যোগ্য মানুষ গড়ে ওঠার জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।

 

শিশুরা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হলে দেশ এগিয়ে যাবে। জাতি এর সুফল ভোগ করবে। তাই বলা যায়-শিক্ষাই শক্তি, শিক্ষাতেই মুক্তি। যোগ্য মানুষ গড়ে ওঠার জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষাই হতে পারে দারিদ্র বিমোচনের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে-শিশুদের জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করার আগে শিশুর অন্তনির্হিত অপার বিস্ময়বোধ, অসীম কৌতুহল, আনন্দবোধ ও অফুরন্ত উদ্দমের মতো সর্বজনীন মানবিক বৃত্তির সুষ্ঠু বিকাশ এবং প্রয়োজনীয় মানসিক ও দৈহিক প্রস্তুতি গ্রহণের পরিবেশ তৈরী করা প্রয়োজন। তাই তাদের জন্য বিদ্যালয় প্রস্তুতিমূলক প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা জরুরী।
অন্যান্য শিশুর সঙ্গে একত্রে এই প্রস্তুতিমূলক শিক্ষা শিশুর মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। এছাড়া প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কৌশল সম্পর্কে বলা হয়েছে, শিশুদের স্বাভাবিক অনুসন্ধিৎসা ও কৌতুহলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তাদের স্বাভাবিক প্রাণশক্তি ও উচ্ছাসকে ব্যবহার করে আনন্দময় পরিবেশে মমতা ও ভালবাসার সঙ্গে শিক্ষা প্রদান করতে হবে। শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে যেন তারা কোনোভাবেই কোনোরকম শারিরীক ও মানসিক অত্যাচারের শিকার না হয়।



অন্যসব বইয়ে যেসব বিষয় দেয়া হয়েছে তা শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়াবাড়ি বলেই মনে হয়। বই যেমন কঠিন, পরিক্ষার প্রশ্ন আরো কঠিন। কোমলমতি এসব শিশুদের গাইড দেখলে আমরাও অবাক হয়ে ওঠি। এত ছোট শিশুদের এত কঠিন পরিক্ষা কেন নেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলা ইংরেজী গ্রামার বিষয়ক যেসব প্রশ্ন তাদের জন্য দেয়া হয় মোটেও তারা সেজন্য উপযুক্ত নয়। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে আমরা অনেক প্রশ্নের উত্তর চাইতে পারি। আসলে শিক্ষার কী উদ্দেশ্য কেনই বা শিক্ষা অর্জন করতে হবে এসব নিয়ে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নতুন করে ভাবতে হবে।জাতীয় শিক্ষানীতিতে আরও বলা হয়েছে-প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো শিশুর মনে ন্যায়বোধ, কর্তব্যবোধ, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, কৌতুহল, প্রীতি, সৌহার্দ্য, অধ্যাবসায় ইত্যাদি নৈতিক ও আত্মিক গুণ অর্জনে সহায়তা করা এবং তাকে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিমনষ্ক করা, কুসংস্কারমুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠতে উৎসাহিত করা। প্রাথমিকের পড়ালেখায় অভিবাবকরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারছে না। সবগুলো ক্লাসে অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা। পড়া এবং পরিক্ষা নিয়ে ছাত্ররা থাকে উদ্বিগ্ন। শরীরের ওজনের চেয়ে বইয়ের ওজন বেশী। বিশেষ করে পঞ্চম শ্রেণীতে গণিত সমাজ বিজ্ঞান ইংরেজী প্রভৃতি বই পর্যালোচনা করলে অবাক হতে হয়। পঞ্চম শ্রেণীর গণিতে যেসব বিষয় রয়েছে তাতে অভিভাকই বিষ্মিত ও আতংকিত।
সরকারি স্কুলের বাইরে বেসরকারি স্কুল গুলোতে বোর্ডের বই ছাড়াও তথাকথিত সহায়ক বইয়ের অসহনীয় চাপে থাকে শিশু শিক্ষার্থীরা। সহায়ক বইয়ের কারণে একদিকে শিশুদের বইয়ের বোঝা বাড়ছে, অভিভাবকদের আর্থিক বোঝাও বাড়ছে। অবশ্য অনেকের দাবি, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে থাকতে শিশু বয়স থেকেই সব বিষয়ে ধারণা দিতে সহায়ক বই। যে বয়সে শিশুর বইয়ের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার কথা, ক্ষেত্র বিশেষে বই ছেড়ার কথা, সেই বয়সেই পাচঁ থেকে সাতটি বই পড়তে দিয়ে শিশুকে একেবারে বইয়ের ভারে ন্যুব্জ করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শিশুদের ব্যাগের ওজন বাড়ছে, শরীরের ওজন কমছে। জীবন থেকে শৈশব কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এই যে শক্তিমান মানুষ বানানোর মাত্রাতিরিক্ত উদ্যোগ, সেটা কতটুকু সুফল বয়ে আনছে? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, শিশুদের মানুষ করার ব্যাপারে যতটা আগ্রহ আমাদের, তার থেকে বেশী আগ্রহ অভিবাবক হিসেবে কতটা সামর্থ্যবান, সেটা জাহির করার। এভাবে চলছে অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগীতা, যার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।
বিশ্বায়নের দোহাই দিয়ে ক্রমাগত প্রতিযোগীতার চাপ ও ভিনদেশি ভাষার ওপর নির্ভরতা আমাদের নতুন প্রজন্মকে সত্যি সত্যিই পঙ্গু করে দিচ্ছে কি না ভাবা দরকার। কোমলমতি শিশুর মন বেঝার জন্য কোনো সময় কী আদৌ আমরা দিয়েছি! না নিজেদের অযোগ্যতার কারণে উচ্চাভিলাষ পূরণ হয়নি বলে অনেকে কোমলমতি শিশু সন্তানদের নামিয়ে দিচ্ছেন রেসের ময়দানে! সেই দৌঁড়ে তারা হাপিয়ে ওঠছে, তলিয়ে যাচ্ছে। সমাজ বাস্তবতায় প্রতিযোগীতার ধরন দেখে মনে হয়- এটাই যেন সাফল্য অর্জনের একমাত্র পথ। প্রতিযোগীতাহীন জীবন ব্যার্থ, নি:স্ব, হতাশায় আচ্ছন্ন। এটা আমরা কেন ভাবি না যে প্রকৌশলী, চিকিৎসক বা পেশাজীবি হওয়ার আগে অবশ্যই একজন ভালো মানুষ হওয়া দরকার।
লেখাপড়ার অসহনীয় চাপ শিশু শিক্ষার্থীদের সুপ্ত মেধাকে কোণঠাসা করে দিচ্ছে। দিনের পর দিন এভাবে চলতে থাকলে সৃজনশীলতার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। আমরা কী একজন সার্টিফিকেট সর্বস্ব মানুষ চাই? জীবনে সফল হওয়ার অভিপ্রায় থাকা দোষের নয়, তবে মাত্রাহীন উচ্চাভিলাষ কাম্য নয়। শিক্ষা বলতে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক অর্জন বা সাফল্য নয়। এর বাইরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। যেমন-শিশুদের মানসিকতার বিকাশ, মানবিক মূল্যবোধ, সামাজীকিকরণ ইত্যাদি।
শিশুর বেড়ে ওঠা নীতি-নৈতিকতা বা মূল্যবোধর বিকাশের প্রাথমিক স্তর হলো পরিবার। পারিবারিক পর্যায়ে মূল্যবোধ সম্পর্কে শিশুর ধারণা পরিণত বয়সে তার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ভূমিকার ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়। ক্ষুদ্র পারিবারিক গন্ডির বাইরে ব্যাক্তির বৃহত্তর ভূমিকা, নাগরিক দায়িত্ববোধ, মতামত, ন্যায়পরায়নতা ও আত্মবিশ্বাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাক্তির মানসে প্রোথিত হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাক্তির প্রাতিষ্টানিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। অনেক ক্ষেত্রেই নার্সারি কিন্ডারগার্ডেনে মানসম্পন্ন অবকাঠামো ও শিক্ষার পরিবেশ নেই। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষক, গ্রন্থাগার, নেই পর্যাপ্ত খেলার মাঠ।

এ অবস্থায় শিশুর মানসিক বিকাশ কীভাবে সম্ভব?

একটি সুসজ্জিত দালানের মধ্যেই কেটে যাচ্ছে তার শিশুকাল। আধুনিকতার ছোয়া হয়তো কিছুটা পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু মাটির গন্ধ, দুরন্ত শৈশব থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে আজকের শিশু। এভাবে শিশুরা ক্রমেই গৃহ বন্ধি হয়ে পড়ছে। শিশুদের খেলাধুলার সুযোগ সংকুচিত হয়ে পড়ায় টেলিভিশন, কম্পিউটার আর ভিডিও গেমস তাদের বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। সীমাবদ্ধ গন্ডির ভিতর বেড়ে উঠায় তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এসব বিষয় বিবেচনায় না নিয়েও আমরা অহনির্শ এ প্রত্যাশায় করি যে পরিবারকে আনন্দিত করার মানসে নির্দিষ্ট সময় আমার সন্তান যেন উত্তম ফলাফলের একটা শীট নিয়ে হাজির হয়। বইয়ের চাপে, মানসিক চাপে, সন্তানের মেরুদন্ড একটু বেকে গেলেও অভিবাবকের মেরুদন্ড শক্তিশালী করার আনন্দে ভরিয়ে দেওয়ায় চলে মিষ্টি বিতরণের উৎসব।
এরপরে আবারো প্রত্যশা, আবারো ফলাফল। অবুঝ শিশুমনের উপর এসব চাপ সহ্য করে শিশুটি আবার ঘুরে দাঁড়াবে এমন প্রত্যাশা ভাবতে অবাক লাগে। সন্তানের পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে আমরা যত মাতামাতি করি, তাদের স্বাস্থ্য ও মানসিক বিকাশ নিয়ে ততটা চিন্তিত নই। আমরা চাই আমার সন্তান যেন অন্য অনেকের চেয়ে অধিক সফলতা অর্জন করে। এ জাতীয় চিন্তা ও চেতনায় আজকের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে বলে আমি মনে করি। এসব চিন্তার অবসান হলেই সমাজের জন্য মঙ্গল।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

The national flag Cambodia

world map

TOP 10 REASONS TO VISIT THAILAND