‘ক্রপ সার্কেল’যে রহস্যের সমাধান আজো হয়নি ! ‘ক্রপ সার্কেল’
‘ক্রপ সার্কেল’যে রহস্যের সমাধান আজো হয়নি ! ‘ক্রপ সার্কেল’
পৃথিবীতে রহস্যের শেষ নেই। অনেক রহস্যেরই কোনো কূলকিনারা পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার পথে এসব রহস্য, গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর না মেলার এক ভাণ্ডার। এমনই এক রহস্য ক্রপ সার্কেল।
শস্যক্ষেতের মাঝে নানান বিচিত্র নকশার বিরাট বিরাট চিত্রকর্ম এগুলো। খুবই বিদঘুটে নকশা যেমন অাঁকা রয়েছে, তেমনি রয়েছে চোখধাঁধানো নকশাও। এই চিত্রকর্মের উপকরণ সেই মাঠের শস্য গাছগুলো। এ ভেবেই বিস্ময় জাগে অদ্ভুত নকশাগুলো, তবে অাঁকল কে।
ক্রপ সার্কেল অাঁকা হয়েছে এমন শস্য গাছগুলোর বেশির ভাগই ভুট্টা, গম বা যব। এ নকশাগুলো করা হয়েছে নিখুঁত জ্যামিতিক নকশায়। এ ধরনের আর্ট কেবল পরিকল্পনা মাফিকই করা সম্ভব। তবে এ নকশাগুলো নিচ থেকে দেখে বুঝা যাবে না। এই অত্যাশ্চর্য নকশাগুলো দেখতে হলে বেশ অনেকটা উপর থেকে দেখা চাই। পৃথিবীতে অসংখ্য ক্রপ সার্কেল রয়েছে। তবে সবগুলো শস্যচক্র শিল্পীরা শনাক্ত করতে পারেনি। আর এটাই বড় ধরনের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অনেকেই বলে থাকেন কিছু কিছু ক্রপ সার্কেল যে শিল্পী তৈরি করেছেন তারা মানুষের চেয়েও অনেকাংশে মেধাবী। বিজ্ঞান ও শিল্পকলায় তারা মানুষকেও ছাড়িয়েছে। আর এটাই রহস্যমাখা প্রশ্ন হয়েছে, তবে কি তারা মানুষ নয়, ভিনগ্রহের প্রাণী? অবাক শোনা গেলেও এ নিয়ে কিন্তু তর্ক-বিতর্ক রয়েই গেছে।
সে যাই হোক, ক্রপ সার্কেল কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক ও জ্যামিতিক নকশার এক অবাক প্রদর্শনী। ক্রপ সার্কেল তৈরি করতে হলে প্রথম দিকে ফসলের মাঝে কাটা এই নকশাগুলো সোজা সরল জ্যামিতির প্যাটার্ন যেমন- বৃত্ত, চৌকানা বাক্স এসবের মাঝেই সীমিত ছিল। তবে ধীরে ধীরে দেখা গেল যে শস্যচক্রগুলো সরল থেকে অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করছে।
ক্রপ সার্কেলের রহস্য একেবারেই নতুন কিছু নয়। বেশকয়েক যুগ আগে থেকেই এ নিয়ে আলোচনা হয়ে এসেছে। তাই বলা যেতেই পারে রহস্যময় ক্রপ সার্কেল বা শস্যচক্রের আবির্ভাব কোনো নতুন ঘটনা নয়। অনেক পুরনো ক্রপ সার্কেল সে কথাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। ইতিহাস বলে, সপ্তদশ শতক থেকেই এর দেখা পাওয়া গেছে। ক্রপ সার্কেলের ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। মাত্র বছর চলি্লশের আগের ঘটনা। ১৯৭০ সালের দিকে প্রথম এ ধরনের নকশা নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে।
বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে শুধু নির্দিষ্ট কিছু ফসল মাড়িয়ে নিয়ে এ নকশা তৈরি করা হয়। তবে সমস্যা হলো এসব শস্যচক্রের শিল্পীদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। যদিও সেই মোয়িং ডেভিল কোনো রহস্যময় ঘটনা ছিল না। এর ব্যাপক আবির্ভাব সাম্প্রতিকই বলতে হবে। ক্রপ সার্কেল বিংশ শতকের আগে খুব একটা দেখা যেত না, সত্তর দশকের পর থেকে প্রচুর পরিমাণে দেখা গেছে এবং মিডিয়ায় এসেছে। এর প্রধান কারণ আকাশ থেকে শস্যভূমি দেখার সুযোগ এর আগে তেমন ছিলই না। আকাশে ভাসার এত আয়োজন ছিল না বলেই চট করে কারও চোখে ধরা পড়েনি ক্রপ সার্কেল। হয়তো এত আগে হেঁটে ক্রপ সার্কেল পেরিয়ে গেছেন অনেকে, কিন্তু টেরই পাননি অদ্ভুত নকশার ক্রপ সার্কেল মাড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি।
পৃথিবীর যে জায়গাগুলোতে সবচেয়ে বেশি ক্রপ সার্কেলের দেখা মিলেছে তার মধ্যে অন্যতম ইংল্যান্ড। এখানেই অধিক সংখ্যক শস্যচক্র দেখা যায়। তবে ইংল্যান্ড ছাড়াও দেখা যায় ইউরোপের অন্য দেশ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায়। বাংলাদেশসহ এর প্রতিবেশী দেশগুলোতে এখনো ক্রপ সার্কেলের দেখা মেলেনি। উন্নত প্রযুক্তির ক্যামেরা ও স্যাটেলাইট আবিষ্কারের ফলে আকাশ থেকে ছবি পাঠানো এখন সহজলভ্য হওয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নতুন আবিষ্কৃত ক্রপ সার্কেল এখন নেই বললেই চলে। তবে সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ায় শস্যচক্র পাওয়া গেছে।
ক্রপ সার্কেল মানুষ যেমন জেনে-বুঝে তৈরি করেছে তেমনি রয়েছে অজ্ঞাত নকশাকারীর তৈরি শস্যক্ষেত। অবাক হতে হয় এটা ভেবে, কে বা কারা এসব ক্রপ সার্কেল তৈরি করেছে। আর এসব তৈরি করার কারণটাই বা কী? তাই এসব শস্যচক্রকে রহস্যময় ভাবার উপযুক্ত কারণ আছে। বলা হয়ে থাকে, মাত্র এক দিনে কোনো ক্ষেতে শস্যচক্রের দেখা মিলেছে। কৃষক হয়তো সারাদিন ক্ষেতে কাজ করে রাতে ঘুমিয়েছেন, পরদিন ভোরে ঘুম থেকে ওঠে আবিষ্কার করলেন যে তার মাঠে বিশাল আকারের বিচিত্র সব নকশা! মাত্র এক রাতেই তৈরি এমন শস্যচক্র, এ নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন উঠেছে। যেন আকাশ থেকে কেউ নেমে এসে কয়েক কিলোমিটারব্যাপী এসব ক্রপ সার্কেল তৈরি করে গেছে। এটা যতটা অবাক করে তার চেয়ে কোনো অংশে কম অবাক করে না এসব ক্রপ সার্কেলের জটিল ও চোখধাঁধানো নকশা। রহস্য জেগে থাকে একটি প্রশ্ন নিয়েই। কে অথবা কারা এই প্রতিভাবান রহস্যময় শিল্পী?
তাদের পরিচয় যেমন জানা নেই তেমনি জানা নেই কেন এ নকশাগুলো করা হয়েছে। তারা কেন ও কী উদ্দেশে এ নকশাগুলো ফসলের ক্ষেতে তৈরি করে দিয়ে যায়। এসব প্রশ্নের উত্তর আজও সঠিকভাবে মেলেনি। তবে এলিয়েন তত্ত্ব সবচেয়ে আগ্রহ জাগিয়েছে। আজ যেমন আমরা ক্রপ সার্কেলের রহস্য নিরূপণ করতে ব্যর্থ হচ্ছি, ঠিক তেমনি হাজার বছর ধরে ক্রপ সার্কেলকে এ রকম অলৌকিক কোনো বিষয় হিসেবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন প্রায় সবারই ধারণা ছিল যে এমন বড় আকারের বিচিত্র নকশা মানুষের পক্ষে রাতারাতি এমন অল্প সময়ে সম্ভব নয়। কাজেই ধরে নেওয়া যায় যে অন্য গ্রহের প্রাণীরা রাতের বেলা এসে এসব নকশা এঁকে যাচ্ছে। তারা এ নকশাগুলো সবার অলক্ষ্যে এঁকে দিয়ে আসলে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে এমনটাই দাবি করা হয়। পৃথিবীর মানুষ যেমন মহাশূন্যে বিভিন্ন প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াচ্ছে, ঠিক তেমনি তারাও হয়তো অন্য গ্রহবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছে। আর সে কারণেই তারা এঁকে দিয়ে যাচ্ছে ক্রপ সার্কেল। ভিনগ্রহবাসীরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে চায়, তার তাদের ভাষা হয়তো নকশা।
কারও কারও মতে, অস্বাভাবিক ও বিরল প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রহস্যময় অজানা কোনো শক্তি যেমন প্লাজমা ভোর্টেঙ্ এসবের কারণ হতে পারে। এমন অসংখ্য যুক্তিতর্ক উপস্থাপিত হয়েছে বিভিন্নজনের কাছ থেকে। আবার কেউ কেউ দাবি করেন যে, ক্রপ সার্কেল আসলে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের চিহ্ন। সুদূর অতীতে বয়ে যাওয়া কোনো ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথাই এখানে এঁকে রাখা হয়েছে। অনেকে আবার এর অকাট্য প্রমাণ হিসেবে শস্যচক্র এলাকার বিভিন্ন অস্বাভাবিক ঘটনার উপকরণ জোগাড় করেছেন।
তবে ১৯৯১ সালে চমকপ্রদ মোড় আসে ক্রপ সার্কেল নিয়ে রহস্যের। ডগলাস বাওয়ার ও ডেভিড শোরলি নামের দুই ইংরেজ দাবি করেন যে, ১৯৭৮ সাল থেকে ইংল্যান্ডের বেশকিছু শস্যচক্র তাদেরই শিল্পকর্ম। শুধু মৌখিক দাবিই নয়, তারা রীতিমতো হাতে-কলমে করে দেখিয়ে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দিলেন। তারা দেখালেন যে, মাত্র দুজন লোক মিলেই অল্পকিছু সরল যন্ত্রপাতির সাহায্যে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মাঝে অসাধারণ সব নকশা ফসল কেটে তৈরি করে ফেলা যায়। পুরো ব্যাপারটা আসলে খুবই সোজা। মাঠের মাঝে একটি কেন্দ্র স্থির করে তাতে খুঁটির সঙ্গে বড় দড়ি লাগাতে হয়। এরপর ফসল কেটে নুইয়ে ফেলার জন্য নির্দিষ্ট মাপে তৈরি সরল যন্ত্র নিয়ে খুঁটি কেন্দ্র করে ঘুরতে হয়। কাটা পড়তে থাকে ফসল, সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হতে থাকে বিচিত্র তাক লাগানো সব নকশা। তবে এ নিয়ে গবেষণা থেমে নেই।
আমেরিকার ক্যামব্রিজ শহরে বিএলটি নামের একটি প্রতিষ্ঠান এ ধরনের গবেষণা করে যাচ্ছে। তারা তথ্য উপস্থাপন করেন যে, মানুষে বানানো শস্যচক্র এবং আসল শস্যচক্রের মাঝে বেশকিছু অমিল পেয়েছে, যার কোনো লৌকিক ব্যাখ্যা তারা করতে পারছেন না। যেমন, আসল শস্যচক্রের নুইয়ে পড়া শস্যে যে জায়গায় ভাঙে সে জায়গাটি সরু হয়ে লম্বাটে আকার ধারণ করে, যা মানুষ ভাঙলে তেমন হওয়ার কথা নয়। কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যে শস্যের সে জায়গা ফুলে-ফেটে গেছে যা মাইক্রোওয়েভ জাতীয় কোনো তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের শক্তির পক্ষেই সম্ভব। সাধারণ বাগান করার জিনিস দিয়ে সম্ভব নয়। তবে অনেকেই বিশ্বাস করেন, এগুলো কোনোভাবেই মানুষের তৈরি নয়। তবে এ রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি। –
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন