‘মাদারিং’ শব্দ টার সাথে ‘ ফাদারিং’ শব্দটা কি একই ভাবে উঠে আসে? আসে না।
– নতুন খবর শুনছি কবে?
-অনেক দিন তো হল
– এবার তো বয়স বেড়ে যাচ্ছে।
-হ্যাঁরে, তোদের সব ঠিক আছে তো?
-– নতুন খবর শুনছি কবে?
-অনেক দিন তো হল
– এবার তো বয়স বেড়ে যাচ্ছে।
-হ্যাঁরে, তোদের সব ঠিক আছে তো?
-বাচ্চা না হলে বিয়েটা আর টিকবে?
-ডাক্তার দেখাচ্ছিস?
-ডাক্তার দেখাচ্ছিস?
এই প্রশ্নমালা যার উদ্দেশ্যে তার নাম নিলা।
উচ্চশিক্ষিত, আধুনিকমনস্ক একটি মেয়ে। নিজের কাজের জায়গায় দারুণ সফল। বিবাহিত। স্বামীর সঙ্গে সুখী দাম্পত্যে বহুদিন। কিন্তু নিঃসন্তান। উভয়ের মিলিত ইচ্ছেয় গর্ভধারণ বিষয়টি নিয়ে মোহনা মাথা ঘামায়নি কোনদিন। তার সঙ্গীরও সমস্যা নেই তাতে। বেশ চলছিল যৌথ জীবন। কিন্তু আজকাল পারিবারিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলে নিলা। আত্মীয় স্বজনের মাঝখানে ঢুকলেই কেমন একটা অস্বস্তি হয় তার। টের পায় ঘরের কোণে, আড়ালে আলোচনা চলছে। তাকে নিয়েই।
এই সমস্যা একা নিলার নয়। কম বেশি সব বিবাহিত মহিলাকেই এই ধরনের প্রশ্নমালার মুখে পড়তে হয়। বিবাহিত জীবনের বয়স অনুযায়ী প্রশ্নমালা বদলে যায় শুধু।
নারীকে বলা হয় মায়ের জাত। মাতৃত্বে নারী জীবনের সার্থকতা। তাই বিবাহিত সম্পর্কের অবশ্যম্ভাবী ও স্বাভাবিক পরিণতি হল সন্তান। সে ব্যাপারে কারও কোন ‘চয়েস’ থাকতে পারে না। তাই নিলার মত কেউ কেউ যদি সেই ক্ষেত্রে নিজের ‘ চয়েস’ খুঁজতে চায় তাহলে স্বজন-বন্ধুর ঠোঁটের কোণের হাসির রেখাটি বাঁক বদল করতে সময় নেয় না।
রাস্তা দিয়ে একা হেঁটে গেলে গুঞ্জন কান এড়ায় না মোহনার। সে আজকাল অপেক্ষা করে তার ৪০ বছরের জন্মদিনের জন্য। বয়স পেরিয়ে গেলে হয়ত কথারা থেমে যাবে একদিন।
প্রকৃত পক্ষে গর্ভধারণ নিতান্ত একটি জৈবিক প্রক্রিয়া। পারিবারিক উত্তরাধিকার রক্ষার দায় খুব সচেতন ভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয় সেই প্রক্রিয়ার ওপর। সেভাবেই মাতৃত্বকে মহান করে তোলা হয়েছে। পুরুষ ও পরিবারের সম্পত্তির অধিকারের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে নারীর জরায়ু কে। তার নিজের শরীরের মত এই অঙ্গ টিতেও তার কোন নিজস্ব অধিকার নেই। নেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও।
অথচ একদিন আমাদের সমাজ মাতৃতান্ত্রিক ছিল। সন্তান ধারণের ইচ্ছেরা ছিল স্বাধীন। সন্তানের পিতা নির্বাচন নারীর ইচ্ছাধীন বিষয়। গোষ্ঠী ও সম্পত্তির মালিকানা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেলে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ধারণাও। তখন এই স্বাভাবিক জৈবিক বিষয়টি সামাজিক রূপ তো পেলই, তার সঙ্গে তাতে লাগল গোষ্ঠী রাজনীতির রংও। সেই ধারা এখনও সমান বেগবতী। “আমরা বিয়ে করব, কিন্তু সন্তান আমাদের সেকেন্ডারি বিষয়” এই ডিক্লারেশন দেওয়া আজও সহজ নয় আমাদের সমাজে। মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত বা নিম্নবিত্ত স্তরবিন্যাস যাই হোক না কেন।
নারী যে শরীরে-মনে ঠিকঠাক নারী তার প্রমাণ দিতে হয় সন্তান ধারণের মাধ্যমে। আর এই সামাজিক প্রেক্ষাপটে স্রোতের বিপরীত মুখে দাঁড়িয়ে কেউ যদি বলে- মাতৃত্ব আমার ইচ্ছে। আমি ঠিক করব শরীরে বীজ ধারণ করব কিনা তখন স্বাভাবিক ভাবেই ভ্রু কুঁচকে যায় আশপাশের।
সন্তানহীন বিবাহিতা নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিতে কিছুটা ভয় কিছুটা সহানুভূতি যেমন মিশে থাকে, তেমনই কোথাও যেন একটা পরিতৃপ্তির উদ্গারও মিশে থাকে যেন। অর্থাৎ দেখ তুমি কী পাচ্ছ না আর আমি কী পাচ্ছি, এরকম গোছের। ভারতীয় সমাজে যে কোন শুভ অনুষ্ঠানে সন্তানহীনা নারী প্রবেশাধিকার পেলেও অংশগ্রহণের অধিকার কেবলমাত্র সন্তানবতীদেরই। সে বিয়ে হোক বা অন্নপ্রাশন। যে কোন শুভ অনুষ্ঠানে যেন তারা মূর্তিমান বিড়ম্বনা। তাই তাদের দেখা নিষেধ, ছোঁয়া নিষেধ। ‘বাঁজা’, ‘অপয়া’ সব শব্দ নির্দিষ্ট করা হয় সন্তানহীনার জন্য।
‘বহুদিনের প্রচলিত প্রথা এসব, বেয়াড়া ধরনের প্রশ্নগুলো তাই করতে নেই। শুভ অশুভ বলে একটা ব্যপার আছে না!’
আসলে যে কোন ভাবে তোমায় মা হতেই হবে। স্বামী পুত্র পরিবারে ভরা সংসার। দশমাস দশ দিনের গর্ভ যন্ত্রণা উদযাপন করে তবেই তোমার এয়োস্ত্রী জন্ম স্বার্থক।
আসলে সমাজের চাপিয়ে দেওয়া ‘মা’ ভূমিকায় যত টা না ইচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে, তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করে ভয়। নির্বাসিত হওয়ার ভয়। মূলস্রোত থেকে দূরে সরে যাবার ভয়। ‘আর সবার মত’ না হতে পারার ভয়। বৈবাহিক সূত্রে পাওয়া সম্পর্কগুলোর জটিল সুতোয় জট পাকিয়ে যাবার ভয়। অস্বাভাবিক জীবনের ভয়। অনেক সময়ই মাতৃত্বের আড়ালে চাপা পড়ে যায় বৈবাহিক ধর্ষণের ঘটনাও।
মাতৃত্বে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠতে গিয়ে অবলীলায় ঝেড়ে ফেলতে হয় নিজস্ব স্বপ্নগুলো। অথচ সেখানে ‘পুরুষের পিতৃত্বে পরিপূর্ণতা’ জাতীয় কোন তত্ত্ব কাজ করে না। না। এটা কি অদ্ভুত ধারনা বলে মনে হয় না, যে আমরা সামাজিক পরিকাঠামো বা সিস্টেমের বদল নিয়ে এত কথা বলি কিন্তু মাতৃত্ব বা মা হওয়ার ওল্ড স্কুল কনসেপ্ট থেকে বেরতে পারিনা। তাই মোহনার মা না হওয়ার কারণ নিয়ে চর্চা চললেও তার পুরুষ সঙ্গীটির কেশাগ্র স্পর্শের সাহস পায় না কেউ।
গর্ভধারণ একটি নারীর শুধু সামাজিক জীবনে পরিবর্তন আনে না। তার শারীরিক ও মানসিক ক্ষেত্রেও বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। সেই পরিবর্তনের জের সামলে উঠতে অনেকেই পারে না। পার্মানেন্ট ডিপ্রেশনের শিকার হয়। নিজের কর্ম ও শিক্ষাক্ষেত্রের দৌড়টা হঠাৎ থমকে গেলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। শুধু জোর করে চাপিয়ে দেওয়া মাতৃত্বের দায়ে স্বপ্ন, স্বাধীনতা, বেঁচে থাকার ধরনের রাতারাতি পরিবর্তন দাম্পত্য সমস্যাও ডেকে এনেছে এমন নজির কম নেই। কিন্তু সে সব কাহিনি চাপা পড়ে যায় চার দেওয়ালের আড়ালে। আর প্রকাশ্যে যদি কেউ প্রশ্ন তোলে তাহলেও আড়ালের গল্প বলে বালিশ চেপে ধরে হয় প্রশ্নের মুখে। কাজেই যুক্তির মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায় সেখানেই…
মাতৃত্বেই সমস্ত সাফল্যের সার ভাবা বন্ধ করুন। নারীর জীবনের শেষ কথা যেন মাতৃত্ব না হয়। গর্ভধারণের ভারে যেন চাপা পড়ে না যায় ‘মেয়ে-মানুষের’ স্বপ্নগুলো। শারীরিক ভার, যন্ত্রণা, কষ্ট সহ্য করে নবীন নাগরিক আনার স্বপ্ন ও ইচ্ছে যেন তার নিজের বুক থেকেই উঠে আসে। কোন পুরুষ নয়। পরিবার নয়। সমাজ নয়। নিজের শরীরের গভীরে ভ্রূণ লালনের স্বপ্নটা নারীর নিজস্ব স্বপ্ন হোক। মা হওয়ার ইচ্ছে যেমন স্বাভাবিক তেমনই কারোর মা না হওয়ার সিদ্ধান্তকেও সম্মান জানাতে শিখি আমরা।
-অনেক দিন তো হল
– এবার তো বয়স বেড়ে যাচ্ছে।
-হ্যাঁরে, তোদের সব ঠিক আছে তো?
-– নতুন খবর শুনছি কবে?
-অনেক দিন তো হল
– এবার তো বয়স বেড়ে যাচ্ছে।
-হ্যাঁরে, তোদের সব ঠিক আছে তো?
-বাচ্চা না হলে বিয়েটা আর টিকবে?
-ডাক্তার দেখাচ্ছিস?
এই প্রশ্নমালা যার উদ্দেশ্যে তার নাম নিলা।
উচ্চশিক্ষিত, আধুনিকমনস্ক একটি মেয়ে। নিজের কাজের জায়গায় দারুণ সফল। বিবাহিত। স্বামীর সঙ্গে সুখী দাম্পত্যে বহুদিন। কিন্তু নিঃসন্তান। উভয়ের মিলিত ইচ্ছেয় গর্ভধারণ বিষয়টি নিয়ে মোহনা মাথা ঘামায়নি কোনদিন। তার সঙ্গীরও সমস্যা নেই তাতে। বেশ চলছিল যৌথ জীবন। কিন্তু আজকাল পারিবারিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলে নিলা। আত্মীয় স্বজনের মাঝখানে ঢুকলেই কেমন একটা অস্বস্তি হয় তার। টের পায় ঘরের কোণে, আড়ালে আলোচনা চলছে। তাকে নিয়েই।
এই সমস্যা একা নিলার নয়। কম বেশি সব বিবাহিত মহিলাকেই এই ধরনের প্রশ্নমালার মুখে পড়তে হয়। বিবাহিত জীবনের বয়স অনুযায়ী প্রশ্নমালা বদলে যায় শুধু।
নারীকে বলা হয় মায়ের জাত। মাতৃত্বে নারী জীবনের সার্থকতা। তাই বিবাহিত সম্পর্কের অবশ্যম্ভাবী ও স্বাভাবিক পরিণতি হল সন্তান। সে ব্যাপারে কারও কোন ‘চয়েস’ থাকতে পারে না। তাই নিলার মত কেউ কেউ যদি সেই ক্ষেত্রে নিজের ‘ চয়েস’ খুঁজতে চায় তাহলে স্বজন-বন্ধুর ঠোঁটের কোণের হাসির রেখাটি বাঁক বদল করতে সময় নেয় না।
রাস্তা দিয়ে একা হেঁটে গেলে গুঞ্জন কান এড়ায় না মোহনার। সে আজকাল অপেক্ষা করে তার ৪০ বছরের জন্মদিনের জন্য। বয়স পেরিয়ে গেলে হয়ত কথারা থেমে যাবে একদিন।
প্রকৃত পক্ষে গর্ভধারণ নিতান্ত একটি জৈবিক প্রক্রিয়া। পারিবারিক উত্তরাধিকার রক্ষার দায় খুব সচেতন ভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয় সেই প্রক্রিয়ার ওপর। সেভাবেই মাতৃত্বকে মহান করে তোলা হয়েছে। পুরুষ ও পরিবারের সম্পত্তির অধিকারের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে নারীর জরায়ু কে। তার নিজের শরীরের মত এই অঙ্গ টিতেও তার কোন নিজস্ব অধিকার নেই। নেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও।
অথচ একদিন আমাদের সমাজ মাতৃতান্ত্রিক ছিল। সন্তান ধারণের ইচ্ছেরা ছিল স্বাধীন। সন্তানের পিতা নির্বাচন নারীর ইচ্ছাধীন বিষয়। গোষ্ঠী ও সম্পত্তির মালিকানা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেলে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ধারণাও। তখন এই স্বাভাবিক জৈবিক বিষয়টি সামাজিক রূপ তো পেলই, তার সঙ্গে তাতে লাগল গোষ্ঠী রাজনীতির রংও। সেই ধারা এখনও সমান বেগবতী। “আমরা বিয়ে করব, কিন্তু সন্তান আমাদের সেকেন্ডারি বিষয়” এই ডিক্লারেশন দেওয়া আজও সহজ নয় আমাদের সমাজে। মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত বা নিম্নবিত্ত স্তরবিন্যাস যাই হোক না কেন।
নারী যে শরীরে-মনে ঠিকঠাক নারী তার প্রমাণ দিতে হয় সন্তান ধারণের মাধ্যমে। আর এই সামাজিক প্রেক্ষাপটে স্রোতের বিপরীত মুখে দাঁড়িয়ে কেউ যদি বলে- মাতৃত্ব আমার ইচ্ছে। আমি ঠিক করব শরীরে বীজ ধারণ করব কিনা তখন স্বাভাবিক ভাবেই ভ্রু কুঁচকে যায় আশপাশের।
সন্তানহীন বিবাহিতা নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিতে কিছুটা ভয় কিছুটা সহানুভূতি যেমন মিশে থাকে, তেমনই কোথাও যেন একটা পরিতৃপ্তির উদ্গারও মিশে থাকে যেন। অর্থাৎ দেখ তুমি কী পাচ্ছ না আর আমি কী পাচ্ছি, এরকম গোছের। ভারতীয় সমাজে যে কোন শুভ অনুষ্ঠানে সন্তানহীনা নারী প্রবেশাধিকার পেলেও অংশগ্রহণের অধিকার কেবলমাত্র সন্তানবতীদেরই। সে বিয়ে হোক বা অন্নপ্রাশন। যে কোন শুভ অনুষ্ঠানে যেন তারা মূর্তিমান বিড়ম্বনা। তাই তাদের দেখা নিষেধ, ছোঁয়া নিষেধ। ‘বাঁজা’, ‘অপয়া’ সব শব্দ নির্দিষ্ট করা হয় সন্তানহীনার জন্য।
‘বহুদিনের প্রচলিত প্রথা এসব, বেয়াড়া ধরনের প্রশ্নগুলো তাই করতে নেই। শুভ অশুভ বলে একটা ব্যপার আছে না!’
আসলে যে কোন ভাবে তোমায় মা হতেই হবে। স্বামী পুত্র পরিবারে ভরা সংসার। দশমাস দশ দিনের গর্ভ যন্ত্রণা উদযাপন করে তবেই তোমার এয়োস্ত্রী জন্ম স্বার্থক।
আসলে সমাজের চাপিয়ে দেওয়া ‘মা’ ভূমিকায় যত টা না ইচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে, তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করে ভয়। নির্বাসিত হওয়ার ভয়। মূলস্রোত থেকে দূরে সরে যাবার ভয়। ‘আর সবার মত’ না হতে পারার ভয়। বৈবাহিক সূত্রে পাওয়া সম্পর্কগুলোর জটিল সুতোয় জট পাকিয়ে যাবার ভয়। অস্বাভাবিক জীবনের ভয়। অনেক সময়ই মাতৃত্বের আড়ালে চাপা পড়ে যায় বৈবাহিক ধর্ষণের ঘটনাও।
মাতৃত্বে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠতে গিয়ে অবলীলায় ঝেড়ে ফেলতে হয় নিজস্ব স্বপ্নগুলো। অথচ সেখানে ‘পুরুষের পিতৃত্বে পরিপূর্ণতা’ জাতীয় কোন তত্ত্ব কাজ করে না। ‘মাদারিং’ শব্দ টার সাথে ‘ ফাদারিং’ শব্দটা কি একই ভাবে উঠে আসে? আসে না। এটা কি অদ্ভুত ধারনা বলে মনে হয় না, যে আমরা সামাজিক পরিকাঠামো বা সিস্টেমের বদল নিয়ে এত কথা বলি কিন্তু মাতৃত্ব বা মা হওয়ার ওল্ড স্কুল কনসেপ্ট থেকে বেরতে পারিনা। তাই মোহনার মা না হওয়ার কারণ নিয়ে চর্চা চললেও তার পুরুষ সঙ্গীটির কেশাগ্র স্পর্শের সাহস পায় না কেউ।
গর্ভধারণ একটি নারীর শুধু সামাজিক জীবনে পরিবর্তন আনে না। তার শারীরিক ও মানসিক ক্ষেত্রেও বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। সেই পরিবর্তনের জের সামলে উঠতে অনেকেই পারে না। পার্মানেন্ট ডিপ্রেশনের শিকার হয়। নিজের কর্ম ও শিক্ষাক্ষেত্রের দৌড়টা হঠাৎ থমকে গেলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। শুধু জোর করে চাপিয়ে দেওয়া মাতৃত্বের দায়ে স্বপ্ন, স্বাধীনতা, বেঁচে থাকার ধরনের রাতারাতি পরিবর্তন দাম্পত্য সমস্যাও ডেকে এনেছে এমন নজির কম নেই। কিন্তু সে সব কাহিনি চাপা পড়ে যায় চার দেওয়ালের আড়ালে। আর প্রকাশ্যে যদি কেউ প্রশ্ন তোলে তাহলেও আড়ালের গল্প বলে বালিশ চেপে ধরে হয় প্রশ্নের মুখে। কাজেই যুক্তির মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায় সেখানেই…
মাতৃত্বেই সমস্ত সাফল্যের সার ভাবা বন্ধ করুন। নারীর জীবনের শেষ কথা যেন মাতৃত্ব না হয়। গর্ভধারণের ভারে যেন চাপা পড়ে না যায় ‘মেয়ে-মানুষের’ স্বপ্নগুলো। শারীরিক ভার, যন্ত্রণা, কষ্ট সহ্য করে নবীন নাগরিক আনার স্বপ্ন ও ইচ্ছে যেন তার নিজের বুক থেকেই উঠে আসে। কোন পুরুষ নয়। পরিবার নয়। সমাজ নয়। নিজের শরীরের গভীরে ভ্রূণ লালনের স্বপ্নটা নারীর নিজস্ব স্বপ্ন হোক। মা হওয়ার ইচ্ছে যেমন স্বাভাবিক তেমনই কারোর মা না হওয়ার সিদ্ধান্তকেও সম্মান জানাতে শিখি আমরা।বিয়েটা আর টিকবে?-ডাক্তার দেখাচ্ছিস?
এই প্রশ্নমালা যার উদ্দেশ্যে তার নাম নিলা।
উচ্চশিক্ষিত, আধুনিকমনস্ক একটি মেয়ে। নিজের কাজের জায়গায় দারুণ সফল। বিবাহিত। স্বামীর সঙ্গে সুখী দাম্পত্যে বহুদিন। কিন্তু নিঃসন্তান। উভয়ের মিলিত ইচ্ছেয় গর্ভধারণ বিষয়টি নিয়ে মোহনা মাথা ঘামায়নি কোনদিন। তার সঙ্গীরও সমস্যা নেই তাতে। বেশ চলছিল যৌথ জীবন। কিন্তু আজকাল পারিবারিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলে নিলা। আত্মীয় স্বজনের মাঝখানে ঢুকলেই কেমন একটা অস্বস্তি হয় তার। টের পায় ঘরের কোণে, আড়ালে আলোচনা চলছে। তাকে নিয়েই।
এই সমস্যা একা নিলার নয়। কম বেশি সব বিবাহিত মহিলাকেই এই ধরনের প্রশ্নমালার মুখে পড়তে হয়। বিবাহিত জীবনের বয়স অনুযায়ী প্রশ্নমালা বদলে যায় শুধু।
নারীকে বলা হয় মায়ের জাত। মাতৃত্বে নারী জীবনের সার্থকতা। তাই বিবাহিত সম্পর্কের অবশ্যম্ভাবী ও স্বাভাবিক পরিণতি হল সন্তান। সে ব্যাপারে কারও কোন ‘চয়েস’ থাকতে পারে না। তাই নিলার মত কেউ কেউ যদি সেই ক্ষেত্রে নিজের ‘ চয়েস’ খুঁজতে চায় তাহলে স্বজন-বন্ধুর ঠোঁটের কোণের হাসির রেখাটি বাঁক বদল করতে সময় নেয় না।
রাস্তা দিয়ে একা হেঁটে গেলে গুঞ্জন কান এড়ায় না মোহনার। সে আজকাল অপেক্ষা করে তার ৪০ বছরের জন্মদিনের জন্য। বয়স পেরিয়ে গেলে হয়ত কথারা থেমে যাবে একদিন।
প্রকৃত পক্ষে গর্ভধারণ নিতান্ত একটি জৈবিক প্রক্রিয়া। পারিবারিক উত্তরাধিকার রক্ষার দায় খুব সচেতন ভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয় সেই প্রক্রিয়ার ওপর। সেভাবেই মাতৃত্বকে মহান করে তোলা হয়েছে। পুরুষ ও পরিবারের সম্পত্তির অধিকারের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে নারীর জরায়ু কে। তার নিজের শরীরের মত এই অঙ্গ টিতেও তার কোন নিজস্ব অধিকার নেই। নেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও।
অথচ একদিন আমাদের সমাজ মাতৃতান্ত্রিক ছিল। সন্তান ধারণের ইচ্ছেরা ছিল স্বাধীন। সন্তানের পিতা নির্বাচন নারীর ইচ্ছাধীন বিষয়। গোষ্ঠী ও সম্পত্তির মালিকানা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেলে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ধারণাও। তখন এই স্বাভাবিক জৈবিক বিষয়টি সামাজিক রূপ তো পেলই, তার সঙ্গে তাতে লাগল গোষ্ঠী রাজনীতির রংও। সেই ধারা এখনও সমান বেগবতী। “আমরা বিয়ে করব, কিন্তু সন্তান আমাদের সেকেন্ডারি বিষয়” এই ডিক্লারেশন দেওয়া আজও সহজ নয় আমাদের সমাজে। মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত বা নিম্নবিত্ত স্তরবিন্যাস যাই হোক না কেন।
নারী যে শরীরে-মনে ঠিকঠাক নারী তার প্রমাণ দিতে হয় সন্তান ধারণের মাধ্যমে। আর এই সামাজিক প্রেক্ষাপটে স্রোতের বিপরীত মুখে দাঁড়িয়ে কেউ যদি বলে- মাতৃত্ব আমার ইচ্ছে। আমি ঠিক করব শরীরে বীজ ধারণ করব কিনা তখন স্বাভাবিক ভাবেই ভ্রু কুঁচকে যায় আশপাশের।
সন্তানহীন বিবাহিতা নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিতে কিছুটা ভয় কিছুটা সহানুভূতি যেমন মিশে থাকে, তেমনই কোথাও যেন একটা পরিতৃপ্তির উদ্গারও মিশে থাকে যেন। অর্থাৎ দেখ তুমি কী পাচ্ছ না আর আমি কী পাচ্ছি, এরকম গোছের। ভারতীয় সমাজে যে কোন শুভ অনুষ্ঠানে সন্তানহীনা নারী প্রবেশাধিকার পেলেও অংশগ্রহণের অধিকার কেবলমাত্র সন্তানবতীদেরই। সে বিয়ে হোক বা অন্নপ্রাশন। যে কোন শুভ অনুষ্ঠানে যেন তারা মূর্তিমান বিড়ম্বনা। তাই তাদের দেখা নিষেধ, ছোঁয়া নিষেধ। ‘বাঁজা’, ‘অপয়া’ সব শব্দ নির্দিষ্ট করা হয় সন্তানহীনার জন্য।
‘বহুদিনের প্রচলিত প্রথা এসব, বেয়াড়া ধরনের প্রশ্নগুলো তাই করতে নেই। শুভ অশুভ বলে একটা ব্যপার আছে না!’
আসলে যে কোন ভাবে তোমায় মা হতেই হবে। স্বামী পুত্র পরিবারে ভরা সংসার। দশমাস দশ দিনের গর্ভ যন্ত্রণা উদযাপন করে তবেই তোমার এয়োস্ত্রী জন্ম স্বার্থক।
আসলে সমাজের চাপিয়ে দেওয়া ‘মা’ ভূমিকায় যত টা না ইচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে, তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করে ভয়। নির্বাসিত হওয়ার ভয়। মূলস্রোত থেকে দূরে সরে যাবার ভয়। ‘আর সবার মত’ না হতে পারার ভয়। বৈবাহিক সূত্রে পাওয়া সম্পর্কগুলোর জটিল সুতোয় জট পাকিয়ে যাবার ভয়। অস্বাভাবিক জীবনের ভয়। অনেক সময়ই মাতৃত্বের আড়ালে চাপা পড়ে যায় বৈবাহিক ধর্ষণের ঘটনাও।
মাতৃত্বে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠতে গিয়ে অবলীলায় ঝেড়ে ফেলতে হয় নিজস্ব স্বপ্নগুলো। অথচ সেখানে ‘পুরুষের পিতৃত্বে পরিপূর্ণতা’ জাতীয় কোন তত্ত্ব কাজ করে না। না। এটা কি অদ্ভুত ধারনা বলে মনে হয় না, যে আমরা সামাজিক পরিকাঠামো বা সিস্টেমের বদল নিয়ে এত কথা বলি কিন্তু মাতৃত্ব বা মা হওয়ার ওল্ড স্কুল কনসেপ্ট থেকে বেরতে পারিনা। তাই মোহনার মা না হওয়ার কারণ নিয়ে চর্চা চললেও তার পুরুষ সঙ্গীটির কেশাগ্র স্পর্শের সাহস পায় না কেউ।
গর্ভধারণ একটি নারীর শুধু সামাজিক জীবনে পরিবর্তন আনে না। তার শারীরিক ও মানসিক ক্ষেত্রেও বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। সেই পরিবর্তনের জের সামলে উঠতে অনেকেই পারে না। পার্মানেন্ট ডিপ্রেশনের শিকার হয়। নিজের কর্ম ও শিক্ষাক্ষেত্রের দৌড়টা হঠাৎ থমকে গেলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। শুধু জোর করে চাপিয়ে দেওয়া মাতৃত্বের দায়ে স্বপ্ন, স্বাধীনতা, বেঁচে থাকার ধরনের রাতারাতি পরিবর্তন দাম্পত্য সমস্যাও ডেকে এনেছে এমন নজির কম নেই। কিন্তু সে সব কাহিনি চাপা পড়ে যায় চার দেওয়ালের আড়ালে। আর প্রকাশ্যে যদি কেউ প্রশ্ন তোলে তাহলেও আড়ালের গল্প বলে বালিশ চেপে ধরে হয় প্রশ্নের মুখে। কাজেই যুক্তির মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায় সেখানেই…
মাতৃত্বেই সমস্ত সাফল্যের সার ভাবা বন্ধ করুন। নারীর জীবনের শেষ কথা যেন মাতৃত্ব না হয়। গর্ভধারণের ভারে যেন চাপা পড়ে না যায় ‘মেয়ে-মানুষের’ স্বপ্নগুলো। শারীরিক ভার, যন্ত্রণা, কষ্ট সহ্য করে নবীন নাগরিক আনার স্বপ্ন ও ইচ্ছে যেন তার নিজের বুক থেকেই উঠে আসে। কোন পুরুষ নয়। পরিবার নয়। সমাজ নয়। নিজের শরীরের গভীরে ভ্রূণ লালনের স্বপ্নটা নারীর নিজস্ব স্বপ্ন হোক। মা হওয়ার ইচ্ছে যেমন স্বাভাবিক তেমনই কারোর মা না হওয়ার সিদ্ধান্তকেও সম্মান জানাতে শিখি আমরা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন