যেভাবে হলো সাত মহাদেশের নাম

যেভাবে হলো সাত মহাদেশের নাম

এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও এন্টার্কটিকা- গোটা পৃথিবীকে এই সাতটি মহাদেশে ভাগ করা হয়েছে। মহাদেশগুলো নিয়ে জানার আগ্রহের শেষ নেই আমাদের। চাকরি প্রত্যাশীদের গলদঘর্ম হতে হয় সাত মহাদেশ সম্পর্কে পড়তে পড়তে। মহাদেশগুলো সম্পর্কে হয়ত অনেক তথ্যই আমরা জানি। চলুন আজ জেনে নিই কীভাবে হয়েছিল এই মহাদেশগুলোর নামকরণ।

❏ এশিয়া:

 পূর্বে রোমানরা এশিয়া বলতে দুটি প্রদেশ বোঝাতো। প্রথমত এশিয়া মাইনর, দ্বিতীয়ত এশিয়া মেজর। এশিয়া শব্দটি ৪৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হেরোডোটাস তার বই হিস্ট্রোসে ব্যবহার করেছিলেন। যদিও তখন তিনি এই শব্দটি দিয়ে ইজিয়ান সাগরের পূর্বদিকের ভূখণ্ডকে বুঝিয়েছিলেন। এশিয়া শব্দটি প্রাচীন গ্রিক শব্দ ‘Aσία’ থেকে এসেছে। আর এই গ্রিক শব্দটির মূলে রয়েছে ফিনিশীয় শব্দ ‘asu’, যার অর্থ পূর্ব এবং আক্কাডিয়ান শব্দ ‘asu’, যার অর্থ সূর্যের উদয়। এই হিসেবে এশিয়ার অর্থ দাঁড়ায় সূর্য উদয়ের দেশ।

❏ ইউরোপ:
ইউরোপ শব্দটি এসেছে ‘ইউরোপা’থেকে। ইউরোপা ছিলেন অতি সুন্দরী এক নারী, প্রথম দেখায় যার প্রেমে পড়ে যান দেবতা জিউস। তিনি সাদা ষাঁড়ের রূপ নিয়ে এসে তাকে অপহরণ করেছিলেন। ইউরোপা শব্দের উৎপত্তি নিয়ে দুটি মতবাদ রয়েছে। অনেকে মনে করেন ইউরোপা শব্দটির উদ্ভব আক্কাডিয়ান শব্দ ‘erebu’ থেকে, যার অর্থ অস্ত যাওয়া এবং ফিনিশীয় শব্দ ‘ereb’, যার অর্থ সন্ধ্যা ও পশ্চিমের সমন্বয়। অনেকের মতে, ইউরোপা শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘eurys’, যার অর্থ প্রশস্ত এবং ‘ops’, যার অর্থ মুখমণ্ডল থেকে এসেছে। এখানে ইউরোপার অর্থ দাঁড়ায় প্রশস্ত মুখমণ্ডল। তবে তখন ইউরোপ বলতে বোঝানো হয়েছিল বর্তমান তুর্কির একটি অংশকে।
❏ আফ্রিকা:
তৃতীয় পিউনিক যুদ্ধে রোমানরা কার্থেজ জয় করে নেয়। বর্তমান উত্তর আফ্রিকার অন্তর্গত তিউনেশিয়া সেই সময় কার্থেজ নামে পরিচিত ছিল। কার্থেজ জয় করার পর রোমানরা তাদের এই নতুন প্রদেশটির নাম দেন আফ্রিকা। তখন সেখানে বসবাস করতো আফ্রি নামক একটি গোত্র। ধারণা করা হয়, সেই গোত্রের নামানুসারে রোমানরা নতুন আবিষ্কৃত এই ভূখণ্ডের নাম দেন আফ্রিকা। যার অর্থ আফ্রিদের ভূমি বা দ্য ল্যান্ড অব আফ্রি। অন্য একটি দল মনে করেন, আফ্রিকা শব্দটি এসেছে ফিনিশীয় শব্দ ‘erebu’ থেকে। যার অর্থ ধূলা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ল্যাটিন প্রত্যয় ‘ereb’, যার অর্থ ভূমি। অর্থাৎ এখানে আফ্রিকা শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় ‘ধূলারভূমি’ বা ‘দ্যা ল্যান্ড অব ডাস্ট’। রোমানরা জয় করেছিল আফ্রিকার উত্তর দিকের অঞ্চল। মনে করা হয়, উত্তরের মরুভূমি এবং রুক্ষ-শুষ্ক আবহাওয়ার জন্য তারা এই অঞ্চলের এমন নামকরণ করে। পরবর্তীকালে ইউরোপীয়রা এই মহাদেশের অন্তর্গত অনেক অঞ্চলই আবিষ্কার করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোমানদের দেয়া নামটি স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর মানচিত্রে।
❏ উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা:
অ্যামেরিগো ভেসপুচি ছিলেন একজন নাবিক, যিনি ১৪৯৯ এবং ১৫০২ সালে ‘নতুন বিশ্ব’ভ্রমণ করেন। নতুন বিশ্ব বলতে তখন নতুন আবিষ্কৃত ভূখণ্ডকে (বর্তমান আমেরিকা) বোঝানো হতো। তিনি তার ভ্রমণ সম্পর্কে ১৫০২ ও ১৫০৪ সালে দুইটি বই লিখেন। এই বইগুলো তখন প্রায় সব ইউরোপিয়ান ভাষায় ছাপা হয়েছিল। ১৫০৭ সালে একজন জার্মান মানচিত্রকর মার্টিন ওয়াল্ডসিম্যুলার নতুন আবিষ্কৃত ভূখণ্ড যোগে নতুন করে পৃথিবীর মানচিত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তখন ভেসপুচির ভ্রমণ কাহিনী সম্পর্কে অবগত থাকলেও কলম্বাসের আবিষ্কার সম্পর্কে জানতেন না। তাই মানচিত্র তৈরির সময় তিনি নতুন আবিষ্কৃত সেই ভূখণ্ডটির নাম অ্যামেরিগো ভেসপুচির নামানুসারে করেন। ভেসপুচির নামটি ল্যাটিন ভাষায় উচ্চরণ ছিল ‘অ্যামেরিকাস ভেসপুচিয়াস’। তার নামানুসারে নতুন ভূখণ্ডটির নাম দেয়া হলো ‘দ্য ল্যান্ড অব অ্যামেরিকাস’ বা ‘অ্যামেরিকাসের ভূমি’। সংক্ষেপে আমেরিকা।
অ্যামেরিকা যখন নামকরণ করা হয়, তখন শুধু দক্ষিণের ভূখণ্ডটি (বর্তমান ব্রাজিল) আবিষ্কৃত হয়েছিল। পরবর্তীতে উত্তরের ভূখণ্ডটি আবিষ্কৃত হলে পুরোটাকে একত্রে আমেরিকা নাম দেয়া হয়। এই কাজটি করেন বিখ্যাত ভূগোলবিদ গেরার্ড মার্কেটর ১৫৩৮ সালে।
❏ অস্ট্রেলিয়া:

 ‘Terra Australis Incognita’ ল্যাটিন এই শব্দটির অর্থ দক্ষিণে অবস্থিত অপরিচিত ভূখণ্ড। দক্ষিণে অবস্থিত এক অপরিচিত ভূমির অস্তিত্বে বিশ্বাস করত প্রাচীন রোমানরা। এ নিয়ে অনেক গুজবও ছড়িয়েছিল তাদের মধ্যে। কিন্তু তারা কখনোই দক্ষিণ সেই অপরিচিত ভূখণ্ডের খোঁজে বের হয়নি। আর তাদের সমুদ্রের দীর্ঘ যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিও ছিল না। অবশেষে ইউরোপীয়রা আবিষ্কার করল দক্ষিণের সেই ভূখণ্ড এবং নাম দিল ‘Terra Australis’। অনেকেই তখন এই নামটিকে সংক্ষেপে অস্ট্রেলিয়া বলত। ১৮০৪ সালে ম্যাথিউ ফ্লিন্ডার্স নামের এই সংক্ষিপ্ত রূপটি ব্যবহারের পক্ষে জোর দিলেন। অনেক বছর এই সংক্ষিপ্ত রূপটি ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। পরে ১৮১৭ সালে গভর্নর ল্যাচল্যান ম্যাকিউরি নামটিকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব করেন। ১৮২৪ সালের পরে মহাদেশটির নাম হিসেবে অস্ট্রেলিয়া নামটি প্রতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পেল। প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যভাগ ও দক্ষিণাংশের দ্বীপসমূহকে একত্রে ওশেনিয়া বলা হয়। এই অঞ্চলকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা- মেলানেশিয়া, মাইক্রোনেশিয়া এবং পলিনেশিয়া। ওশেনিয়া নামকরণটি করেন বিখ্যাত ভূগোলবিদ কনরাড মাল্ট ব্রন।

❏ এন্টার্কটিকা:
এন্টার্কটিকা নামটির উৎপত্তি হয় গ্রিক শব্দ ‘এন্টার্কটিক’ থেকে। যার অর্থ উত্তর দিকের বিপরীতে। সত্যিই এটি হলো পৃথিবীর সব থেকে দক্ষিণের ভূখণ্ড। ধারণা করা হয়, জন জর্জ বার্থলোমিউ নামক স্কটিশ মানচিত্রকর সর্বপ্রথম এই নামটি ব্যবহার করেন। ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা এই তিন মহাদেশের যখন নামকরণ করা হয়েছিল, তখন এগুলো পুরোপুরি আবিষ্কৃত হয়নি। পরবর্তীতে নতুন নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে এই মহাদেশগুলোর পরিধি বাড়লেও নামের পরিবর্তন করা হয়নি।
babullalon@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

২০০০ সালে এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৫৯০ দুর্ঘটনার মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে কনকর্ড যুগের।

বাংলাদেশের সকল রাজবাড়ী ও জমিদার বাড়ীগুলির ইতিহাস ও বর্তমান অবস্হা কি (ভিডও সহ )