বাংলাদেশকে 'নতুন এশিয়ান টাইগার' হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে -

গোল্ডম্যান স্যাক্স এর সাম্প্রতিক সমীক্ষায় ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চায়না এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়াও বিশ্বেও সম্ভাবনাময় ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতির আকার আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ ইউরোপের ২৭টি রাষ্ট্রের সম্মিলিত অর্থনীতির আকারের চেয়েও বড় হতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্র পূর্বাভাস দিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য গবেষণা সংস্থা কর্তৃক উদীয়মান অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্র ক্লাবের সদস্য হিসাবে বাংলাদেশের নাম গত কয়েক বছর ধরেই আলোচিত হচ্ছে। গোল্ডম্যান স্যাক্সের মতে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যুত, জ্বালানি, সিমেন্ট ও টেলিযোগাযোগ খাত বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র এবং নাউট ফ্রাঙ্ক ও সিটি গ্রুপ কর্তৃক যৌথভাবে প্রণীত ‘দ্য ওয়েলথ রিপোর্ট ২০১২’ প্রতিবেদনে বিশ্বের সম্পদ প্রবাহ ও সম্ভাব্য বিনিয়োগের মাধ্যমে ২০৫০ সালের মধ্যে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রথম চারটি দেশের মধ্যে নাইজেরিয়া, ভারত ও ইরাকের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। শুধুমাত্র তাই নয়, গার্ডিয়ানের মতে, ২০৫০ সালে প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পশ্চিমা দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে।



বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে দারুণ সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন মাপকাঠি প্রকাশের পাশাপাশি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে একটি তথ্যচিত্রও তৈরি করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশকে 'নতুন এশিয়ান টাইগার' হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্যচিত্রে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন উপাত্ত। আর এতে প্রথমেই বাংলাদেশের দ্রুত সম্প্রসারণশীল অর্থনীতির কথা বলা হয়েছে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি করলেও কিছু বাধা দূর করতে পারলে বাংলাদেশের আরও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্ভব। তথ্যচিত্রটিতে প্রশংসার পাশাপাশি বাংলাদেশের তেমন কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিনিয়োগের পরিবেশ ও অবকাঠামো উন্নয়ন। বলা হয়েছে, বর্তমানে বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে ৪০০ দিন সময় লাগে। দেশের ২০ শতাংশ এলাকায় স্থিতিশীল বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। এ ছাড়া উচ্চমাত্রায় দুর্নীতির কারণেও ব্যবসা-বাণিজ্য করা কঠিন।
কিছু প্রতিবন্ধকতার পরও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা অত্যন্ত ভালো। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ ক্রমে বাড়ছে। আর এ সবকিছুই হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির দ্রুত বিকাশমান গতির কারণে বেশীরভাগ বাংলাদেশি কৃষি থেকে জীবিকা অর্জন করেন। তাই এর অবদান অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই। যদিও বাংলাদেশে প্রায় সব ধরনের ফসল যেমনঃ ধান,গম, ভুট্টা,আলু,সরিষা ও সবজির ফলন হয়ে থাকে। তবুও ধানের কথাই বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। বাংলাদেশের উর্বর মাটি এবং পানি সরবরাহের ব্যবস্থা থাকার কারণে এক বছরেই তিনবার ফসল ফলানো সম্ভব হয়। 

বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সমাীক্ষা মতে, বর্তমান ধারাবহিকতায় ৬ শতাংশ বা তদুর্ধ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং ‘ম্যাজিক’ এর ন্যায় দারিদ্র হার হ্রাস বজায় থাকলে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে সক্ষম হবে। অন্যদিকে, অক্সফোর্ড পভার্টি অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনশিয়িটিভের গবেষণা মতে, ভারতে প্রতি বছর দারিদ্রের হার ১.২ শতাংশ হারে কমলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ হার ৩.২%।
Image result for TAKA
 নব্বই এর দশকে বাংলাদেশে মাত্র ২৩ লাখ লোক দারিদ্র সীমা অতিক্রম করতে পারলেও ২০০০-২০১০ এ দশকে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রায় দেড় কোটি লোক দারিদ্রের কষাঘাত থেকে মুক্তি দিতে পেরেছে। সুশাসনের ঘাটতি, অহরহ মানবাধিকার লংঘন, রাজনৈতিক হানাহানি, জনসংখ্যার অধিক চাপ সত্ত্বেও মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৮টি দেশের মধ্যে একটি হওয়ার গৌরব অর্জন করায় বিশ্বের তাবত বিশ্লেষকদের জন্য বাংলাদেশ একটি ‘অর্থনৈতিক মিরাকলে’ পরিণত হয়েছে। উল্লেখ্য, পার্শ্ববর্তী ভারত এবং চীন প্রবৃদ্ধির লক্ষমাত্রা ১০ শতাংশের কাছাকাছি নির্ধারণ করলেও বাংলাদেশে কখনো লক্ষমাত্রা ৭ শতাংশের উপরে যায়নি। কিন্তু বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৭-৮ শতাংশের মধ্যে রাখার বিকল্প নেই। উল্লেখ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন, আয়ুস্কাল বৃদ্ধি, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, পয়:নিষ্কাশন ব্যবহারের হারসহ এমডিজি লক্ষ্য অর্জনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশ এমনকি ভারতের জন্য বাংলাদেশ উদাহরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের ন্যায় জনবহুল ও সমস্যাসংকুল এ রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠী কিভাবে এ অসম্ভবকে সম্ভব করছে? এ অর্জনের মূলে যে প্রভাবকগুলো প্রধান অবদান রেখেছে তাহলো, অর্থনীতির অন্তর্নিহিত শক্তি বা ও শাসন প্রক্রিয়ার দুর্বলতাসমূহ কাটিয়ে নিজস্ব প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির মাধ্যমে ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে উৎপাদন ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার মাধ্যমে শ্রম আয় বৃদ্ধিজনিত অভ্যন্তরীণ চাহিদার বৃদ্ধি এবং একদল তরুণ প্রতিভাবান ও উদ্যোক্তা জনগোষ্ঠীর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার দুর্দমনীয় আকাঙ্খা ও সে অনুযায়ী প্রচেষ্টা।

সর্বশেষ ম্যাকেনজি/ইউএসইউড রিপোর্টে বলা হচ্ছে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কারণে অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমার বর্তমান হার হ্রাস পাওয়ায় আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশে প্রায় দেড় কোটি লোকের কর্মসংস্থনের সম্ভাবনা রয়েছে। এর কারণ হিসাবে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা চীনের সমতুল্য, তদুপুরি বাংলাদেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনার মানও উন্নত। এ রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশের শ্রমিকদের বেতন চীনের তুলনায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ এবং প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের তুলনায় অর্ধেক, যা শ্রমনির্ভর শিল্পোৎপাদনের জন্য অন্যতম বিবেচ্য বিষয়। কিন্তু এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেড় কোটি লোকের কর্মসংস্থান করতে হলে বিশেষায়িত রপ্তানি প্রক্রিয়া জোন তৈরির জন্য প্রায় ৪০ হাজার একর জমির প্রয়োজন। এ পরিমাণ জমির সাথে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো বিশেষকরে গ্যাস, বিদ্যুতের নিরবিচ্ছন্ন সরবরাহ এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, শ্রম নিরাপত্তা বা মান, স্বল্প সময়ে নির্বিঘেœ রপ্তানির সুযোগসহ সার্বিক সুশাসন এবং সকলের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের বিকল্প নেই। একদিকে সম্ভাবনার দ্বার, আর অন্যদিকে অজানা আশংকায় আমরা শংকিত হচ্ছি। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অবকাঠামোগত দুর্বলতার ফলে আশংকাজনক হারে বিনিয়োগ হ্রাস, শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানিও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। যার ফলে বর্তমান অর্থ বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিও হার কাঙ্খিত হারের চেয়েও কম হবে। উল্লেখ্য, ভারত এবং চীনে বিনিয়োগ ব্যয় বাংলাদেশের চেয়ে এখনো অনেক কম এবং এসব দেশে বিনিয়োগ-বান্ধব দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং শক্তিশালী আমলাতন্ত্র হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগের জন্য এখনো অনেক আকর্ষনীয়।


বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক এ সম্ভাবনার ক্ষেত্রে শাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন সংকট যেমন, পদ্মাসেতু বাস্তবায়নে কমিশন বাণিজ্য, শেয়ার বাজার কেলেংকারি, হলমার্ক, ডেসটিনিসহ বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি, চাঁদা ও কমিশনবাজদের অপ্রতিরোধ্য অবস্থান, চরম মানবাধিকার লংঘন. গুম, রাষ্ট্রীয় মদদে গুম ও হত্যাকান্ড, চরমভাবে সংকুচিত গণতান্ত্রিক অধিকার ও, রাষ্ট্র ক্রমান্বয়ে নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ। হিংসার রাজনীতি এবং নৃশংশতায় যেভাবে মানুষ মরছে এবং মারছে সে দৃশ্য সার্বিক সুশাসনের পথে প্রধান বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে যা নিরবিচ্ছিন্ন বিনিয়োগ এবং অর্থনীতির অগ্রযাত্রার প্রধান প্রতিবন্ধকতা। বিশ্বব্যাপী বর্তমানে মিডিয়ার অবাধ বিচরণের ফলে বাংলাদেশের সার্বিক সুশাসনের সংকটের কথা বিশ্বব্যাপী প্রচার হচ্ছে। সবারই একই প্রশ্ন, কার স্বার্থে এ আত্মঘাতী এবং অর্থনীতি বিনাশী কার্যক্রম। ইউরো অঞ্চলে অর্থনীতির ধ্বস সত্ত্বেও বিদেশি ক্রেতারা স্বল্প বেতনে শ্রম সুবিধাকে পুঁজি করে মুনাফার উদ্দেশ্যে রাশিয়া, ব্রাজিল ও ল্যাটীন আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ হতে নতুন ক্রেতারা ঝাঁকে ঝাঁকে বাংলাদেশে আসলেও চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটিত না হওয়া, প্রথমে তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টেস এবং রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতার কারণে (সর্বশেষ প্রফেসর ইউনুসের যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের বিশেষ সম্মামনা অর্জনের মাধ্যমে যতখানি অর্জিত হয়েছিলো) সাভারে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা রানা প্লাজায় অবস্থানরত গার্মেন্টসগুলোর শত শত কর্মীর অকাল মৃত্যুর ফলে উদীয়মান পোষাক শিল্পের ভবিষ্যত ক্রমে শ্রীলংকার ন্যায় ফিঁকে হয়ে আসছে।


আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদী ভাবমূর্তির সংকটে পতিত হলো। এর প্রভাব জিএসপি শুনানিতে যে পড়বে তা ইতিমধ্যে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত জানিয়ে দিয়েছেন। ফলে রপ্তানি বাণিজ্য হুমকির সম্মুখীন। নিশ্চিতভাবে বলা যায় জিএসপি সুবিধা বাতিলের সম্ভাবনা প্রবল এবং সেরকম কিছু হলে অনেক সম্ভাবনাময় গার্মেন্টস খাতার বাজার হারিয়ে যেতে পারে। এভাবে শ্রমিকদের মৃত্যুর ফলে শ্রমিক শ্রেণী নিরাপত্তাহীনতায় ভূগে তাদের কর্মদক্ষতা ও স্পৃহা উভয়ই হ্রাস পাবে; বিনিয়োগও নিরুৎসাহিত হচ্ছে। তাছাড়াও, একজন শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা শুধু তার দৈহিক কর্মক্ষমতার উপর নির্ভর করে না। হরতালের সহিংসহতায় সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের ব্যক্তিগত চলাচলে নিরাপত্তাহীনতা থাকলে বা গ্রামে অবস্থানরত পরিবারের সদস্যরা যদি রাজনৈতিক কারণে পুলিশি হয়রানি বা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় তাহলে নিশ্চয় শ্রমিকের উৎপদানশীলতা কাঙ্খিত মানে থাকার কথা নয়।
তাছাড়া, আজ হতে দশ বছর আগে রপ্তানি খাতের মুনাফার যে মার্জিন ছিলো প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় তা বর্তমানে ক্রমাগত কমছে, সুতরাং সহনীয় ক্ষমতার নিশ্চয় একটা সীমারেখা আছে। যদি শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল এবং নির্দিষ্ট সময়ে উৎপাদিত শিল্প দ্রব্যের রপ্তানি করা সম্ভব না হয় এবং বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নিশ্চিত করা না হয় তাহলে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায়। একইসাথে নির্দিষ্ট সময়ে রপ্তানিতে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়ায় সার্বিক খরচ হিসাব করে শিল্পোদ্যেক্তারা ভিন্ন কোন দেশকে বিনিয়োগের জন্য বেছে নেয়া স্বাভাবিক। বিজিএমইএ’র মতে, নির্দিষ্ট সময়ে কাঁচামাল আমদানি এবং অর্ডারকৃত রপ্তানি দ্রব্যের সরবরাহ সম্ভব না হওয়ায় ইতিমধ্যে ২৭০টি গার্মেন্টস রুগ্ন হয়ে পড়েছে, প্রতিদিন অর্ডার বাতিল হচ্ছে, এ সময়ে যে পরিমাণ অর্ডার পাওয়ার কথা তা কাঙ্খিত নয়। বাংলাদেশের চেয়ে শ্রমিকের বেতন ভিয়েতনামে দ্বিগুণ হলেও সেখানে অন্যান্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর নিশ্চয়তা এবং শ্রম নিরাপত্তার মান ভাল হওয়ায় ইতিমধ্যে ওয়ালমার্টসহ বিভিন্ন বড় কর্পোরেট ভিয়েতনামকে বিকল্প হিসাবে বিবেচনা করছে। উল্লেখ্য, এফবিসিসিআই ২০১২-১৩ অর্থ বছরের বাজেট প্রস্তাবে বিদেশে শিল্প স্থাপনের অনুমতি প্রদানের সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছিলো। সরকার এবং বিজিএমইএ যদি কার্যকর উদ্যোগ না নেয় এবং লাখ লাখ শ্রমিক চাকরি হারালে বাংলাদেশের সামাজিক অস্থিরতা চরম আকার ধারণ করবে। তাছাড়াও, পোষাক শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়া ওঠা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, সার্বিক সুশাসনের এ চরম অবনতির ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা যে সব সময়ই ঘাত সহনীয় আচরণ করবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।


অবকাঠামো খাতে দুর্বলতার প্রধান কারণ হলো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে ‘কমিশন বাণিজ্য’ কে প্রাধান্য দেয়া এবং সর্বশেষ পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে কানাডার কোর্টে চলমান মামলায় সরকারের সকল রথী-মহারথীদের ‘কমিশন বাণিজ্যে’ অংশগ্রহণের কথা প্রকাশ পায়। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের দেশপ্রেমিক সার্টিফিকেট দিয়ে দুর্নীতি আড়ালের চেষ্টা করলেও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থানরতদের বির”দ্ধে তৃতীয় কোন দেশে মামলা হলো। দুদক এর গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে এখন এটি দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আমরা মনে করি দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে হলে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। যদিও সরকারের ভেতর অবস্থানরত শক্তিশালী এক চক্র পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত ভারতীয় ব্যবসায়ী এবং শেয়ার বাজার হতে লুন্ঠনকারীরা মালয়েশিয়ান সরকারের মাধ্যমে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিনিয়োগের যে প্রস্তাব দিয়েছে তা বাতিল করা উচিত।

  Related image

পদ্মা সেতু দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞবৃন্দ, পরিক্ষীত স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বয়ে একটি কনসোর্টিয়াম গঠন করে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সততা নিশ্চিতের মাধ্যমে সরকারি নিশ্চয়তায় বিদেশে অবস্থানরত এবং দেশের নাগরিকদের নিকট শেয়ার বা বন্ড বিক্রির মাধ্যমে প্রয়াজনীয় অর্থ সংগ্রহের উপর জোর দেয়া প্রয়োজন। উল্লেখ্য, বিজিএমইএ, বিকিএমই সহ প্রধান রপ্তানিকারকদের সমন্বয়ে গঠিত কোম্পানির কাছে মংলা বন্দরকে স্থায়ীভাবে ইজারা প্রদান করে মংলাকে কেন্দ্র করে আশেপাশের খুলনা বিভাগ এবং বৃহত্তর ফরিদুপর অঞ্চলে ইপিজেড এর জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় জমি বরাদ্দ প্রদান করা উচিৎ। তাছাড়াও, অবকাঠামো বিশেষকরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট নিরসনে পূর্ণাঙ্গ নবায়নযোগ্য (সৌর বিদ্যুৎ) জ্বালানি নির্ভর ইপিজেড প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একইসাথে জ্বালানি অনিশ্চয়তা হ্রাস এবং কার্বন নিঃসরণ নিম্ন পর্যায়ে রাখা সম্ভব।


উল্লেখ্য, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বিশ্বের ৩টি রাষ্ট্রের একটি বাংলাদেশ এবং এর প্রভাবে ভবিষ্যতে লাখ লাখ লোক বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশংকা রয়েছে। তাই দক্ষিণাঞ্চলে ইপিজেড প্রতিষ্ঠা করলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দূর্যোগের ফলে দক্ষিণাঞ্চল হতে ঢাকা বা অন্যান্য অঞ্চলে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় ৩ কোটি লোকের অভিবাসন স্্েরাতের আশংকাও হ্রাস পাবে। এক্ষেত্রে ইপিজেডভিত্তিক শ্রমিকদের জন্য স্বল্প খরচে পূর্ণাঙ্গ আবাসন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করলে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী বেঁচে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় শুধুমাত্র বিসিসিটিএফ এবং বিসিসিআরএফ এর মাধ্যমে সরকার ইতিমধ্যে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে। এ অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রকৃত অভিযোজনকে প্রাধান্য দিয়ে ২০১৩-১৪ অর্থ বছরের বাজেটে দিক নির্দেশনা দেয়া উচিৎ। জলবায়ু অভিযোজন এবং এ বাবদ অর্থায়নকে চলমান উন্নয়ন পরিকল্পনার  মধ্যে নিশ্চিতের বিকল্প নেই।


নির্দিষ্ট ‘কমিশন বাণিজ্যের’ বিপরীতে বহুল বিতর্কিত রেন্টাল বিদ্যুত প্রকল্পগুলো হতে চড়া মূল্যে বিদ্যুত ক্রয় করে তার দায়ভার অস্বাভাবিক বিদ্যুত মূল্য বৃদ্ধিও মাধ্যমে জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়েছে সম্প্রতি সরকার সেসব কেন্দ্রকে স্থায়ীভাবে অুনমোদন দিয়ে এগুলোকে স্থায়ীভাবে কাঁধে চাপাল। এ খাতে ভর্তুকি প্রদানে বিপল অর্থ ব্যায়ের ফলে ব্যাংক হতে ঋণ গ্রহণ বেড়ে বেসরকারি খাতের জন্য ঋণ সরবরাহ সুকুচিত হওয়ায় ঋণের সুদেও হার বেড়ে বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ায়টাই স্বাভাবিক। উল্লেখ্য, গত বাজেট পরবর্তী (২৭ জুন, ২০১২) সময়ে বণিকবার্তায় প্রকাশিত লেখায় এ সংক্রান্ত পূর্ভাবাসে লিখেছিলাম,‘‘চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, অবকাঠামোগত অসুবিধা এবং সার্বিকভাবে বিনিয়োগ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাজেটে সুস্পষ্ট বিনিয়োগ প্রণোদনা বা উৎপাদন খরচ কমানোর কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ না নিলে সার্বিক চাহিদা এবং সার্বিক উৎপাদন হ্রাস পেয়ে ‘অর্থনৈতিক স্থবিরতা’ আরো প্রকট আকার ধারণ করতে পারে”।

চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) ঘোষিত মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। একের পর এক হরতালসহ রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৮.৫ শতাংশ  ধরা হলেও  ডিসেম্বর শেষেও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৮ শতাংশ পূরণ হয়নি। এ কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা আসতে শুরু করেছে। ফলশ্র“তিতে পুরাতন ঋণগুলোই খেলাপিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে প্রসার ঘটছে না শিল্প-বাণিজ্যেও; বাড়ছে না কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মধ্যে প্রবাসী আয় ১৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ায় শ্রম বাজার খুললেও অন্যান্য দেশ বিশেষকরে নেপাল, ভারত এবং পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের শ্রম বাজার আশংকাজনত হারে সংকুচিত হচ্ছে। বর্তমান এ পরিস্থিতিতে সার্বিক বিনিয়োগ ও আয়হ্রাসজনিত কারণে সার্বিক চাহিদা কমে অর্থনীতিতে ‘স্ট্যাগফ্ল্যাশন’ বা ‘মন্দা এবং মূল্যস্ফীতি’ উভয়ের অবস্থান আমাদের অর্থনীতির সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ করে দিতে পারে। তাই বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি করতে হলে সহনীয় করারোপ, বিদেশি ক্রেতাদের আশ্বস্ত করতে পারে এ ধরনের ব্যবস্থা দ্রুত নিশ্চিত করা, বিনিয়োগ প্রণোদনাসহ নির্ভরযোগ্য অবকাঠামো নির্মাণে আগামী বাজেটে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দেয়া উচিত। তাছাড়াও, ২০১৩-১৪ অর্থ বছরের বাজেটে কিভাবে বিনিয়োগ, উৎপাদন এবং সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখা যায় তার একটি সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা প্রদান করতে হবে।

সরকারের মধ্যমেয়াদী রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষমাত্রা অনুযায়ী আগামী ২০৪-৫ অর্থ বছরে মধ্যে কর-রাজস্ব ও জিডিপি অনুপাত আগামী ২ বছরের মধ্যে ১০.৫ শতাংশ হতে ১৪ শতাংশে  উন্নীত করতে হবে। অথচ গত ৪০ বছরে সরকার (৩.৪ শতাংশ হতে ১০.৫ শতাংশ) মাত্র ৭ শতাংশ কর-রাজস্ব ও জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি করতে সক্ষম হলেও আগামী দুই অর্থ বছরে অতিরিক্ত ৩ শতাংশ বৃদ্ধির লক্ষমাত্রা যে বাস্তবসম্মত নয় তা পরিস্কার। তাছাড়াও, সরকারের আয়ের প্রধান উতস কর রাজস্ব হলেও চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যাংকগুলোতে মুনাফা হ্রাস, রপ্তানি হ্রাসের ফলে চলতি অর্থ বছরের রাজস্ব লক্ষমাত্রার ১ লাখ ১২ হাজার ২৫ কোটি টাকার মধ্যে প্রথম নয় মাসে মাত্র ৭২ হাজার ৪৭ কোটি টাকা (৬৪ শতাংশ) আহরণ হয়েছে। আর এ লক্ষমাত্রা ছিলো ৭৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। চলমান রাজনৈতিক সংঘাত আরো প্রকট হলে মাত্র ৩ মাসে বাঁকি ৩৬ শতাংশ রাজস্ব আহরণ যে অসম্ভব তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। বৃহত করাদাত ইউনিট, ঢাকা কর অঞ্চল ১০, ১২, ১৩, ১৪ ও চট্টগ্রাম কর অঞ্চল ১ ও ২ ইতিমধ্যে এনবিআরকে জানিানেছে যে, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক মন্দার ফলে কাঙ্খিত রাজস্ব আদায় সম্ভব নয় (সূত্র: বণিকবার্তা)।
bangladesh-economy-prospects-and-challenges-graph
তাছাড়াও, নিম্ন কর-জিডিপি অনুপাতের মূল কারণগুলো হলো কর ফাঁকি ও আত্মসাৎ, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান না থাকা/শাস্তি না হওয়া, বিনা বাধায় অবৈধ অর্থ উপার্জনের সুযোগ এবং দেশের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জনে সরকারের দূরদৃষ্টি না থাকা। অনেক ক্ষেত্রে কর নীতি ব্যাপক হলে কর ফাঁকি, কর আত্মসাৎ এবং বড় ধরনের রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়। অন্যদিকে জটিল কর আইন অনৈতিক আর্থিক সুবিধা নেওয়ার পথ উন্মোচন করে। আইনগত ঝামেলার কারণে সরকারের প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার কর রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না (২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেট, পৃ. ৮২)। ইতিমধ্যে, অভিযোগ ওঠেছে, সরকার মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আইন-১৯৯১ সংস্কার করে গত বছর মূসক আইন-২০১২-র খসড়া জাতীয় সংসদে অনুমোদন করেছে যা আগামী ২০১৫ সাল থেকে কার্যকর করার প্রস্তাব করা হলেও এ আইনটি মূলত আইএমএফ এর শর্ত পূরণের জন্য করা হয়েছে, যার আওতায় ভোগ্যপণ্য, সেবা খাত, আমদানি-রপ্তানিসহ উৎপাদনের সকল স্তরকে মূসকের আওতায় আনা। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য বর্তমানে প্রচলিত অধঃগতিশীল কর ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং এবকই সাথে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বান্ধব এবং একইসাথে একটি প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা অধিকতর সহায়ক।

একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহে দক্ষতার সূচক এর কর-জিডিপি অনুপাত। এনবিআর কর ব্যবস্থার উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিলেও, কর-জিডিপি অনুপাত এখনো অনেক কম। নি¤œ কর রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বাধা এবং রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষেত্রে ‘নিম্ন-কর-রাজস্ব ফাঁদ’ হতে এনবিআর বের হতে সক্ষম হচ্ছে না। বর্তমানে ৩৩ লাখ টিআইএনধারীদের মধ্যে মাত্র ১১ লাখ (১.৫ লাখ সরকারি কর্মকর্তাসহ) নিয়মিত কর রিটার্ন দাখিল করে। ২০০৭-০৮ এবং ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে মোট ৫৬,৮৪৫ জন ব্যক্তি ৯,৬৮১ কোটি কালো টাকা/অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করে। বিভিন্ন হিসাবে কালো অর্থনীতির আকার বিভিন্ন বলা হলেও তার আকার ছোট নয়। স্নাইডার (২০০৮) এবং হাসান (২০১১) এর মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে অদৃশ্য অর্থনীতি বা ‘অপ্রদর্শিত’ আয় বা ‘অদৃশ্য’ অর্থের প্রাক্কলিত পরিমাণ মোট জিডিপির প্রায় ৩৮%। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ২০০৯-১০ অর্থবছরে কর ফাঁকি বা আত্মসাতের পরিমাণ ২০,৯৮৩.৫ কোটি টাকা, যা এনবিআর সংগৃহীত কর রাজস্বের প্রায় ৩৩.৮% এবং মোট জাতীয় আয়ের ২.৮%। মুক্তিযুদ্ধেও চেতনায় পরিচালিত কোন রাষ্ট্রে নাগরিকদের বৈষম্য কাম্য নয়। অথচ সরকার ২০১২-১৩ অর্থ বছরের  বাজেটে ‘‘পূর্ববর্তী অর্থবছরে পুঁজিবাজার বিকাশে প্রদত্ত প্রণোদনা ‘১০শতাংশ হারে জরিমানা দিয়ে পুঁজিবাজার ও সরকারি ট্রেজারি বন্ডে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ’ অব্যাহত রাখা’র মাধ্যমে  সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদ (সমাজের অনগ্রসর বা সুবিধাবঞ্চিত নি¤œ আয়ের জনগোষ্ঠীকে সুবিধাভোগীদের চেয়ে বেশি সুবিধা প্রদানের কথা বলা হয়েছে) এর সরাসরি লংঘন। কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার বিধান স¤র্পূণরূপে বিলোপ করা উচিত কারণ এরূপ বিধান নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য ও বৈষম্যমূলক; সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদ এর পরিপন্থী, অসমতা বৃদ্ধি করে এবং রাজস্ব আদায়ের বিবেচনায় অর্থহীন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহে সরকারকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। তবে এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের প্রধান কৌশল অর্থাৎ রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাপনাও এমন হওয়া উচিত যাতে দরিদ্র মানুষের ওপর চাপ কম পড়ে।

এ প্রেক্ষিতে নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রি পরিষদের সদস্য, উপদেষ্টা, সংসদ সদস্যসহ, বিচারপতি, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজনীতিকদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ নিশ্চিত করা; শেয়ার বাজার ও আর্থিক খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে সমন্বিত আইন এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে অভিযুক্তদের দোষী প্রমাণ সাপেক্ষে দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসা; কর রিটার্ন জমাসহ কর প্রদানের সকল ক্ষেত্রে পূর্ণ অটোমেশন এবং কার্যকর ই-গভার্নেন্স নিশ্চিত করা; স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আইনে পরিণত করার পূর্বে সব এস.আর.ও.-এর খসড়া মতামত গ্রহণের জন্য জনসমক্ষে প্রকাশ করা উচিত; এটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমেও করা যেতে পারে। তাছাড়াও কর ফাঁকি, আয় গোপন এবং অর্থ পাচার রোধে একক পরিচয় পত্র/টিআইএন, জাতীয় পরিচয় পত্র, পাসপোর্টের নম্বর এবং কর প্রদান সংক্রান্ত তথ্য একটি সমন্বিত ডাটাবেজের মাধ্যমে সংরক্ষণ ও পরিবীক্ষণের ব্যবস্থা করা; একটি সীমা পর্যন্ত সকল আর্থিক লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে করার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা প্রদান করা; সকল বৈধ টিআইএনধারীর নাম এবং টিআইএন জনসমক্ষে প্রকাশ করা; এবং কর আদায়ে দুর্নীতির চর্চা, কর ফাঁকি/আত্মসাতের বিরুদ্ধে ‘কোনো প্রকার সহনশীলতা প্রদর্শন না করে’ সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা; এবং কর প্রণোদনার (রহপবহঃরাব) অর্থনৈতিক প্রভাব পর্যালোচনা করা উচিত। উল্লেখ্য বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে উন্নত এবং সমৃদ্ধ দেশগুলোতে প্রত্যক্ষ কর-নির্ভর উন্নয়ন কাঠামো এবং সামাজিক বীমার নিশ্চয়তায় থাকলেও বাংলাদেশে এখনো তার ব্যতিক্রম। এটা না করা সম্ভব হলে সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বচিার যে সুদূর পরাহত থাকবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

সরকার গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি, বেসরকারি স্কুল ও কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে; সে তুলনায় নগর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি সুবিধা অপ্রতুল বিশেষকরে ভাসমান ও বস্তিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যুনতম মৌলিক সেবার নিশ্চয়তা এখনো প্রদান করা হয় নি। অনেকটা প্রদীপের নিচেই অন্ধকার। তবে, গ্রামীণ দারিদ্র বিমোচন, আশ্রায়ন প্রকল্প ও উপকূলীয় অঞ্চলে গৃহহীনদের জন্য পাঁকা ঘর নির্মাণের নামে প্রায় ২০০০ কোটি টাকা কোথায় কিভাবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়া উচিত। ২০১৩-৪ অর্থ বছরে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকায় গত অর্থ বছরে ভিজিএফ কার্ডের সংখ্যা ৩ কোটি ১১ লাখ হতে ৩১ লাখ নতুন বাড়িয়ে ৩ কোটি ৪২ লাখ করা বর্তমান মহাজোট সরকারের লক্ষ্য হলেও অর্থনীতির কাঙ্খিত লক্ষ্য কতখানি সফল হবে তা বলা মুশকিল, তবে প্রতি নির্বাচনী আসনে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার নতুন ভোট সংগ্রহের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। ২০১২-১৩ অর্থ বছরে কম সংখ্যক প্রকল্প গ্রহণ করে তার পুরোপুরি বাস্তবায়নে নজর দেয়ার কথা বলা হলেও তা অগ্রাহ্য করে সরকার ১ হাজার ৩৭টি প্রকল্প গ্রহণ করে, যা শুধু অবাস্তবই নয়, সরকারের অদক্ষতাকে প্রকটভাবে ফুটিয়ে তুলে। প্রত্যেক সরকারের সময়ে বাজেটের আকার বড় দেখানোর একটা প্রতিযোগিতা থাকে, অথচ আকার নয় বরং জন ও উন্নয়ন বান্ধব বাজেট বাস্তবায়নে জোড় দেয়া উচিত।
সার্বিকভাবে, জলবায়ু অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্পসমূহে প্রযোজনীয় অর্থ বরাদ্দে জলবায়ু পবির্তনের ঝুঁকিসমূহ এবং সমাপ্তকৃত প্রকল্পসমূহের আর্থিক ও ভৌতিক প্রভাব বিবেচনা করা; পরিবেশ, বন ও পানি সম্পদসহ জীববৈচিত্র্য সংশ্লিষ্ট যে কোনো দেশীয় বা আন্তঃদেশীয় প্রকল্পে সরকারি বা বেসরকারি অর্থায়নের পূর্বে পরিবেশ, সামাজিক এবং আর্থিক প্রভাব যাচাইয়ের আইনি বিধান ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা; বিদ্যূৎ ও জ্বালানি খাতে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে বিদ্যমান ‘বিশেষ আইন’ রহিত করা; রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিবর্তে সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্রুত সংস্কার এবং বৃহৎ ক্ষমতার বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ; বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সব ধরনের জ্বালানির দাম কোনো অবস্থাতেই না বাড়ানো; থোক বরাদ্দ নিরুৎসাহিত করা; কৃষিখাতে প্রণোদনা বৃদ্ধি এবং কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয়ে উপযুক্ত ক্রয়নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নিশ্চিত করা; এবং পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ফলে স্বাস্থ্য, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদি প্রয়োজনীয় খাতে বরাদ্দ যাতে না কমে বাড়ানো যায় তা নিশ্চিত করা উচিত।
অর্থনীতি এবং রাজনীতি একে অপরের পরিপূরক, অর্থনীতি পরিচালনাকারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। তাই বর্তমান মন্দা কাটিয়ে ওঠতে হলে রাজনৈতিক সমঝোতা ও উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বৃদ্ধির লক্ষে সম্প্রসারণশীল অর্থনৈতিক কার্যক্রম গ্রহণের বিকল্প নেই। ভোটার তুষ্ট করার বাজেট করলে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে জনজীবনে দূর্যোগ আরো বাড়াবে। সরকারের সততা, সদিচ্ছা, আইনের শাসন এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান সহায়ক শক্তি।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

The national flag Cambodia

world map

TOP 10 REASONS TO VISIT THAILAND