. ডেবির এ
মতাদর্শ থেকে প্রমাণিত হয় যে, তিনি Plato এবং
এরিষ্টোটলের দর্শনকে প্রত্যাখান করেছেন। খৃস্টান ধর্মের একজন অনুসারী ও পন্ডিত
ব্যক্তি হচ্ছেন সিসেরো।
সিসেরো
রোমের একজন সুপ্রসিদ্ধ আইনবিদ। তিনি
প্রাকৃতিক বিধানের বিশ্লেষণধর্মী পর্যালোচনা করতে গিয়ে Protection of Human Rights under the law-তে লিখেছেন, “একটি স্থায়ী ও
পরিবর্তনের অযোগ্য আইনই সব জাতি ও সব যুগের জন্য বৈধ ও কার্যকর হতে পারে”১৩।
সিসেরোর এ বক্তব্য প্রকৃতপক্ষে ইসলামী আইন তথা মহাগ্রন্থ আল কোরানকেই সমর্থন করে
বলে আমার ধারণা। তিনি আরো বলেছেন “ আল্লাহ সকল মানুষের জন্য সমান ও অভিন্ন, তিনিই
তাদের প্রভু ও সম্রাট। তিনিই এ বিধানের প্রস্তাব করেন, আলোচনায় আনেন ও কার্যকর
করেন। এটা সেই বিধান যার আনুগত্য না করলে মানুষ স্বীয় প্রভুর বিরুদ্ধাচারী হয়ে যায়
এবং যাকে মানব স্বভাব গ্রহণ না করলে তার কারণে কঠোর শাস্তি ভোগ করে”১৪। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে সিসেরো একজন বিখ্যাত আইনবিদ।
তাই তিনি তাঁর রচিত নীতিমালায় ব্যক্তি মালিকানার অধিকারকে ব্যতিক্রমরূপে সংরক্ষণের
চেষ্টা করেছেন। তাঁর সমসাময়িক আইন প্রণেতাগণও নিজেদের রচিত বিধানে ব্যক্তি
মালিকানার অধিকারকে বিশেষভাবে সংরক্ষণ করেছেন। চিন্তা-চেতনা, ভাবধারা, দর্শনতত্ত্ব
ও মৌলিক মানবাধিকার বিশ্লেষণ করে বলা যায়, Plato এবং এরিস্টোটলের অনুরূপ বিশ্বাস
ধারনের তুলনায় সিসেরো স্বতন্ত্রধর্মী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। যা ইসলামী
বিধানের সাথে মিলে যায়।
প্লেটোর দর্শনে আমরা পাই শাসক গোষ্ঠীই
মৌলিক অধিকার ভোগ করতে পারবে। গরীব অসহায় ও সাধারণ প্রজারা তা ভোগ করতে পারবে না।
তার তত্ত্ব অনুযায়ী শুধু শাসক গোষ্ঠীর বন্ধুভাবাপন্ন ব্যক্তিরাই মানবাধিকার পাওয়ার
যোগ্য। যারা তার শত্রু বা বিরুদ্ধবাদী তার দৃষ্টিতে তাদের ওপর মৌলিক মানবাধিকার
প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ শাসক গোষ্ঠীর বাইরে অবস্থানকারী জনগণ মৌলিক অধিকার থেকে
Deprived হবে। এরিস্টোটলের দর্শনতত্ত্বেও Plato-এর ভাবধারার অনুপ্রবেশ লক্ষ্য করা
যায়। তার দর্শনে শুধু বুদ্ধিমান ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকারের কথা বিদ্যমান।
আর ক্রীতদাসদের তারা ইচ্ছে মতো ব্যবহার করতে পারবে এটাই তাদের মূলনীতি।
কাজেই
এখানে ক্রীতদাস তথা নিম্ন শ্রেণির মানুষদের কোন মৌলিক অধিকার আছে বলে তারা মনে করে
না। এটাও ইসলামের মৌলনীতি ও আদর্শের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়, বরং সাংঘর্ষিক। তবে
খৃস্টান ধর্মের অনুসারী দার্শনিক ও আইনবিদ সিসেরোর দর্শন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়
ইসলাম মৌলিক মানবাধিকার সম্পর্কে যে সব ধারণা উপস্থাপন করেছে তার সাথে সিসেরোর
দর্শন তত্ত্বের সাদৃশ্য রয়েছে। অর্থাৎ তিনি
মানবাধিকার বিষয়ে ইসলামকে সমর্থন করেছেন। তিনি বলেছেন; ‘একটি স্থায়ী ও পরিবর্তনের
অযোগ্য আইনই সব জাতি ও সব যুগের জন্য বৈধ ও কার্যকর হতে পারে ”১৫।
এ
দ্বারা বুঝা যায়, তিনি কোরআনের বিধানকে ইঙ্গিত করেছেন। কারণ হচ্ছে- কোরআন সব যুগের সব জাতির সব মানুষের জন্য
অপরিবর্তনযোগ্য সংবিধান। কোরআনের বিধান একটি স্থায়ী বিধান। এ বিধান অনুসরণ করলে
সকল যুগের সকল জাতির সকল মানুষের কল্যাণ সুনিশ্চিত। তাই কোরআনের ছায়াতলে যারাই
আশ্রয় নেবে তারা তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার লালন
ও উপভোগ করতে পারবে। কারণ পবিত্র কোরআনের বিধান হচ্ছে- সর্বশ্রেষ্ঠ বিধান। ন্যায় ও
সত্যের প্রতিষ্ঠায় এ বিধানের নিকট মানব রচিত যত প্রকার মতাদর্শ, পথ ও ঞযবড়ৎু-তে
আছে সব ম্লান হয়ে যাবে। অর্থাৎ ইসলামী ব্যবস্থাই হচ্ছে সকল প্রকার মতবাদের উর্ধ্বে
। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন;
“তিনিই
সেই মহান সত্তা যিনি সত্য দ্বীন ও হেদায়েত সহকারে তাঁর রাসূলকে (স:) করে পৃথিবীতে
প্রেরণ করেছেন। যাতে করে সকল প্রকার মতাদর্শের উপর ইসলামকে
বিজয়ী আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন”১৬। পবিত্র কোরআনের এ বলিষ্ঠ ঘোষণা অবশ্যই
প্রমাণ করে যে, ইসলামী জীবন বিধান ব্যতিত কোন মানব রচিত মতবাদ মানুষের সার্বিক
জীবনের নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকার পূরণ করতে পারে না।
মানবাধিকারের
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট :
পৃথিবীতে যুগে যুগে মানবাধিকার আন্দোলন সুসংগঠিত হয়েছে।
মৌলিক এ অধিকার আন্দোলনের উদ্ভব হয় মূলত একাদশ শতকে বৃটেনে। তৎকালীন সময়ে (১০৩৭
সালে) বৃটেনের রাজা দ্বিতীয় কনরাড parliament-এ একটি ক্ষমতা নির্ধারণ করে দেন। এ
উদ্দেশ্যে তিনি একটি ফরমান জারি করেন। এ ফরমান জারির পর parliament তার ক্ষমতার
সার্কেল বৃদ্ধির চেষ্টা করে। তারপর রাজা নবম আলফনসোর দ্বারা অনৈতিকভাবে আটকের একটি
নীতিমালা পাশ করিয়ে নেয়া হয়। এ ঘটনা ঘটে ১১৮৮ খৃষ্টাব্দে।
তারপর এলো ম্যাগনাকারটার
পালা। ১২১৫ সালে ১৫ জুন ‘ম্যাগানাকারটার’ জারি হয়। যাকে ওয়েলটার স্বাধীনতার সনদ
নামে আখ্যায়িত করা হয়। বৃটেনে ম্যাগনাকারটা ছিল মৌলিক অধিকারসমূহের সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ দলিল, যা ইতিহাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। সে সময় এটা ছিল রাজন্যবর্গ
(Barons) ও রাজা জন- এর মধ্যকার একটি Deed বা চুক্তিপত্র। এ Deed এর মাধ্যমে
রাজন্যবর্গের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় জড়িত ছিল। জনগণের অধিকারের সাথে এর কোন
সম্পর্ক ছিল না বলা যায়। ঐতিহাসিক দার্শনিক হেনরী মাশর বলেন, “বিরাট বিরাট
ভূস্বামীদের একটি ঘোষণাপত্র ছাড়া তার আর কোন মর্যাদা ছিল না”১৭ ।
তার পর প্রায় একশত
চল্লিশ বছর পর ১৩৫৫ খৃষ্টাব্দে বৃটিশ পার্লামেন্ট ম্যাগনাকারটার স্বীকৃতি দিতে
গিয়ে আইনগত সমাধান অনুসন্ধানের বিধান মঞ্জুর করে। যার অধীনে কোন ব্যক্তিকে বিচার
বিভাগীয় কার্যক্রম ব্যতিত জায়গা সম্পত্তি খেকে বেদখল অথবা গ্রেপ্তার করার বিধান
কার্যকর ছিল না এবং মৃত্যুদন্ডও দেয়ার বিধান ছিল না। তারপর এলো চতুর্দশ শতকের
পালা। এ শতক থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত গোটা ইউরোপে Machiavelli-র দর্শনের অত্যন্ত
জয়জয়কার অবস্থা বিরাজমান ছিল।
আধুনিক
রাষ্ট্র চিন্তার শ্রেষ্ঠ দিকপাল হচ্ছেন
নিকোলী মেকিয়াভেলী। তাকে বলা হয়ে থাকে The first modern political thinker. ১৪৬৯ সালে ইটালীর ফ্লোরেন্স নগরে তার
জন্ম। তার রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে The prince বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ গ্রন্থে তিনি তার রাজনৈতিক
দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করেন। মেকিয়াভেলীই সর্ব প্রথম সার্বভৌমত্বের ধারণা প্রবর্তন
করেন। অবশ্য পবিত্র মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা যে
সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন সে ঘোষণাই হচ্ছে সার্বভৌমত্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ
ঘোষণা। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
অর্থাৎ:
“হে আল্লাহ! বিশ্ব-জাহানের মালিক। তুমি যাকে চাও ক্ষমতা দান কর এবং যার থেকে চাও
ক্ষমতা কেড়ে নাও। যাকে চাও মর্যাদা ও ইজ্জত দান কর এবং যাকে চাও লাঞ্ছিত ও হেয় কর।
কল্যাণ তোমার হাতেই নিহিত। নিশ্চয় তুমি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান”১৮। যাহোক মেকিয়াভেলীর
দর্শন জয়জয়কার থাকলেও তিনি প্রকারন্তরে স্বৈরতন্ত্রের হাতকে শক্তিশালী করেছিলেন।
রাজাদের শক্তি যুগিয়েছিলেন এবং ক্ষমতা দখলকে জীবনের উদ্দেশ্যে পরিণত করেছিলেন।
সপ্তদশ শতকে প্রাকৃতিক মতবাদ পুনরায় পরিপূর্ণ শক্তিতে উত্থিত হয়। অর্থাৎ ১৬৭৯ সালে
বৃটিশ পার্লামেন্ট অন্যায় আটকাদেশের বিধান মঞ্জুর করে যার মাধ্যমে সাধারণ
নাগরিকদের অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার থেকে নিরাপত্তা দান করা হয়।
১৬৮৯
সালে পার্লামেন্ট বৃটেনের সাংবিধানিক ইতিহাসের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দলিল Bill of
Rights বা অধিকার আইন মঞ্জুর করে। লর্ড একটোন Bill of Rights- কে ইংরেজি জাতির
মহত্তম অবদান হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এ বিলকে বৃটেনে স্বাধীনতা আন্দোলনের সমাপ্তি
হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কারণ এর সাহায্যে মৌলিক
অধিকারসমূহ সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়ে যায়। অতপর জন লক ১৬৯০ সালে ‘Treaties on Civil Government’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন। তাতে
১৬৮৮-১৬৮৯ সালের বিপ্লবের বৈধতার সমর্থন পাওয়া যায়। যার মধ্যে তিনি সামাজিক
চুক্তির মতবাদ পেশ করেন। ১৭৬২ সালে খ্যাতিমান দার্শনিক ও ফরাসী নাগরিক রুশো (১৭১২-১৭৭৮) “সামাজিক চুক্তি মতবাদ” নামে একটি
গ্রন্থ রচনা করেন। ঐ গ্রন্থে ঐড়ননবং (হব্স) ও লকের পেশকৃত সামাজিক চুক্তির নতুন
দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়। তারপর ১৭৭৬ সালের ১২ জুলাই আমেরিকান যুক্তরাষ্টের
স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। এর খসড়া তৈরি করেছিলেন টমাস জেফেরশন। এর অনেক মূলনীতি
লকের মতবাদের ওপর ভিত্তিশীল ছিল।
১৭৯২ সালে টমাস পেইন একটি বিখ্যাত
পুস্তিকা প্রকাশ করেন। পুস্তিকাটির নাম দেয়া হয় The Rights of man- যা
পাশ্চাত্যবাসীর চিন্তার ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে এবং মানবাধিকার সংরক্ষণের
আন্দোলনকে আরও বেগবান করে দেয়। অত:পর উনবিংশ ও বিংশ শতকে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সংবিধানে
মৌলিক অধিকারসমূহের সংযোজন একটি স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়। তারই ধারাবাহিকতায়
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানীসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় নতুন রাষ্ট্রের সংবিধানে মৌলিক
অধিকারসমূহে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯৪০
সালে প্রখ্যাত লেখক ও সাহিত্যিক এইচ. জি. ওয়েলস তার New order গ্রন্থে Human
Rights এর একটি সনদপত্র ঘোষণার পরামর্শ পেশ করেন। ১৯৪১ সালের জানুয়ারী মাসে
প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট কংগ্রেসের নিকট ৪টি স্বাধীনতার সমর্থন করার জন্য আবেদন করেন।
ঐ বছর আগষ্ট মাসে আটলান্টিক ঘোষণায় স্বাক্ষর করা হয়। যার উদ্দেশ্য ছিল চার্চিলের ভাষায়;
“মানবাধিকারের ঘোষণার সাথে সাথে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি”। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর
লিখিত সংবিধানে মৌলিক অধিকারের সংযোজন আরও সুস্পষ্টরূপ ধারণ করে। এজন্য ফ্রান্স
তাদের ১৯৪৬ সালের সংবিধানে ১৭৮৯ সালের মানাবাধিকারের ঘোষণাপত্র সংযুক্ত করে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন