ইসলামে মানবাধিকার ও বর্তমান বিশ্ব
এ পৃথিবীতে ইসলামের আগমন ঘটেছে মানুষের অধিকার, মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য। মানুষ অন্য সব সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করবে- এটাই ইসলামের অভিপ্রায়। মানবাধিকার বিষয়ে ইসলামের শিক্ষাই সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষা। প্রত্যেক মানুষ অন্য মানুষকে তার নিজের মতোই মনে করবে, অন্যের অধিকারকে নিজের অধিকার মনে করবে, অন্যের পছন্দকে নিজের পছন্দ মনে করবে- ইসলাম সেই শিক্ষাই দিয়েছে। ইসলাম তার অনুসারীদের বলে, তোমাদের কেউ ততক্ষণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না নিজের ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করবে, যা পছন্দ করবে নিজের জন্য (বুখারি)। ইসলাম আরও বলে, তোমরা জান্নাতে যেতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা ইমান আনবে আর ইমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসবে (সহিহ মুসলিম)। ইসলাম আরও বলে, যে নিজেকে ইমানদার দাবি করে, সে যেন প্রতিবেশীর অধিকার রক্ষা করে (বুখারি, পর্ব :৭৮)।
এতিমদের সম্পদ গ্রাস না করতে ইসলাম বারবার তাগিদ দিয়েছে। মুসাফির, মেহমান, অসহায়, সহকর্মী, সহযাত্রী- কারও অধিকারের কথা বর্ণনা করতে ইসলাম কার্পণ্য করেনি। এক কথায় একজন মানুষকে জীবন চলার পথে যত মানুষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হতে হয়, প্রত্যেকের অধিকারের কথাই ইসলাম বলেছে (অধ্যয়ন করুন সুরা নিসা, বিশেষ করে প্রথম রুকু ও ৩৬ নম্বর আয়াত। সুরা বানি ইসরাইল, ২৬ নম্বর আয়াত)। ইসলাম আলল্গাহকে সিজদাহ করাকে যেমন ইবাদত গণ্য করে, ঠিক তেমনি ইবাদত গণ্য করে মানবাধিকারের প্রতি যত্নবান হওয়াকে। বিদায় হজের ভাষণে ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.) ঘোষণা করেন, 'আজকের এই মাস, দিন এবং শহর তোমাদের কাছে যেমন পবিত্র, ঠিক তেমনই পবিত্র তোমাদের একজনের কাছে আরেকজনের জীবন, সম্পদ ও সম্মান।' ইসলামের ঘোষণা, কেউ কারও অধিকার হরণ করলে আলল্গাহ তা ক্ষমা করবেন না, যতক্ষণ না যার অধিকার হরণ করা হয়েছে, সে ক্ষমা করে দেয়।
ইসলাম শুধু মুসলমানদের পারস্পরিক অধিকারের কথাই বলে না, অন্য ধর্মাবলম্বীদের অধিকারের প্রতিও যত্নবান হতে বলে। সেই শিক্ষা আমরা মুহাম্মদের (সা.) জীবন থেকে পাই। মদিনায় হিজরতের পর তিনি মদিনা সনদ তৈরির মাধ্যমে শুধু মুসলিমদের নয়, বরং সেখানকার সব ধর্ম ও গোত্রের মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যুদ্ধের ময়দানেও তিনি মানবাধিকারের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতেন। কোনো নারী, বৃদ্ধ কিংবা কোনো ঘরে আশ্রয় নেওয়া শত্রুকেও যেন আক্রমণ করা না হয়, সে ব্যাপারে তিনি অনুসারীদের কঠোরভাবে নির্দেশ দিতেন। সীমান্তে টহল দেওয়ার সময় জনৈক কাফের মুসলিম দলের হাতে নিহত হলে মহানবী (সা.) মুসলিম দলকে ভর্ৎসনা করেন এবং নিহতের ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেন। যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে তিনি এমনই মানবিক আচরণ করতেন যে, মুগ্ধ হয়ে তারা ইসলাম গ্রহণ করত। অথচ আজ বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে চরমভাবে। বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ খরচ করে তৈরি হচ্ছে মারণাস্ত্র।
অস্ত্রের পরীক্ষা যেন প্রতিযোগিতার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ইরাক-আফগানিস্তানে মানবতা বিপন্ন হচ্ছে। নিরস্ত্র-দুর্বল মানবগোষ্ঠী আজ অস্ত্রবাজদের নিপীড়নে জর্জরিত হচ্ছে। আজ ফিলিস্তিন ও মিয়ানমারের মুসলমানদের ওপর চলছে জাতিগত নিধনযজ্ঞ। ফিলিস্তিনের মুসলমানরা আজ নিজেদের ভূমিতে নিজেরাই পরাধীন। সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলো ফিলিস্তিনের বুকে। ১৯১৭ সালের সেই অভিশপ্ত বেলফোর ঘোষণা ফিলিস্তিনিদের বুকে যে বিষাক্ত তীর বিঁধিয়ে দিয়েছে, যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনের অসহায় জনগণকে সে বিষের আক্রমণ সহ্য করতে হচ্ছে।
ইহুদিরা প্রতিনিয়ত মুসলমানদের ভূমি দখল করে নিজেদের সীমানা বৃদ্ধি করছে, নির্বিচার হত্যা করছে ফিলিস্তিনি জনগণকে। তারা মুসলমানদের পবিত্র স্থান জেরুজালেমকে দখলে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র জেরুজালেমকে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করে মানবাধিকারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। এটা মানবাধিকারের প্রতি চরম উপহাস, যা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। যেখানে ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ, সেখানে তারা জীবনের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ জেরুজালেমকে কীভাবে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে মেনে নেবে? ট্রাম্পের এমন হঠকারী ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়াই বাধাগ্রস্ত করবে।
হাজার বছর ধরে নিজেদের ভূমিতে বসবাস করা একটি জাতিকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করে দেওয়ার জন্য কী ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে উঠেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী, তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়! বর্বরতার এমন কোনো রূপ নেই, যা মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেখায়নি। হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ হিংস্রতার সব রূপই তারা অতিক্রম করেছে। হাজার হাজার নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা হয়েছে নির্মম কায়দায়। এমএসএফ নামে একটি আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থার এক পরিসংখ্যান বলছে, গত আগস্ট মাসেই মিয়ানমার বাহিনী অন্তত ৬৭০০ রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করেছে।
এদের মধ্যে বিশাল সংখ্যক নারী-শিশু রয়েছে। জীবন বাঁচাতে নির্জন জঙ্গল পাড়ি দিয়ে, নদী সাঁতরে গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা। প্রাণ বাঁচাতে পালাতে গিয়ে অনেকের সলিলসমাধি ঘটেছে নাফ নদে। নাফ নদের দুই পাড় থেকে আজ কেবলই বিপন্ন মানবতার হাহাকার শোনা যাচ্ছে!
ফিলিস্তিন আর মিয়ানমারেই নয়, কাশ্মীর, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই এমনকি আমাদের বাংলাদেশেও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। কোথাও জাতিগত নিধন আর কোথাও রাজনৈতিক নিধনযজ্ঞ চলছে। এসব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ইসলামের সার্বজনীন মানবাধিকার শিক্ষার দিকে ফিরে তাকাতে হবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন