শক্তিধর দেশগুলোর কাছে দরিদ্র ও ৩য় বিশ্বের জনগণ যেন বড় অসহায়।
অশান্ত পৃথিবীর বিক্ষুব্ধ জনতার আর্তচিৎকারের ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে উন্মুক্ত গগনের মুক্ত পবন আজ বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। বিশ্বে কোটি কোটি অভুক্ত বনু আদমের অমানবিক জীবন প্রবাহের নিদারুণ চিত্র সচেতন মানুষকে ব্যথিত করছে। পাশাপাশি তথাকথিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের ডামাডোলে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মারণাস্ত্র ব্যবসায়ের প্রতিযোগিতা আজ বিবেকবান সকল মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। অথচ (প্রায় ১৪ বছর পূর্বের) এক রিপোর্টে দেখা যায় বিশ্বে প্রতিদিন ১শ’ ১৫ কোটি শিশু অভুক্ত অবস্থায় রাত কাটায়।কি চমৎকার বৈপরীত্য? শক্তিধর দেশগুলোর কাছে দরিদ্র ও ৩য় বিশ্বের জনগণ যেন বড় অসহায়। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের জনগণের অবস্থা আজ ত্রাহি ত্রাহি। বর্তমানে যারাই তথাকথিত মানবাধিকারের সবক দিতে আসে তাদের দ্বারাই তা পদলিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আবার তারাই ঐসব দরিদ্র দেশগুলোকে সাহায্যের লোভ দেখিয়ে এগিয়ে আসে। এ যেন সেই নীরিহ ছাগলের জন্য বাঘের সাহায্যেরহাত দেখানো। বিশ্বে শত শত বিলিয়ন ডলার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে ব্যয় হচ্ছে। অথচ ঐসব টাকা দিয়ে যদি গরীব মিসকীন অসহায় মানুষের খেটে খাওয়ার জন্য গরীব দেশগুলোতে মিল, কলকারখানা, হাসপাতাল প্রভৃতি কর্মমুখী ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হ’ত তাহ’লে লক্ষ কোটি মানুষ নির্বিঘ্নে তাদের জীবন পরিচালনা করতে পারত। প্রশ্ন হ’ল, এগুলো করলে শক্তিধর মোড়ল ধনী দেশগুলো তথাকথিত ‘মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার যিকির’ তো আর করতে পারবে না।
মানবাধিকার শব্দটি বর্তমান বিশ্বে ব্যাপক আলোচিত বিষয়। জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদের বেশ কিছু কনভেনশন বা প্রস্তাবনা রয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) পর ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় League of Nations বা ‘জাতিপুঞ্জ’। এ সংস্থা উল্লেখযোগ্য কার্য বাস্তবায়ন করতে না পারায় ২য় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫) গোটা বিশ্ব যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত, তখন কতিপয় রাষ্ট্রের উদ্যোগে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবরে বিশ্ব সম্প্রদায় ‘জাতিসংঘ’ গঠন করে। এরপর ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর ‘সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ’ নামে একটি ঘোষণা দেয়া হয়। যা বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিকট গৃহীত হয়। এক্ষণে মানবাধিকার আইন বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সর্বজনীন মানবাধিকার আইনের বিশ্লেষণ করতে গেলে নানা দিক নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন। সে সাথে ইসলামের আলোকে এর মূল্যায়নও যরূরী। নিম্নে মানবাধিকার বিষয়ে আলোচনা করা হ’ল।-
‘মানবতা’ শব্দটির তাৎপর্য মানবতা শব্দের বিশ্লেষণে নিহিত। এই শব্দটি চারটি বর্ণ সমন্বয়ে গঠিত। তা হচ্ছে মা+ন+ব+তা। এর মধ্যে চারটি বিষয় নিহিত আছে। যেমন মা=মানুষ ন=নীতি, ব=বাস্তবায়ন, তা=তাগাদা। অর্থাৎ মানুষের নীতি বাস্তবায়নের তাগাদাই হ’ল মানবতা। বিশেষ্যবাচক এ মানবাধিকার পদটিকে বিশ্লেষণ করলে পৃথক দু’টি শব্দ বেরিয়ে আসে। তার একটি হ’ল ‘মানব’ (Human), অপরটি হ’ল ‘অধিকার’ (Right)।
অধিকার (Right) : ‘অধিকার’ শব্দটি ছোট হ’লেও এর গুরুত্ব ও প্রয়োগ বিশাল ও ব্যাপক। বিভিন্ন মনীষী বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে একে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। যেমন- কারও মতে, বর্তমান কালে ‘অধিকার’ বলতে আইন দ্বারা সীমিত একজন ব্যক্তির কোন কিছু করার স্বাধীনতা, কোন কিছু নিজের অধীনে রাখা বা অন্যের কাছ থেকে কোন কিছু গ্রহণ করাকে বুঝায়। আইনের ভাষায় বলা যায়, অধিকার হল- একটি স্বার্থ, যা সংবিধান বা সাধারণ আইন দ্বারা সৃষ্ট বা বলবৎযোগ্য হয়।
এখানে স্মর্তব্য যে, অধিকারের সাথে ‘কর্তব্য’ কথাটি সম্পৃক্ত। অন্যরা কর্তব্য পালন না করলে আমার পক্ষে অধিকার ভোগ করা সম্ভব নয়। যেমন- অন্যদের কর্তব্য হ’ল আমাকে পথ চলতে দেয়া। যদি তারা এ কর্তব্য পালন না করে, তাহ’লে আমার পথ চলার অধিকারের কোন অস্তিত্ব থাকে না। তেমনি আমার কর্তব্য হল, অন্যদের পথ চলতে দেয়া। আমি যখন অন্যদের পথ চলতে দেব, কেবল তখনই আমার নিজের পথ চলার অধিকার তাদের কাছ থেকে দাবী করতে পারব। তাই অধ্যাপক লাস্কি বলেন, My rights are built always upon my function to the well being of society; and the claim I make must, clearly enough, be claims that are necessary to the proper performance of my function. My demands upon society are demands which ought to receive recognition because a recognizable public interest is involved in their recognition.
আধুনিক রাষ্ট্র উৎপত্তির পূর্বে মানুষের ‘অধিকার’ এর জন্ম হয়েছে, না পরে হয়েছে- এ নিয়ে পন্ডিত মহলের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ মনে করেন, মানুষ পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণের পর থেকেই তার অধিকারের বিষয়টি চলে এসেছে। যেমন John locke-এর মতে, মানুষ স্বভাবতঃই কিছু অধিকার নিয়ে জন্ম লাভ করে, যাকে প্রাকৃতিক অধিকারও বলা হয় এবং যা প্রাক রাষ্ট্রীয় যুগেও বর্তমান ছিল।
পক্ষান্তরে Gettel-এর মতে, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে মানুষের অধিকার ভোগ করা সম্ভব নয়। কেননা রাষ্ট্র অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা না দিলে সে অধিকার অর্থহীন। অতএব রাষ্ট্র তথা রাষ্ট্রীয় আইনই অধিকার সৃষ্টি করে এবং তা ভোগ করার নিশ্চয়তা দেয়।অর্থাৎ অধিকার হ’ল, সেই বিষয়বস্ত্ত যা মানুষের জন্ম থেকে শুরু হয়, যাকে আমরা প্রাকৃতিক অধিকার বলে থাকি, যা আধুনিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পূর্ব থেকে ছিল। অতঃপর সেই অধিকারগুলো মানুষ আধুনিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এনে আরও সুন্দর, সাবলীল, গ্রহণযোগ্য করে আইনী কাঠামোতে রূপান্তরিত করেছে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যাচ্ছে, মানুষের অধিকার কিছু জন্মগত হ’লেও সবকিছু রাষ্ট্র দ্বারা সৃষ্ট ও রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। প্রচলিত আইন বিজ্ঞানীদের যুক্তি হ’ল রাষ্ট্র যতক্ষণ না কোন অধিকার সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন করবে ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ আইনত ও ব্যবহারগত কোন অধিকার আদায় করতে পারবে না। তাই এখানে রাষ্ট্র মানুষের অধিকার আদায়ে ব্যর্থ হ’লে সব ব্যর্থ। বাস্তবে গণতন্ত্রকামী দেশগুলোতে এক্ষেত্রে ব্যর্থতার চিত্রই দেখা যাচ্ছে।
আধুনিক রাষ্ট্রে আইন প্রণেতাগণ জনগণের চাহিদানুযায়ী আইন প্রণয়ন করে অথবা একটাতে সমাধান না হ’লে দ্রুত ভিন্ন আর একটা আইন রচনার রাস্তা বের করতে হয়। বাংলাদেশে জনগণের জন্য এরকম অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা জনগণের কল্যাণের (?) জন্য স্বাধীনতাত্তোর ৪০ বছরে অন্তত ১৫বার সংবিধান সংশোধন করেছে। তবুও এদেশের মানুষের অধিকার আদায় ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। আমেরিকা, ফ্রান্স, ভারত সহ সব দেশে অসংখ্যবার সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। তবু তারা তাদের অধিকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেন হালে পানি পাচ্ছে না। সবটাতে গোল-পাক খাচ্ছে। বিষয়টি অতীব কঠিন। কারণ, প্রকৃত অর্থে আইন বিজ্ঞানীগণ অধিকার সম্পর্কে যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা অস্পষ্ট এবং অপূর্ণাঙ্গ। প্রচলিত এ সংজ্ঞা ও আইনের কোন স্থিতি নেই; নেই কোন কমিটমেন্ট। ফলে তার কার্যকারিতাও নেই। তাই মানুষকে আসতে হয় ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে অধিকার :
ইসলামে রয়েছে মানুষের অধিকার সম্পর্কে বিস্তারিত সুসংবদ্ধ নীতিমালা ও ব্যাখ্যা। মানুষের নিজস্ব যুক্তি-বুদ্ধি সেখানে অচল। ইসলামের সে ব্যাখ্যার মধ্যে রয়েছে মানবতার রক্ষাকবচ। তাইতো মহান আল্লাহপাক কুরআন মজীদে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلاَ مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُوْلُهُ أَمْراً أَنْ يَكُوْنَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَن يَعْصِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلاَلاً مُّبِيْناً- ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) কোন বিষয়ে ফায়ছালা করলে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর নিজেদের কোন ব্যাপারে অন্য কোন সিদ্ধান্তের এখতিয়ার থাকবে না। কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সে তো স্পষ্ট পথভ্রষ্ট হবে’ (আহযাব ৩৬)।
উক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, মানুষের কল্যাণকর্ম তথা অধিকারের ক্ষেত্রে কারও কোন কমবেশী করার সুযোগ নেই এবং কোনরূপ সংশোধন করারও সুযোগ নেই। ইসলামে অধিকার ও কর্তব্য পরস্পর সম্পর্কিত। শাসক-শাসিতের সম্পর্ক কেমন হবে তা উল্লেখ আছে। একইভাবে পিতা-মাতার উপর সন্তানের, সন্তানের উপর পিতা-মাতার অধিকার কেমন হবে তার ঘোষণা রয়েছে। অনুরূপভাবে স্ত্রীর উপর স্বামীর, স্বামীর উপর স্ত্রীর, নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, সঙ্গী-সাথী, গরীব-মিসকীন, নিঃস্ব, ইয়াতীম, মুসাফির, হিন্দু, খৃষ্টান, রোগী, অসহায় ব্যক্তি, শ্রমিক সহ পৃথিবীর সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে পরস্পরের উপর অধিকার কেমন হবে তা ইসলামে নির্ধারিত রয়েছে। এমনকি জীব-জন্তু, পশু-পাখির সাথেও কেমন আচার-আচরণ করতে হয় তার স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে। কিন্তু অনেক আধুনিক পন্ডিত তা জানে না। যেমন-
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক বিষয়ে তোমাদের উপর ইহসান অত্যাবশ্যক করেছেন। অতএব তোমরা যখন হত্যা করবে, দয়ার্দ্রতার সাথে হত্যা করবে। আর যখন যবেহ করবে, তখন দয়ার সঙ্গে যবেহ করবে। তোমাদের সবাই যেন ছুরি ধারালো করে নেয় এবং তার যবেহকৃত জন্তুকে কষ্টে না ফেলে’।তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি একটি চড়ুই পাখি যবেহর সময়ও দয়া প্রদর্শন করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার প্রতি দয়া করবেন’।
অন্য এক হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে জিনিসের মধ্যে প্রাণ আছে, তোমরা তাকে লক্ষ্যবস্ত্ত বানিও না’।
এ রকম বহু দৃষ্টান্ত দেয়া যাবে ইসলাম মানুষ ও সৃষ্টিকুলের জন্য কত উদারতা ও মহানুভবতা দেখিয়েছে। অথচ বহু বছর ধরে অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী ও আইন প্রণেতাগণ মানুষের অধিকার সম্পর্কে আধো আধো হ’লেও কিছু যুক্তি-দলীল পেশ করেছেন, কিন্তু পশু-পাখির উপর নিষ্ঠুর আচরণ করা যাবে না মর্মে কোন দেশের সংবিধানে কোন আইন লিখিত আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু চিরন্তন অবিস্মরণীয় এক শাশ্বত বিধান ইসলামে শত শত বছর পূর্বে তা সংরক্ষিত রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে পৃথিবী যতদিন টিকে থাকবে। সুতরাং এ কথা আমরা দ্বিধাহীনচিত্তে ঘোষণা করতে পারি যে, অধিকার বিষয়ে মানুষ প্রদত্ত সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা নয়; কুরআন-ছহীহ সুন্নাহতেই তার চমৎকার সমাধান রয়েছে।
আইনগত অধিকার (Legal Rights) : আইনগত অধিকার হ’ল সে অধিকার যা কোন আইন দ্বারা স্বীকৃত ও সংরক্ষিত থাকে। এটা রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান বা আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত ও বাস্তবায়িত হয়। এটা কেউ লংঘন বা অমান্য করলে তা দন্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। যেমন- আমার পথ চলার অধিকার, ধর্মীয় কাজ সম্পন্ন করার অধিকার। এ কাজে কেউ বাধা দিলে তার প্রতিকার পাওয়া যাবে। কিন্তু কোন বিড়ালের সাথে নিষ্ঠুর আচারণ করা হ’লে বা ভিক্ষুকের সাথে যদি খারাপ আচরণ করা হয়, তবে তার কোন আইনগত প্রতিকার পাওয়ার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। কাজেই বৃহত্তর অর্থে আইনগত অধিকার বলতে আমরা সেই অধিকারগুলোর কথা বলতে পারি যা কেবল রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আইনের আওতায় রচিত।
ইসলামের দৃষ্টিতে আইনগত অধিকার :
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের জন্য কতগুলো অধিকার রয়েছে যা ইসলামী রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের পক্ষে কোন সংস্থা কর্তৃক প্রণয়ন ও বলবৎ হয়ে থাকে। তবে এটা কুরআন-ছহীহ সুন্নাহর বাইরে নয়। এই আইন কেউ লংঘন করলে তাকে শাস্তি পেতে হয়। যেমন- মালিকানার অধিকার, মজুরী প্রাপ্তির অধিকার, মোহরানা প্রাপ্তির অধিকার, প্রতিশোধ ও প্রতিদানের অধিকার ইত্যাদি। তদ্রূপ কেউ কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করলে পাল্টা ইসলামী আদালত দ্বারা কিছাছ বা মৃত্যুদন্ড পেতে হবে। অনুরূপ স্ত্রীর মোহরানা পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক, কেউ চুরি করলে তাকে শাস্তি পেতে হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُواْ أَيْدِيَهُمَا جَزَاءً بِمَا كَسَبَا نَكَالاً مِّنَ اللهِ وَاللهُ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ-
‘পুরুষ কিংবা নারী চুরি করলে তাদের হস্ত ছেদন কর, তা তাদের কৃতকর্মের ফল এবং আল্লাহর নির্ধারিত আদর্শ দন্ড, আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়’ (মায়েদাহ ৩৮)।
অনুরূপভাবে আমানতের মাল আমানত গ্রহণকারীর কোন প্রকার কাজের ফলে বিনষ্ট না হয়ে আপনা হ’তে বিনষ্ট হয়ে গেলে আমানত গ্রহণকারীকে কোনরূপ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না’।
ইবনু ওমর (রাঃ) সূত্রে রাসূল (ছাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক মহিলা একটি বিড়ালের কারণে জাহান্নামে গিয়েছিল। সে তাকে বেঁধে রেখেছিল। সে তাকে খাবারও দেয়নি, ছেড়েও দেয়নি, যাতে সে যমীনের পোকা-মাকড় খেতে পারত’।[11] পরে বিড়ালটি মারা গেল। এখানে কেবল ইসলামী আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জনগণের পারস্পরিক স্বার্থ সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা রয়েছে তাই নয়, বরং তা পশু-পাখিসহ সকল ক্ষেত্রে অত্যন্ত দূরদর্শিতার সাথে রচিত হয়েছে।
মানবাধিকার (Human Rights) : সমকালীন প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার যে অর্থ বহন করে, কয়েক দশক আগেও এর অর্থ এরূপ ছিল না। তাই সংজ্ঞা হিসাবে ‘মানবাধিকার’ শব্দটি কলা বিজ্ঞান ও আইন বিজ্ঞানে খুব সাম্প্রতিক সংযোজন। ‘মানবাধিকার’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হ’ল মানবের অধিকার। অর্থাৎ মানুষ হিসাবে প্রতিটি মানব সন্তানের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত অধিকার সমূহ হচ্ছে মানবাধিকার। প্রতিটি মানুষের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার সমূহ এর অন্তর্ভুক্ত। আরো বিস্তৃত পেক্ষাপটে মানবাধিকার পৃথিবীর সমস্ত ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তা, গোষ্ঠী, লিঙ্গ, নির্বিশেষে মানুষের অবিচ্ছেদ্য অধিকারগুলো তার সত্ত্বার সাথে একীভূত হয়ে পড়ে। প্রতিটি মানব সন্তান মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েই হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার করে ক্রন্দন ধ্বনি উচ্চারণের মাধ্যমে তার অধিকারগুলো ব্যক্ত করে সারা বিশ্বের কাছে তার অধিকারের কথা জানিয়ে দেয়।
এখানে কেবল মানুষের অধিকারের বিষয়টি এসেছে। আসলে মানুষের সাথে সম্পর্কিত সব ধরনের আচার-ব্যবহার, নীতি, আচরণ, ব্যবস্থা রীতি, আইন বিধি, কার্যক্রম ও কার্যব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রয়োজন ও চাহিদা, প্রয়োগ ও প্রযুক্তি, জ্ঞান ও বিজ্ঞান, কার্য, চিন্তা জীবন, জড়জগৎ, চিন্তাজগৎ, প্রাণী জগৎ তথা বিশ্ব প্রকৃতির সবকিছু মানবাধিকারের সাথে সম্পৃক্ত।[যেমন- আমার গৃহে নিরপদ্রপ জীবন-যাপন যেমন আমার অধিকার, প্রাপ্ত বয়স্ক দু’জন অবিবাহিত যুবক-যুবতীর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ও সন্তান উৎপাদনও তাদের তেমন অধিকার। সেন্সরশীপ আরোপ করে মত প্রকাশ, প্রচার ও কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি যেমন মানবাধিকার লঙ্ঘন, ঠিক তেমনি আইন সম্মত কারণ ও পরোয়ানা ব্যতিরেকে গ্রেফতার, আটক, নির্যাতন, হয়রানি সবই মানবাধিকার লঙ্ঘন।
এখনও বাংলাদেশ সহ বিশ্বে লক্ষ-কোটি নিরপরাধ বনু আদম বিনা বিচারে যুগ যুগ ধরে কারাগারে নিক্ষিপ্ত রয়েছে। একটি স্বাধীন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য প্রফেসরদেরকেও মিথ্যা মামলায় বছরের পর বছর বিচারের কাঠগড়ায় অমানবিকভাবে হাজিরা দিতে হয়। এটা কি মানবাধিকারের লংঘন নয়?
এক সময় কেউ কেউ বলেছেন, মানুষের অধিকার ও মানবাধিকার এক জিনিস নয়। কারণ মানবাধিকার যাকে এক সময় বলা হ’ত পুরুষের অধিকার (Rights of man)। যেখানে অধিকার বলতে পুরুষেরই ছিল, নারীর কোন অধিকার ছিল না।
এখানে তাই স্পষ্টত নারী-পুরুষের বৈষম্যের আভাস পাওয়া যায়। Thomas Paine সর্বপ্রথম ফ্রান্সে জাতীয় পরিষদ কর্তৃক ১৭৮৯ সালে গৃহীত ‘পুরুষের অধিকার’ ফরাসী ঘোষণার ইংরেজী (French Declaration of Rights of man and of the citizen) অনুবাদ মানবাধিকার পদ্ধতিটি ব্যবহার করেন। পুরুষের অধিকার বললে তাতে নারীর অধিকার অন্তর্ভুক্ত হয় না বলেই পরবর্তীকালে মিসেস এলিয়ন রুজভেল্টের প্রস্তাবানুযায়ী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ১৯৪৮ সালের ১০ই ডিসেম্বর গৃহীত সর্বজনীন ঘোষণায় ‘মানবাধিকার’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। তাই মানবাধিকার এখন জাতি-ধর্ম-বর্ণ, ভাষা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় দু’টো বৈশিষ্ট্য হ’ল একটি সহজাত অপরটি হস্তান্তর অযোগ্য। Paul Sheiegart মনে করেন এই বৈশিষ্ট্য দু’টির কারণেই মানবাধিকার অন্যান্য অধিকার থেকে আলাদা এবং অধিক মর্যাদাসম্পন্ন।
ক্লাসিক্যাল যুগ থেকে মধ্যযুগ হয়ে রেনেসাঁর শেষ সময়কাল পর্যন্ত বিভিন্ন মনীষীর রচনায় মানবাধিকারের ধারণা ও পরিচয় মেলে। যেমন- ফ্রান্সের বঁদীন ও জীন জ্যাক রুশো, ইটালীর হুগো প্রোটিয়াস, ইংল্যান্ডের জন লক, ভ্যাটেল ও ব্লাক স্টোন এবং জার্মানীর কার্ল মার্কস। এঁদের লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে যে, ‘মানুষ’ হিসাবে মানুষ কিছু প্রাকৃতিক অধিকার ভোগ করার অধিকারী। কিন্তু কোন শাসক যখন মানুষকে এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে তখনই তারা সোচ্চার হয়েছে, প্রতিবাদী হয়েছে। সুতরাং এ অধিকার শাসকেরা অনায়াসে মানুষকে দেয়নি, দিয়েছে একেবারে নিরুপায় হয়ে। ফলশ্রুতিতে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রণীত হয়েছে বিভিন্ন দলীল যেগুলোতে আনুষ্ঠানিকভাবে সংরক্ষিত হয়েছে মানুষের অধিকার। যেমন- ইংল্যান্ডের ১২১৫ সালের Magna carta, ১৬২৮ সালের Petition of Rights, ১৬৮৯ সালের Bill of Rights ইত্যাদি। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, মানবাধিকারের ধারণার বিকাশ ঘটেছে স্বেচ্ছাচারী শাসকদের স্বৈরতন্ত্রের ফল হিসাবে। কথাটি অকপটে স্বীকার করেছেন সাধারণ পরিষদের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আফগানিস্তানের Mr. Abdur Rahman Pazhwak। ১৯৬৬ সালে মানবাধিকার বিষয়ক দু’টো আন্তর্জাতিক চুক্তি গৃহীত হবার পর তিনি বলেছিলেন, 'Universal respect for human Rights is inseparable from world peace. At the root of all strife and tyranny, in the present as in the past, lies a violation of human rights in one form or another.
উপরের আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, সমস্ত অধিকার মানুষের প্রকৃতিতে সহজাত ও হস্তান্তর অযোগ্য, যেগুলো পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য জাতি, বর্ণ, গোত্র, নারী-পুরুষ, রাজনৈতিক বা অন্যান্য অভিমত ইত্যাদি নির্বিশেষে সমভাবে প্রযোজ্য ও উপভোগ্য (equally applicable to and enjoyable by), যেগুলো মানুষের ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য এবং যেগুলো ছাড়া মানুষ ‘মানুষ’ হিসাবে বেঁচে থাকতে পারে না সেগুলোই মানবাধিকার।
আর আইনগতভাবে বলা যায় যে, অধিকারগুলো মানবাধিকার হিসাবে বিশ্বের রাষ্ট্র সমূহ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মাধ্যমে যে চুক্তি বা সনদ প্রণয়ন করেছে সেগুলো হল মানবাধিকার। এর ব্যবহার ও প্রয়োগ সমানভাবে সকল রাষ্ট্রের উপর বর্তায়। যদিও এটা বর্তমানে বিতর্কিত। সনদগুলোর মধ্যে যেমন- Universal Declaration of Human Rights of 1948 (UDHR), International Covenant of civil and political Rights of 1966 (ICCPR), International Covenant on Economic, Social and Cultural Rights of 1966 (ICESCR) ইত্যাদি। বিশ্ব ব্যবস্থায় বর্তমানে UDHR হ’ল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য মানবাধিকার সনদ। তবে এই সনদের ধারা ও প্রয়োগ বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। তাই একে সর্বজনীন আইনগত মানবাধিকার হিসাবে সর্বত্র প্রয়োগ সম্ভব নয়। কেননা এটা কোন রাষ্ট্র মানতেও পারে, আবার নাও পারে। কিন্তু অন্যত্র দৃষ্টি দিলে আমরা দেখব ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স সহ যেকোন দেশের সংবিধানে স্বীকৃত ও চিহ্নিত মানবাধিকারগুলো হ’ল আইনগত মানবাধিকার। কারণ এসব মানবাধিকার ঐসব রাষ্ট্রের সংবিধানে গৃহীত ও স্বীকৃত। বাংলাদেশ সংবিধানের ২য় ভাগে উল্লেখিত মূলনীতি অধিকার এবং ৩য় ভাগে উল্লেখিত মৌলিক অধিকারগুলো হ’ল আইনগত মানবাধিকার। কেউ এটা লংঘন করলে তার উপযুক্ত প্রতিকারের ব্যবস্থা রয়েছে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লংঘন করলে তার প্রতিকারের বিধান রয়েছে বটে, কিন্তু তার সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। কারণ জাতিসংঘ তথা জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদ কয়েকটি পরাশক্তিধর দেশের হাতে বন্দী হয়ে পড়েছে। কায়েমী স্বার্থ ও হিংসার কবলে সেই মানবাধিকার ও মানবাধিকার সংস্থা যেন কারও কারও দাবার গুটি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ এই মানবাধিকার এর উৎপত্তি ও ব্যবস্থা কখনও স্থায়ী ও সর্বজনীন ছিল না। সর্বদা আইনের অনুমিত ধারণা বশতঃ হয়ে সংযোজন-বিয়োজন চলছে। অথবা আইনের ফাঁক-ফোকরে বিশ্বে বিভিন্ন প্রান্তে তার যথেচ্ছ ব্যবহার করে যাচ্ছে। জাতিসংঘের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য তাদের ভেটো পাওয়ার প্রয়োগ করছে। যেমন ফিলিস্তীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি না দেওয়ার ব্যাপারে এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো পাওয়ারই যথেষ্ট। যদিও গোটা বিশ্ব সম্প্রদায় ফিলিস্তীনীদের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন দেয়। একইভাবে মিথ্যা গোয়েন্দা তথ্য অথবা কাল্পনিক তথ্যের উপর নির্ভর করে জাতিসংঘকে ব্যবহার করে ইঙ্গ-মার্কিন কর্তৃক ইরাককে ধ্বংস করা হয়। যেখানে ১৯৯২ সালে হামলার পর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ১০ লাখ নারী বিধবা এবং ৪০ লাখ শিশু ইয়াতীম হয়েছে। ২৫ লাখ মানুষ হতাহত হয়েছে এবং ৮ লাখ নিখোঁজ রয়েছে। এরই নাম আমেরিকার মানবাধিকার রক্ষা (?) অথচ আমরা বলি, বিশ্ব ব্যবস্থাপনা ও শান্তির গ্যারান্টি তথা মানবাধিকার রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত ব্যবস্থা রয়েছে শ্বাশত বিধান ইসলামে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন