পাচারকৃত শিশু-কিশোরদের শতকরা ৯০ জনকেই জোরপূর্বক দেহব্যবসায় নামানো হচ্ছে।

বাংলাদেশ থেকে বছরে কত লোক বিদেশে পাচার হচ্ছে তার প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে এখনো মতভিন্নতা রয়েছে। তবে এ সংখ্যা যে সন্তোষজনক নয় তা যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি প্রকাশিত মানব পাচার সংক্রান্ত প্রতিবেদন ও ভারত সরকারের দেওয়া তথ্য থেকে বোঝা যায়। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ‘ট্রাফিকিং ইন পার্সনস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাচার রোধে বাংলাদেশ ‘টায়ার-২’ এ অবস্থান করছে। যার অর্থ, পাচার বন্ধে বাংলাদেশ ন্যূনতম মাপকাঠিও পূরণ করতে সক্ষম হয়নি। 



অন্যদিকে ভারতে যৌনবাণিজ্যে বাংলাদেশি নারীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দিল্লি সরকার। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের তথ্যে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ পাচারের শিকার হচ্ছে। আর বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্যে এ সংখ্যা ২০ হাজার। ভারতের ‘টাইমস অব ইন্ডিয়ায়’ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫০ হাজার লোক পাচারের শিকার হচ্ছে। ‘ট্রাফিকিং ইন পার্সনস’ শীর্ষক কিছু দিন আগে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পাচার রোধে বাংলাদেশ ‘টায়ার-২’ এ অবস্থান করছে। 


যদিও এ জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে সংশ্লিষ্টদের পাচারের শিকার ব্যক্তিদের শনাক্তকরণে যথাযথ ব্যবস্থা জানা নেই। এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ হচ্ছে মানবপাচারের উৎসস্থল এবং এ দেশ থেকে পাচার হওয়া নারী-পুরুষ ও শিশুরা জোরপূর্বক শ্রম ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে ভারত ও পাকিস্তানে পাচার হওয়া নারী-শিশুদের যৌন ব্যবসার শিকার হতে হচ্ছে। 



এ দেশ থেকে রোহিঙ্গাদের পাচার হওয়ার ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় মা-বাবারা চিংড়ি ঘেরের জন্য নেওয়া ঋণের টাকা শোধ দিতে শিশুদের বিক্রি করছেন। আর এ শিশুরা পরে পাচারের শিকার হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক এবং দুর্বল সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পাচারের ঘটনার জন্য দায়ী। পাচারে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে চারটি রিক্রুটিং এজেন্সির লাইন্সেস বাতিল করে। অন্যদিকে ভারতে যৌনবাণিজ্যে বাংলাদেশি নারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দিল্লি সরকার। আর যৌনবাণিজ্যে যোগ হওয়া বাংলাদেশি নারীদের প্রায় সবাই পাচারের শিকার হয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা গণমাধ্যমে উল্লেখ করে। এ নিয়ে ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশনও অস্বস্তিতে রয়েছে। 

ভারত সরকারের এক তথ্যে জানা যায়, মুম্বাইয়ের বিভিন্ন যৌনপল্লী থেকে দেড়শ এবং দিল্লির যৌনপল্লী থেকে ৮০ জন বাংলাদেশি নারীকে উদ্ধার করে এ দুই শহরের বিভিন্ন পুনবার্সন কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। কমিশন সূত্রে জানা যায়, জাতীয়তা নিশ্চিত করে সেই নারীদের বাংলাদেশে পাঠানো এখন সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। গত তিন বছরে ভারতের বিভিন্ন শহরের যৌনপল্লী থেকে উদ্ধারের পর দেড়শ বাংলাদেশি নারীকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এদের ভালো চাকরি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে পাচার করা হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মিজোরাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের ৪ হাজার ৯৬ কি.মি. সীমান্ত রয়েছে। ইতিমধ্যে সীমান্ত দিয়ে পাচার রোধে একটি নির্দেশনা জারি করেছে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এদিকে বেনাপোলের পুটখালী সীমান্তপথে ১০ অক্টোবর রাতে ভারতে পাচারের সময় ২৩ নারী-পুরুষ ও শিশুকে আটক করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি-২৩)। জানা যায়, পাচারকারীরা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এদের ভারতে পাচার করছিল। অভিযানের সময় পালিয়ে যাওয়ার জন্য পাচারকারীদের আটক করা সম্ভব হয়নি।



পাচারের শিকার নড়াইলের তরুণী কানন (রুপক নাম) জানান, বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই টাকার লোভে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাকে বিক্রি করে দেয়। ক্রেতারা তাকে নিয়ে যায় মুম্বাইয়ের এক পতিতালয়ে। সেখানে তিনি ছিলেন দীর্ঘ চার বছর। ভারতীয় পুলিশের সহায়তায় বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি কর্তৃপক্ষ (বিএনডব্লিউএলএ) কাননকে দেশে ফিরিয়ে আনে। এ সংস্থার সেইফ হোমে কানন জানান, বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে তাকে পাচার করা হয়। পরে মুম্বাইয়ের পতিতালয়ে। জোরপূর্বক দেহব্যবসায় বাধ্য করা হয় তাকে। রাজি হওয়ার জন্য তার ওপর নির্যাতনও চালানো হয়।

ইউএনডিপির তথ্য : এক দশকে বাংলাদেশ থেকে ১২ থেকে ৩০ বছর বয়সী প্রায় তিন লাখ নারী ও শিশু পাচার হয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার, নারী ও শিশুকল্যাণ সংগঠনের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত তিন দশকে বাংলাদেশ থেকে ১০ লাখের বেশি মানুষ পাচার হয়েছে। সবচেয়ে বেশি পাচারের শিকার হয়েছে সীমান্তবর্তী জেলার বাসিন্দারা। তবে সম্প্রতি সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দাদের ভালো চাকরির আশ্বাস দিয়েও পাচার করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, পাচারকৃত বাংলাদেশি নারীদের যৌনবৃত্তি, গৃহকর্মী, পর্নো চলচ্চিত্র নির্মাণ কাজে এবং শিশুদের অঙ্গহানি করে ভিক্ষাবৃত্তি, মাদক বহন ও উটের জকি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পাচারকৃতদের মধ্যে এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্তের আশঙ্কা নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এখন গার্মেন্টের নারী শ্রমিকরাও পাচারকারীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। ভারতে পোশাক কারখানায় ভালো কাজের কথা বলে তাদের পাচার করা হচ্ছে। এ ছাড়া গার্মেন্টেরই একটি সংঘবদ্ধ চক্র ঢাকার বাইরে বেড়ানোর কথা বলে নারীদের পাচার করছে। 


অনেক সময় দেখা যায়, পাচারের শিকার একজন নারী পরবর্তীতে দেশে ফিরে এসে পাচারকারী চক্রের সঙ্গে মিলে অন্য নারীদের পাচারে সাহায্য করছে। এমনকি অনুমোদনহীন কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির দালালরাও মধ্যপাচ্যে ভালো কাজ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে নারী পাচার করছে। সাধারণত অভ্যন্তরীণ, বহির্গমন ও আন্তঃসীমান্ত পদ্ধতিতে মানব পাচার হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে পাচারকারীরা আত্মীয় সেজে পাচারে অংশ নেয়। বাংলাদেশ থেকে ভারত, লেবানন, দুবাই, মধ্যপাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করা হচ্ছে। দেশে পাচার নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলো জানায়, আগের তুলনায় পাচারের মামলা ও অভিযোগ বেশি পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ পাচারের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের এক প্রতিবেদন জানায়, পাচারকৃত শিশু-কিশোরদের শতকরা ৯০ জনকেই জোরপূর্বক দেহব্যবসায় নামানো হচ্ছে। পাচার হওয়াদের ১৩.৮ শতাংশই কলকাতার পতিতালয়ে রয়েছে।



 সূত্র জানায়, এক শ্রেণির রিক্রুটিং এজেন্সি, ট্রাভেল এজেন্সি, স্থানীয় আবাসিক হোটেল মালিক ও কর্মচারী, বিদেশি পতিতালয়ের এজেন্ট ও বস্তির মাস্তানরা পাচার কাজে জড়িত। বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, পাচারকারীরা আগের তুলনায় আরও বেশি সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করছে। পাচার রোধে তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাধারণত দেশে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে পাচার আইনে মামলা না হয়ে পাসপোর্ট আইনে মামলা হয়। ফলে দেশ-বিদেশের সংঘবদ্ধ চক্র অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

২০০০ সালে এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৫৯০ দুর্ঘটনার মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে কনকর্ড যুগের।

বাংলাদেশের সকল রাজবাড়ী ও জমিদার বাড়ীগুলির ইতিহাস ও বর্তমান অবস্হা কি (ভিডও সহ )