সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষতা অর্জনে কারিগরি শিক্ষা



বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর ( ব্যানবেইজ) তথ্য থেকে দেখা যায় যে, ২০০৮ সালে এসএসসি স্তরে মাত্র ১২% শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষা জীবনের পরবর্তী ধাপে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে। ২০০৮ সালে এসএসসি পরীক্ষায় যেসব শিক্ষার্থী অবতীর্ণ হয়েছিল তাদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ১০ বছর আগে ১ম শ্রেণিতে ভর্তির মাধ্যমে। এসময় সর্বমোট ৪৩ লক্ষ শিক্ষার্থী এই শিক্ষা অভিযাত্রায় অংশ নেয়। ১ম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া এই ৪৩ লক্ষ শিক্ষার্থী দশম শ্রেণিতে এসে ৭ লক্ষ ৪০ হাজারে পরিণত হয় এবং এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। সবশেষে ৫ লক্ষ ৩০ হাজার শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। অর্থাত্ ১ম থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী সংখ্যার অগ্রগতি হার (Progression Rate) মাত্র ১২% আর ঝরে পড়ার হার (Dropout Rate) ৮৮%। এটিই আমাদের শিক্ষার বাস্তব চিত্র। কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলো ক্ষুদ্রতর ১২% নিয়ে আমাদের উল্লাসের শেষ নেই, অথচ বৃহত্তর ৮৮% নিয়ে কার্যকর কোনো উত্কণ্ঠা নেই, উদ্যোগও নেই।


২০৩০ সাল; যুগপত্ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের বাংলাদেশ। কী তাত্পর্য এই সালে? 

১৯৫০ থেকে ২০৫০ পর্যন্ত শতাব্দিকালের পরিক্রমায় ২০৩০ সালটি হবে আমাদের জন্য অতীব তাত্পর্যপূর্ণ যখন কর্মক্ষম ও নির্ভরশীল জনসংখ্যার অনুপাতটি (Least Dependency Ratio) হবে সর্বনিম্ন। এসময়ে আমাদের মোট জনসংখ্যা হবে ১৮ কোটি, যার মধ্যে কর্মক্ষম জনসংখ্যা (১৫-৬৫ বছর) ১২ কোটি আর নির্ভরশীল জনসংখ্যা (১৫ বছরের নিচে এবং ৬৫ বছরের উপরে) হবে ৬ কোটি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০০৯ সালের কর্মসংস্থান জরিপ রিপোর্ট মোতাবেক বর্তমানে আাামাদের কর্মক্ষম জনসংখ্যা ৯ কোটির কিছু বেশি যা আগামী ১৮ বছরের ব্যবধানে এক তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি হতে যাচ্ছে। এই বিপুল কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে যদি আমরা জনসম্পদে রূপান্তর করতে পারি তাহলে তা হবে আমাদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ, যা আমাদের জাতীয় সমৃদ্ধিকে তরান্বিত করবে। পক্ষান্তরে এই বিপুল কর্মক্ষম নাগরিকের কর্মসংস্থান করতে না পারলে তা অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার সংকট সৃষ্টি করবে। 
বর্তমানে আমাদের ১৩২ টি দেশে জনশক্তি রপ্তানী হচ্ছে। প্রতি বছরে শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের রপ্তানী চাহিদা প্রায় ৫০ লক্ষ। বিদেশে বৈধভাবে কর্মরত জনসংখ্যা আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪%। বিদেশে গমনকৃত জনশক্তির মধ্যে আধা দক্ষ ও অদক্ষ জনসংখ্যার হারই প্রধান। নগন্য সংখ্যক প্রফেশনাল ও দক্ষ জনশক্তি রপ্তানী হচ্ছে । দক্ষ ও যোগ্যতা সম্পন্ন জনশক্তির চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে যা একই সাথে উচ্চ রেমিটেন্স অর্জন ও দেশের ইমেজ বৃদ্ধিতে সহায়ক।

বিশ্ব নাগরিকত্বের যোগ্যতা অর্জন- বিশ্ব নাগরিক হচ্ছেন সেই সচেতন ব্যক্তি যিনি অন্তর্নিহিত সকল মানবিক সামর্থকে জানেন, বুঝেন ও উচ্চকিত করেন। আমরা একটি সহজ সূত্রের সাহায্যে বিশ্ব নাগরিকত্বকে সংজ্ঞায়িত করতে পারি;


বিশ্বায়ন+বিশ্ব শ্রম মার্কেটের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা= বিশ্ব নাগরিকত্ব।

বিশ্ব নাগরিকত্ব অর্জণে আমাদের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে পাঠ্যপুস্তক নির্ভর গ্রাজুয়েট তৈরীর শিক্ষা ব্যবস্থা, সৃজনশীল মননে দুর্বলতা এবং দক্ষতা উন্নয়নে সীমাবদ্ধ উদ্যোগ। এর ফলে শিল্পখাতের উত্পাদনে আমাদের জনশক্তির অবদান মাত্র ১১১ ডলার যা জাপানে ১০,৭৯৪ আর মালয়েশিয়ায় ২৬৬১ এবং ভারতে ১৮৩। অর্থাত্ জনশক্তির দক্ষতাগত তারতম্যের কারনে আমরা জাতীয় উত্পাদনে ভারতের তুলনায় মাত্র ৬০%, মালয়েশিয়ার তুলনায় মাত্র ৪% আর জাপানের তুলনায় মাত্র ১% অবদান রাখতে পারছি। জাতীয় উন্নয়ন ও উত্পাদনকে তরান্বিত করতে হলে জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করার কোনো বিকল্প নেই। আর সেই প্রয়োজন পুরণের জন্যই আমাদের কর্মক্ষম প্রতিটি মানুষকে উত্পাদনে দক্ষ এবং সৃজনশীল করে গড়ে তুলতে হবে। একবিংশ শতাব্দির জ্ঞান,বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিময় এ বিশ্বে গ্লোবাল সিটিজেন বা বিশ্ব নাগরিকত্বের যোগ্যতা অর্জন যে কোনো দেশের তরুন ও কর্মক্ষম জনসংখ্যার জন্য ক্রমশঃ গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য হয়ে উঠছে।
এই মুহূর্ত আমরা কি করতে পারি ?

আমাদের মাইন্ড সেটের পরিবর্তন অপরিহার্য। প্রথাগত ও প্রচলিত ধারণা হলো কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা শুধুমাত্র অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য। কিন্তু এ ধারণা বস্তুনিষ্ঠ নয়। কারিগরি-বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা আমাদের সৃজনশীল দতা বৃদ্ধির জন্য এক কার্যকর পদ্ধতি যা গ্রহণ করে আমরা দক্ষ, যোগ্য ও বিশ্ব নাগরিকে পরিণত হতে পারি। বদলে দিতে পারি আমাদের কেরিয়ার ভাবনা। আমরা হতে পারি দেশের ও বিশ্ব শ্রম বাজারের একজন সফল ও সম্ভাবনাময় নাগরিক।


একজন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নবম শ্রেণিতে এসএসসি ভোকেশনাল শিক্ষাক্রম গ্রহণ করতে পারে । এখানে সে সাধারণ শিক্ষার সমমান অর্জন ছাড়াও ৪৩ টি ট্রেডের মধ্য থেকে পছন্দের ট্রেডে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পাবে,যা তাকে সাধারণ শিক্ষা থেকে অনেক বেশী সৃজনশীল ও দক্ষ নাগরিকে পরিণত করবে। এসএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীগণ জাতীয় দক্ষতামান অর্জনসহ এইচএসসি ভোকেশনাল কোর্স বা ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে ভর্তি হতে পারবে। উভয় কোর্স শেষে সংশ্লিষ্ট উত্তীর্ণরা সরাসরি কর্মক্ষেত্রে যোগদান অথবা প্রকৌশল শাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাবে। কর্মক্ষম বেকার শিক্ষিত যুব যুবাগণ ৬ মাস মেয়াদি বিভিন্ন শর্ট কোর্স সম্পন্ন করে জাতীয় দক্ষতা স্তরের জনশক্তি হিসেবে দেশে বিদেশে কর্মসংস্থানের সূযোগ পাবে।

ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থী, কর্মক্ষম নাগরিকের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি ও বর্ধিত হারে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জণ এবং বিশ্ব নাগরিকে রূপান্তরে কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা যা বাংলাদেশকে ২০৩০ এর সম্ভাবনার স্বর্ণদুয়ারে পৌছে দিতে পারে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

২০০০ সালে এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৫৯০ দুর্ঘটনার মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে কনকর্ড যুগের।

বাংলাদেশের সকল রাজবাড়ী ও জমিদার বাড়ীগুলির ইতিহাস ও বর্তমান অবস্হা কি (ভিডও সহ )