ইতিহাসের ধারায় বাংলার লোকশিল্প: নাটোরের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প শখের হাঁড়ি


ইতিহাসের ধারায় বাংলার লোকশিল্প: নাটোরের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প শখের হাঁড়ি


মানুষের জীবনধারা ও সাংস্কৃতিক গতিশীলতা পরস্পরের পরিপূরক।  কোনো বিশেষ অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান ঐ অঞ্চলের মানুষের জীবনাচার, রীতি, চিন্তন-প্রণালি, নিয়মাবলী, বিশ্বাস-সংস্কার, উৎসব-পার্বণ, ভাষা, সাহিত্য, শিল্পকলা, মূল্যবোধ ও চৈতন্যকে প্রভাবিত করে।  যেহেতু, একটি বিশেষ অঞ্চলের আবহাওয়া ঐ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বিকাশকে সরাসরি ত্বরান্বিত করে। এই বিবেচনায় নাটোর অঞ্চলের শখের হাড়ি ও নানাবিধ মৃৎশিল্পের মধ্যে বিশেষত্ব লক্ষ করা যায়। বাঙালির জীবনসম্পৃক্ত বিবিধ শৌখিন শিল্পোপকরণের মধ্যে শখের হাঁড়ি অন্যতম। এর রং, নকশা, মোটিফ এবং স্টাইলের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় চিরায়ত বাঙালি মানসের হারিয়ে যাওয়া আদিমতম ইতিহাসের স্মারক। নিছক ব্যবহারিক উপকরণ বা শখের বহির্প্রকাশ নয়; ক্ষেত্রবিশেষে ধর্মীয় তাগিদ, বৈদিক আচার এবং শাস্ত্রীয় নানা আনুষ্ঠানিকতাও এর সাথে যুক্ত রয়েছে। কাজেই, দেখা যায় সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় লৌকিক উৎসব-অনুষ্ঠানের কিছু কিছু পরিবর্তন সত্তে¡ও আধুনিক উৎসব-পার্বণে এর নান্দনিক উপযোগিতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পণ্য হিসেবে বাংলার শখের হাঁড়ির ঐতিহ্য অনেক পুরনো। আধুনিক প্লাস্টিক, সিরামিক, সিন্থেটিক, ধাতব, কাচ এবং ম্যালামাইন সামগ্রির প্রচলনের কারণে মাটির তৈরি তৈজসপত্রের চাহিদা এবং ব্যবহার কমলেও শখের হাড়ির আবেদন একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। লোকজ এবং সামাজিক উৎসব-পরবে শখের হাঁড়ির চাহিদা আগের চেয়ে কোনো অংশেই অপ্রতুল নয়।

গায়ে হলুদ, খৎনা, বিয়ে, জন্মদিন, অন্নপ্রাসন, নবান্ন, ১লা বৈশাখ, ১লা ফাল্গুনের মতো নানা উৎসবে শখের হাঁড়ির বহুল প্রচলন এবং ব্যবহার সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তুলনামূলক শস্তা এবং ঝুঁকি কম হওয়ার কারণে এর উৎপাদন এবং ব্যবসা দুটোই প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধারণ করে সগর্বে টিকে আছে। এর প্রধান এবং মৌলিক উপকরণের মধ্যে মাটির হাড়ি, রং ও তুলি উল্লেখযোগ্য। দৈনন্দিন জীবনের বৈচিত্র্যহীন আবর্তের মধ্যে মানুষ একটু নতুনত্বের স্বাদ পেতে চায়। এরই প্রয়োজনে তৈরি হয়েছে নানা আচার-অনুষ্ঠান। এই সকল আচার-অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক অনুষঙ্গের মাঝে নান্দনিক শিল্প হিসেবে শখের হাঁড়ির স্থান অত্যন্ত নিবিড়। বাংলায় এই আচার-অনুষ্ঠানের যেমন প্রাবল্য, এমন আর কোথাও দেখা যায় না। প্রসঙ্গত, জাতিগতভাবে বাঙালি খুবই আমোদপ্রিয় বা উৎসব-অনুষ্ঠানপ্রিয়। বাঙালির জীবনে শত দুঃখ-কষ্ট থাকলেও তারই মধ্যে বাঙালি নানা পালা-পার্বণ-পূজা-ব্রত উৎসবের আনন্দে মেতে থাকে।  বাংলায় এমন মাস খুব কমই আছে যে মাসে একটা না একটা কোনো অনুষ্ঠান নেই। উৎসব-পার্বণের বিবিধ ক্রিয়া অনুষ্ঠানের মধ্যে একটি জাতির মানসিকতা ও চিন্তার যে ছাপ ধরা পড়ে তার প্রকাশ পাওয়া যায় নাটোর জেলার শখের হাঁড়ির রং-রূপ-নকশায়।
২. প্রত্ন-ঐতিহাসিক সাক্ষ্য :
বাঙালির উৎসবকেন্দ্রিক সকল ক্রিয়া অনুষ্ঠানের সাথে শখের হাঁড়ি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতিক মূল্যায়নের অন্যতম উপাদান হিশেবে শখের হাঁড়ির আবেদন ও মূল্য গুরুত্ববহ। দেশি-বিদেশি অসংখ্য জাতির মনন-চিন্তন-দর্শন, আচার-আচরণ-সংস্কারে ঋদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির ক্রমবিকাশমান ধারার সাথে শখের হাঁড়ির সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। কোনো কোনো পন্ডিতের ধারণা খ্রীষ্টপূর্বাব্দ দ্বিতীয়-প্রথম শতাব্দী থেকে এদেশের মানুষের উপর আর্য ধর্ম,  ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব পরতে শুরু করে। ভারতবর্ষের প্রাচীনতম সভ্যতাসমূহের তত্ত¡তালাশ করলে প্রতিভাত হয় যে, বৈদিক ধর্মাচারের গোড়াপত্তন হয়েছিল এ অঞ্চলের মানুষের হাত ধরেই। সুঅতীতকালের মানুষের হাতেগড়া সভ্যতার মাঝে তাদের সাংস্কৃতিক চিন্তার বিকাশও ঘটেছিল সমাজউদ্ভূত নানাবিধ লোকাচার ও ধর্মবিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে। শখের হাঁড়ির সাথে এই উপমহাদেশের প্রাচীনতম সভ্যতার ইতিহাসের সম্পর্কও ঘনিষ্ঠতর। ভারতবর্ষের সভ্যতার প্রাচীনতার ইতিহাস এবং শখের হাঁড়ির ইতিহাস পরস্পরের পরিপূরক। ঐতিহাসিক তথ্য উপকরণের মাধ্যমে হরপ্পা-মোহেঞ্জোদারোর মতো সুপ্রাচীন বিলুপ্ত সভ্যতার প্রাচীনতার প্রধানতম নিদর্শন হিসেবে যে ধূসর রঙিন মৃৎপাত্রের কথা বলা হয়, তা শখের হাঁড়িরই নামান্তর। এর মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়েছে যে, বাইরে থেকে আসা আর্যগণ ভারতবর্ষে সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছিল এমন ধারণা আজ আর গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয় না। নানাবিধ লৌকিক আচারের সাথে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিশ্বাস-সংস্কারের মিশ্রণে বৈদিক ও পৌরাণিক ধর্ম-বিশ্বাসের পৌনঃপুনিক বিবর্তনের পথ বেয়ে বাঙালির জনপ্রিয় এবং ঐতিহ্যবাহী উৎসবসমূহ বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে।
একটা সময় ছিল যখন পন্ডিতেরা সাধারণভাবে এই ধারণা পোষণ করতেন যে ভারতে সভ্যতার উদয় হয়েছিল আর্য আগমনের অনেক পরে। বস্তুত, কিছু কিছু পন্ডিত এমন মতও পোষণ করতেন যে ভারতে সভ্যতার আমদানি করেছিল বাইরে-থেকে-আসা আর্য উপজাতিগুলি। তখন প্রায় প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির বিচ্ছিন্নতা এবং প্রাচীন প্রাচ্য পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সংস্কৃতির তুলনায় ভারতীয় সংস্কৃতির পশ্চাৎপদতার কথা বলা হতো।  হরপ্পা-যুগের মানুষের ধর্মবিশ্বাস ও তাদের সাংস্কৃতিক বিকাশ সম্পর্কিত এ পর্যন্ত-প্রচলিত বহুবিধ ধ্যানধারণাই অনেকখানি পরিমাণে নিছক অনুমানমাত্র। এগুলির সত্যাসত্য যাচাই হবে তখন, যখন প্রত্নতত্তবিদ পন্ডতেরা সিন্ধু-সভ্যতার বর্ণলিপির পাঠোদ্ধারে সমর্থ হবেন। তবে ইতোমধ্যে যা সাক্ষ্য প্রমাণ  মিলেছে, এমনকি তার ভিত্তিতেও একথা অস্বীকার করা প্রায় অসম্ভব যে হরপ্পা-সভ্যতার ঐতিহ্যসমুহ পরবর্তী বৈদিক যুগের উপজাতিগুলির বিকাশে একদা সুনির্দিষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। গত শতাব্দীর বেশ কয়েকটি দশক ধরে প্রতœতত্ত¡বিদ পন্ডিতেরা ভারতে ‘আর্য-আগমনের প্রশ্ন’টি নিয়ে বিতর্ক চালিয়ে আসছেন। তাঁরা নির্ধারণ করার চেষ্টা করছেন, কোথা থেকে এবং কীভাবেই-বা ইন্দো-আর্য উপজাতিগুলি একদা ভারতে এসেছিল। আর্যদের আদি বাসভূমি কোথায় ছিল, এ প্রশ্নটিও বিতর্কিত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। কিছু-কিছু পন্ডিত আর্যদের ভারতে অনুপ্রবেশকে দেখেছেন অতি উন্নত আর্যদের দ্বারা পশ্চাৎপদ আদিবাসীদের পদানত করা হিসেবে। আর্যরাই নাকি ভারতে সভ্যতার আমদানি ঘটায় এবং উন্নত এক সমাজ-ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করে এদেশে। এই জাতিতত্তে¡র ওপর ভিত্তি করে গড়ে-ওঠা বিভিন্ন ব্যাখ্যা অনুযায়ী জোর দিয়ে বলা হয় যে ‘জাতিগতভাবে বিশুদ্ধ’ আর্যরা ও ভারতের তৎকালীন জনসাধারণের মধ্যে নাকি স্পষ্ট এক জাতি-বৈষম্য বর্তমান ছিল। স্থানীয় জনসাধারণের পক্ষে স্বনির্ভর বিকাশ ও অগ্রগতির যে-কোনো সম্ভাবনাকেই সম্পূর্ণ নাকচ করে দেয় এই সমস্ত ব্যাখ্যা। বিজ্ঞানবিরোধী এইসব তত্ত¡কথা অনুযায়ী বলতে হয় যে একমাত্র আর্যদের আবির্ভাবের পরেই ভারতে অতি উন্নত এক সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, মানব-সভ্যতা সুনির্দিষ্ট এক চেহারা নেয়।
২.১ আর্য-অনার্য বিতর্ক
প্রত্নতত্ত্ববিদগণের আধুনিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে সিন্ধু-উপত্যকায় উন্নত এক সভ্যতা আবিষ্কৃত হওয়ায় বহু প্রত্নতত্ত্ববিদ পন্ডিত এ সভ্যতা সমম্পর্কে তাঁদের পূর্ববর্তী মত পরিবর্তনে বাধ্য হন, তবে পূর্ববর্তী অবৈজ্ঞানিক ‘তত্ত্বকথাগুলি’র প্রতিধ্বনি থেকে-থেকে শোনা যায় এখনও। একমাত্র যে সমস্ত জনগোষ্ঠীকে আর্য নামে অভিহিত করা চলে তারা হলো প্রাচীন ইরানীয় ও প্রাচীন ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী। এরাই একদা নিজেদের আর্য আখ্যা দিয়েছিল এবং যেসব অঞ্চলে এদের বাস ছিল তাদের আখ্যা দিয়েছিল ‘আর্যভূমি’। আসলে ‘আর্য’ শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছে ‘অরি’ শব্দ থেকে, বৈদিক যুগে ‘অরি’ অর্থে বোঝাত পরদেশী কিংবা ‘বিদেশী’, আর ‘আর্য’ অর্থে ‘নবাগত’ কিংবা ‘নবাগতের প্রতি পক্ষপাতী’। পরবর্তীকালে অবশ্য ‘আর্য’ শব্দের অর্থ দাঁড়িয়ে যায় ‘মহৎ বংশোদ্ভূত ব্যক্তি’।  তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞান-বিষয়ে গবেষণার ফলে জানা গেছে যে একদা এমন একটা সময় ছিল যখন প্রাচীন ইরানীয় ও প্রাচীন ভারতীয়রা একত্র বসবাস করতেন, তাঁরা ছিলেন তথাকথিত ইন্দো-ইরানীয় স¤প্রদায়ভুক্ত। এর প্রমাণ মেলে এই দুই জাতির ভাষার মধ্যে ঘনিষ্ট সাদৃশ্য ও তাদের শাস্ত্র-সাহিত্যের ঐতিহ্য থেকে (প্রাচীন ইরানীয়দের ‘আবেস্তা’ ও প্রাচীন ভারতীয়দের ‘ঋগ্বেদ’ থেকে)। তাছাড়া এই দুই জাতির ধর্মবিশ্বাস এবং তাদের বহু প্রাচীন সামাজিক রীতিনীতি, আচার-বিচারের মিল থেকেও এর প্রমাণ মেলে। আর্যদের আদি বাসভূমি, অর্থাৎ ইরানীয় ও ভারতীয়দের পূর্বপুরুষের বাসভূমি, কিছু-কিছু পন্ডিতের মতে ছিল মধ্য এশিয়ায়, আবার অপর কিছু পন্ডিতের মতে ছিল দক্ষিণ রাশিয়ার স্তেপভূমিতে। তদুপরি ঠিক কোন কোন পথ ধরে ইরানীয়দের পূর্বপুরুষেরা ইরানে ও ভারতীয়দের পূর্বপুরুষেরা ভারতে পৌঁছে ছিলেন সে-ব্যাপারেও কোনো ঐকমত্য নেই। এটা খুবই সম্ভব যে এই দীর্ঘস্থায়ী জন-স্থানান্তরণের ব্যাপারটা চলেছিল দুই বা ততোধিক যাত্রাপথ ধরে এবং বেশ কয়েকটি তরঙ্গের দমকে।

দুঃখের বিষয়, অপর একটি প্রশ্ন যার এখনও পর্যন্ত কোনো সদুত্তর মেলেনি তা হলো ইন্দো-আর্যরা ভারতের কোন অঞ্চলে প্রথম অনুপ্রবেশ করেন। প্রাচীন ইন্দো আর্যদের লিখিত পুথি যা এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে, তা থেকে এটা স্পষ্ট জানা গছে যে তাঁরা পূর্ব পাঞ্জাবে এবং যমুনা ও গঙ্গা নদীর ধারা দু’টির উত্তরাংশ বরাবর বসতি স্থাপন করেছিলেন। এ থেকে বোঝা যায় যে ইন্দো-আর্য উপজাতিগুলি হরপ্পা-সভ্যতার প্রধান নগরকেন্দ্রগুলি যে অঞ্চলে অবস্থিত ছিল সে অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেনি। বস্তুত, প্রতœতাত্তি¡ক আবিষ্কারাদির ফলে যে কাল-পরম্পরার হদিশ পাওয়া গেছে তা থেকে দেখা যায় যে সিন্ধু-সভ্যতার নগরকেন্দ্রগুলির অবক্ষয় ও ইন্দো-আর্যদের ভারত-আগমনের মধ্যে সময়ের বেশকিছু ফাঁক রয়ে গেছে। সিন্ধু-প্রদেশে হরপ্পা-সভ্যতার পতন ঘটে ইন্দো-আর্যদের ভারতে অনুপ্রবেশের কয়েক শতাব্দী আগেই।
Related image

২.২ শখের হাঁড়ি: মাটি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও প্রস্তুত কৌশল
সৌন্দর্য পিপাসু মানুষ তার অনুভূতির জগতের অস্থিরচিত্ত অবস্থা, কৌতূহল এবং বৈচিত্র্যের স্বাদের আকর্ষণ কোনো বস্তু জিনিস-কারুশিল্প তৈরিতে আরোপ করে থাকে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন ছাড়িয়ে আরো কিছু অতিরিক্ত অনুভব, সংস্কার, আচার মানুষকে তাড়িত করে। এ প্রসংগে বস্তুজাত সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত বস্তু-কারুশিল্পের নিদর্শনের গড়নে ও সম্পূর্ণতার বাহ্যরূপ সম্পর্কে নৃতাত্ত্বিক লুই বলেছেন যে বস্তু কারুশিল্প সরাসরি উপযোগিতার, প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু। অর্থাৎ বস্তুজাত সংস্কৃতির বস্তু, কারুশিল্পে উপযোগিতার গুণ বৈশিষ্ট্য ছাড়াও আছে অসাধারণ বাড়তি মাত্রার প্রতিসমগুণ সুরুচিসম্পন্ন, সুন্দর এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমতলের পরত।

বৈদিক যুগের মানুষেরা মাটির উপর নানা রকমের নকশা অঙ্কন করতো। তাছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে মৌর্য, কুষাণ ও গুপ্ত যুগের বিভিন্ন মৃৎপাত্রের নমুনা মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে। এসব মাটির পাত্রের মধ্য দিয়েই এযুগের মানুষের জীবন-যাপনের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। বৈদিক যুগে প্রতিমা পূজার প্রথা প্রচলিত ছিলো। এ কারণে পোড়ামাটির অসংখ্য প্রতিমা উদ্ধার সম্ভব হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত মৃৎশিল্পের নমুনা এই ধারাবাহিকতারই ফলশ্রুতি।  বিবিধ পূজা আচারের অনুষঙ্গ হিসেবে শখের হাঁড়ি ব্যবহারের ঐতিহ্য বেশ পুরনো। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে শুরু করে খ্রিস্টোত্তর দ্বিতীয়-তৃতীয় শতক পর্যন্ত গোটা গঙ্গা-যমুনা উপত্যকা ও মধ্যভারত পোড়ামাটির যে শিল্পকীর্তি ও ধারা গড়ে উঠেছিল মহাস্তানগর, পাহাড়পুর, পোখরানা, তমলুক, মেদিনিপুর, বর্ধমান, হুগলী বীরভ‚মে আবিষ্কৃত প্রাচীন পোড়ামাটির ফলকে তারই সুস্পষ্ট প্রতিফলন ধরা পড়েছে।  মহাস্তানগর, পাহাড়পুর, ময়নামতির মৃৎফলকে মানুষ ও জীবজন্তুর ছবিই ছিলো বেশি।  বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা মৃৎশিল্পের প্রাপ্ত নমুনা থেকে সহজেই প্রমাণিত হয় যে এদেশে মৃৎশিল্প বিকাশের অতীত ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। এর পশ্চাতে রয়েছে এদেশের পেশাগত একটি শ্রেণির অবদান। বৈদিক কাল থেকে এরা শূদ্র শ্রেণির অন্তর্গত কুম্ভকার বা কুমার নামে চিহ্নিত হয়ে আসছে। এদের উপাধি পাল।  বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের সঙ্গে শুধু যে হিন্দু সমাজের কুম্ভকার সম্প্রদায় যুক্ত আছে তা বলা যাবে না। কেননা এদেশের মুসলমানদের মধ্যেও মৃৎশিল্পী রয়েছে। এদের উপাধি ‘কুলাল’।  বাংলাদেশের ঐতিহাসিক প্রাচীন স্থাপনাগুলির মধ্যে সোমপুর বিহারের বিশ্বজোড়া খ্যাতি। বাংলাদেশের কুমাররেরা যে ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে মাটির কাজ করেন তাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। এই কাজের ধাপগুলির মধ্যে মাটি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, মাটিকে পাত্র বা হাঁড়ি তৈরির উপযোগী করা, চাকের সাহায্যে বা হাতের সাহায্যে মাটিকে পাত্রের আকার দেওয়া, রোদে শুকানো এবং শেষে আগুনে পোড়ানো।  মাটি সংগ্রহ সাধারণত শুকনা মওসুমে করা হয়। মৃৎশিল্পী পরিবারের পুরুষ সদস্যরাই মূলত এই মাটি সংগ্রহের কাজটি করে থাকেন। মাটি তোলার কাজে সাধারণত কোদাল, খোনতা ও শাবল ব্যবহৃত হয়।  মৌসুমী বায়ু, বর্ষা, বৃষ্টি নদ-নদী, খাল বিল, সবুজ শস্য ক্ষেত্রের দেশ বাংলাদেশ। আদি গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র যা আজকের পদ্মা, মেঘনা, যমুনার অসংখ্য শাখা-প্রশাখা বাংলার মানচিত্র জুড়ে শোভা পাচ্ছে। আবহামানকাল ধরে বাংলাদেশের মানুষ এই অসংখ্য নদীকেন্দ্রিক সবুজ প্রকৃতির মধ্যে বসবাস করছে। নদীর দুই তীরে শহর, বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ ও নতুন জনপদ রয়েছে। নদীর পলিমাটি বাংলাদেশের বস্তুজাত সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য নির্মাণে মৌলিক ভূমিকা পালন করেছে।  নাটোর জেলার মৃৎশিল্পের বিকাশের পেছনে এই নদীকেন্দ্রিক পলিমাটি প্রধানতম কাঁচামাল।
৩. শখের হাঁড়ির রং ও নকশা
শখের হাঁড়িতে রং করার জন্য প্রথমে তেতুলের বিচি ভেজে উপরের লাল খোসা ফেলে দিয়ে তা পানিতে ভিজিয়ে ছেঁচে জ্বাল দিয়ে আঠা বের করা হয়। ঐ আঠাতে চক পাউডার দিয়ে হাঁড়িতে প্রলেপ দেওয়া হয়। এইভাবে দুইবার প্রলেপ দিতে হয়। তারপরে পিউরী (হলুদ রং) তেতুলের বিচির আঠা দিয়ে আরেক বার প্রলেপ দিতে হয়। তারপর রং অর্থাৎ নকশা করা; ( যেমন নীল, গেরীমাটি, সবুজ) ইত্যাদি রং তেতুল বিচির আঠা দিয়ে রং, নকশা করতে হয়। লাল বা খুনি রং দুধ দিয়ে গুলিয়ে রং করতে হয়। এই রং ছাগলের ঘাড়ের একগুচ্ছো চুল পানিতে ভিজিয়ে হাতের মুঠে নিয়ে ছুচালো হয়েছে কিনা নিশ্চিত হয়ে কেটে তা বাঁশের কঞ্চিতে চিকন করে তার মধ্যে গোড়ার অংশটা সুতা দিয়ে তুলির মত করে বেঁধে সেই তুলি দিয়ে রঙের কাজ হয়। বর্তমানে চকচকে  করার জন্য রং দেওয়ার পর বার্নিশ, রজন, চাঁচ ইত্যাদির প্রলেপ দেওয়া হয়।” শখের হাঁড়ির নকশায় আগে মাছ, পাখি, হাতি, ঘোড়া, ফুল, বিভিন্ন রকম ফুল, পাতা, চিরুনী ইত্যাদির নকশা প্রচলিত ছিল। বর্তমানে অনেক রকম ফল, ফুল, ইত্যাদি নতুন নকশা করা হয়। “আগে মাছ, কাঁটা, ফুল ও দলের নকশা বেশি ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে সেগুলো ছাড়াও অনেক রকমের ফল, ফুলের নকশা তৈরি করা হয়ে থাকে। প্রকৃতি থেকে দেখেই নকশা হাঁড়িতে তোলা হয়ে থাকে।” বলা হয়ে থাকে, “গৌরীর বিয়ের সময়ে পালের সৃষ্ট, তখন থেকে নকশা ব্যবহৃত হয়। আগে রং ছিলনা। সে সময় আতপ চালকে পিসে পানি দিয়ে গুলিয়ে হাঁড়িতে বা ঘটে রঙ্গের প্রলেপ দেওয়া হতো। তারপর তিনটা সিদুরের ফোঁটা দিতো, তিনটা চন্দনের ফোটা দিত। পরে রঙের ব্যবহার হয়।”

কীভাবে শখের হাঁড়িতে নকশা তোলা হয় এ প্রসংগে রাজশাহী অঞ্চলের দেশখ্যাত মৃৎশিল্পী সুশান্ত পাল বলেন, ‘প্রথমে পিউরী অথবা সাদা রং দেওয়া হাঁড়িটিতে হাতে কেনি আঙ্গুল হাঁড়ির কাধে ঠেকিয়ে এবং পেটটা মাটিতে রেখে ডান হাতে পেট বরাবর করে কশি বা লাইনটানেন, আস্তে আস্তে ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে কশি টেনে পুরো হাড়ির পেটের চারদিকে কশি টানা হয়।’ এক্ষেত্রে লাল রং ব্যবহার করেন এবং হাঁড়িতে ইচ্ছা অনুযায়ী দু’ লাইন, তিন লাইন, চার লাইনের কশি টানা হয় এবং কশির মাঝের ফাঁকা অংশে মাছ, ফুল পাখি, হাতী, ঘোড়া, কাকই, শাপলা কলমি ফুল নকশা করা হয় এবং লাল রং দিয়ে নীচের অংশে দল তৈরি করা হয়। সেটা তিন লাইনে তিন রকমের ঝোলান হয়। সুশান্ত পাল মাছের নকশা তৈরিতেই সবচেয়ে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তিনি সবচেয়ে সুন্দরভাবে মাছ তৈরি করতে পারেন। মাছ তৈরি করতে প্রথমে লেজ, পরে মাথা এবং এর পরে দেহ বানাতে দুই দিক থেকে লাইন যোগ করে দেন। শাপলা ফুল বানাতে প্রথমে মধ্যের পাপড়ি খাড়া করে দেন, তারপরে দুপাশ থেকে, পাপড়ি জোড়ায় জোড়ায় যোগ করে দেন। এবং সুন্দর করার জন্য সাদা রঙ্গের রেখা টেনে দেন। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিপুরের মৃৎশিল্পী পলান পাল, নাটোর সদরের পালপাড়া, সিংড়ার কলম, বাগাতিপাড়া, নলডাঙ্গা, লালপুর, বড়াইগ্রাম প্রভৃতি এলাকার মৃৎশিল্পীরাও একই কায়দায় কাজ করেন। তবে পলান পালের কাজে ফুল, ফল, লতা-পাতা ও পাখির সমাহার বেশি দেখা যায়। নাটোর জেলায় শখের হাঁড়ির পরিবর্তে মাটির তৈরি বিবিধ তৈজসপত্রের চাহিদা বেশি থাকায় শিল্পীরা শখের হাঁড়ি তৈরিতে খুব একটা আগ্রহ দেখান না। সৌখিন হাঁড়ি বাজারজাত করার সমস্যা এবং তৈরির খরচ তুলনামূলক বেশি হওয়ার কারণে বিশেষ উৎসব ব্যতিরেকে শিল্পীদের শখের হাঁড়ি তৈরির আগ্রহ তুলনামূলক কম।
৪. নাটোর অঞ্চলের শখের হাঁড়ি
উৎসবপ্রিয় বাঙালির প্রতিদিনের জীবন, ধর্ম-সংস্কৃতি, আনন্দ-বেদনা এবং চিন্তার সাথে শখের হাঁড়ি একাকার হয়ে আছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলভেদে নাটোর অঞ্চলের মাটির তৈরি পাত্রের নানা বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য গড়নে, অলংকরণে ও আকারে লক্ষণীয়। এসব পাত্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচার, সংস্কার, ধর্ম, অনুষ্ঠান, উৎসব সম্পর্কিত। মৃৎপাত্রে অলংকরণ, রং এর ব্যবহার, মোটিফসমূহের উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে বাংলার প্রকৃতির ও লোকজীবনের পরিচয় মৃৎশিল্পী তার তৈরি মৃৎপাত্রে ফুটিয়ে তোলে। যেমন নাটোর জেলাসদরের পালপাড়া এবং গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুরের শিল্পীদের শখের হাঁড়ি। শখের হাড়িতে ব্যবহৃত নকশায় প্রকৃতিকে লোকজীবনের লোকসংস্কারে রূপান্তরিত করেছে মৃৎশিল্পী।  মূলত লোককারুশিল্প মানুষের জীবনযাপনের উপযোগী সাংস্কৃতিক পরিবেশের অনুষংগ। বস্তুত লোককারুশিল্পের বাহ্যিক রূপে ও গড়নে প্রাকৃতিক পরিবেশের ও মানুষের জীবনধারার বৈশিষ্ট্য যুগপৎ ক্রিয়াশীল। সেই সংগে যুক্ত হয়েছে মানুষের কৌশল ও দক্ষতার গুণ এবং সৌন্দর্য, ছন্দ ও নকশাগুণ। বিশ্বের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অঞ্চলের আঞ্চলিক, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা, নৃগোষ্ঠীর ভিন্নতা বিচিত্র ধরনের বৈশিষ্ট্যের বস্তুসংস্কৃতি- বস্তুজাত সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট বস্তু-লোককারুশিল্পের উদ্ভাবন ঘটিয়েছে। লোককারুশিল্প যেহেতু লোকজীবনের সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের প্রয়োজনে প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিসীমায় সৃষ্ট একটি সাংস্কৃতিক পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত, সেহেতু লোককারুশিল্প গ্রামীণ মানুষের জীবনযাপন ও কাজকর্মকেন্দ্রিক। যেমন নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিসীমায় এদেশের মানুষকে তার জীবনযাপনে সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টিতে অনিবার্যভাবে কৃষিকাজ, মাছধরা, মাটির হাঁড়িপাতিল তৈরি করা, নৌকা বানানো, বাঁশ-বেতের কাজ, সুতার তাঁত বোনার কাজকে বেছে নিতে হয়েছিল। এবং এসব কাজ করতে গিয়ে নানা বৈশিষ্ট্যের বস্তু লোক কারুশিল্পের উদ্ভব ঘটিয়েছিল এদেশের মানুষ। এভাবেই এদেশের গ্রামের সাধারণ মানুষ অনুভব ও চেতনায় প্রাকৃতিক পরিবেশের উপকরণ-কাঁচামাল, কৌশল-প্রযুক্তি, দক্ষতা দিয়ে বস্তুজাত সংস্কৃতি গড়েছে এবং অনিবার্যভাবে বস্তু সংস্কৃতির বস্তু লোককারুশিল্প সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশের নাটোর অঞ্চলের মৃৎশিল্পের দিকে লক্ষ্য করলে পরিদৃষ্ট হয় যে এটি দৈনন্দিন ব্যবহার্যতা থেকে নান্দনিক অলংকরণের মাধ্যমে উপকরণ হিশেবে সাধারণ থেকে অসাধারণ সৌন্দর্য সুষমা ও মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। নিত্য ব্যবহার্য হাড়ি-পাতিল, ঘটি-বাটি, শানকি, কলসি, পোড়মাটির পুতুল, মাটির মূর্তি, অলংকৃত পোড়ামাটির ফলক, মাটির প্রদীপ ইত্যাদি প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশের মানুষ তার জীবনযাপনের প্রয়োজনে নদীর পলি কাদামাটি দিয়ে তৈরি ও ব্যবহার করছে। এখনো বাংলার গ্রামগুলোতে মাটির জিনিসপত্র তৈরি হয়, তবে আগের মত নয়। মেশিনে তৈরি অভঙ্গুর এলুমিনিয়ামের হাড়ি-পাতিল গ্রামে ব্যবহার শুরু হওয়ায় মাটির জিনিসপত্রের ব্যবহারে ভাটা পড়েছে। তবে নাটোর অঞ্চলের বিভিন্ন থানায় এর ধারা এখনো রয়েছে। ক্রমশ এ ধারা ক্ষীণ হয়ে আসছে। মধ্যবিত্তের ড্রয়ইং রুম থেকে ব্যক্তিগত শোকেস হয়ে সংগ্রহশালা পর্যন্ত সর্বত্রই শখের হাঁড়ি আদরনীয়। প্রতিটি সামাজিক-পারিবারিক উৎসব থেকে জাতীয় সকল উৎসবের মাঝেই স্থান করে নিয়েছে এটি। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নাচ এবং লোকজীবনচিত্রের উপস্থাপনায় শখের হাঁড়ির অনুপস্থিতি কল্পনাই করা যায় না।
৫. গৃহস্থালি হাঁড়ি বনাম শখের হাঁড়ি
গবেষকগণ দেখিয়েছেন বাংলাদেশের মৃৎপাত্রের মধ্যে হাঁড়ি সাধারণ গৃহস্থালির প্রয়োজন থেকে সৌন্দর্যে, সুষমায়, চিত্রগুণসম্পন্ন চিত্রিত হাঁড়িতে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই সাধারণত দুই শ্রেণির হাঁড়ি নাটোর অঞ্চলে পাওয়া যায়। রান্নাবান্নার কাজে গৃহস্থালি প্রয়োজনে ব্যবহার্য নানা গড়ন, মাপের সাধারণ বড়ো, মাঝারি ও ছোটো হাঁড়ি এবং চিত্রিত হাঁড়ি। পালা-পার্বণ-পূজা উপলক্ষে লোক মেলায় বিচিত্র হাঁড়ির পসরা বসে। এছাড়া বিয়ে ও অন্যান্য লৌকিক আচার অনুষ্ঠানে, মিষ্টি, পিঠাসহ চিত্রিত হাঁড়ি গ্রামে আত্মীয়, কুটুম্বের বাড়িতে উপহার হিসেবে পাঠানো হয়। এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের বহু অঞ্চলের পল্লীগৃহে ঝুলানো নকশী পাটের সিকায় এই চিত্রিত হাঁড়ি শোভা পায়। সাম্প্রতিককালে এই চিত্রিত হাঁড়ির ব্যবহারের আরো বৈচিত্র্য এসেছে যেমন এখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের তোরণ নির্মাণে ব্যবহার হয়। এবং শহরে, নগরে বাড়িঘরের বৈঠকখানায় চিত্রিত হাঁড়ি সংস্কৃতির পরিচায়ক, অহংকারের, গৌরবের বস্তু হিসেবে স্থান দখল করে নিচ্ছে। অঞ্চলভেদে বাংলাদেশের চিত্রিতহাঁড়ির নাম, গড়ণ, নকশা, মটিফ চত্রিগুণ ও সৌন্দর্য্যে বিভিন্নতা ও পার্থক্য লক্ষণীয়। এ চিত্রিত হাঁড়ির নাম কোথাও রঙ্গের হাঁড়ি, কোথাও শখের হাঁড়ি নামে পরিচিত। তবে বাংলাদেশে এই চিত্রিত হাঁড়ির অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন নাম থাকলেও সমগ্র বাংলাদেশে রাজশাহী অঞ্চলের শখের হাঁড়ির নাম বিশেষ জনপ্রিয়। এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও অনুরূপ চিত্রিত হাঁড়ি তৈরি হয় এবং সেখানেও চিত্রিত হাঁড়ির নাম “শখের হাঁড়ি” বলে পরিচিত (1) M. K. Pal (1978-177) (2) Kamaladevi Chattopadhay. (1975: 134)।  বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই চিত্রিত হাঁড়ি পাওয়া যায় এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অঞ্চলগুলো হচ্ছে রাজশাহীর সিন্দুরকুসুম্বী, বায়া, হরগ্রাম এবং বসন্তপুর, চাপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থানার বারোঘরিয়া গ্রাম, ঝিানাইগাতি থানা, ঢাকার নয়ারহাট, কুমিল্লা, গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী, ফরিদপুরের কোয়েলজুড়ি ও হাসরা, টাঙ্গাইলের কালিহাতি, জামালপুরের বজরাপুর, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড থানার ইদ্রিলপুর, ময়মনসিংহের ভাঙ্গাসুর বিশেষ উল্লেখযোগ্য।  এছাড়া রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বাঙ্গালপাড়া, নাটোর সদরের পালপাড়া, গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুর প্রভৃতি স্থানেও শখের হাড়ি তৈরি ও বাজারজাত করা হয়।

৬. শখের হাঁড়ির বর্তমান অবস্থা
আধুনিক নগর সংস্কৃতির বিকাশের সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং অবকাঠামোগত পরিবর্তনের ফলে জনমানুষের জীবনযাত্রার মানও উন্নত হয়েছে। লৌকিক উৎসবসমূহ জমকালো হয়ে বাঙালির জীবনে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। বাংলা নববর্ষ, বৈশাখী মেলাসমূহ, ফাল্গুন মেলা, চৈত্রসংক্রান্তির মেলা, বিভিন্ন স্থান ও ব্যক্তিনাম স্মারক মেলাসমূহে শখের হাঁড়ির সমারোহ গ্রামবাংলার সর্বত্রই দেখা মেলে।“শখের হাঁড়ি” এই নামের চিত্রিত হাঁড়ি বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের। সেজন্য বর্তমানে এর সাধারণ নাম রাজশাহীর শখের হাঁড়ি। একটি স্থানীয় নাম যুক্ত হয়েছে। রাজশাহী জেলার কয়েকটি অঞ্চল যেমন সিন্দুর কুসুম্বী, বায়া, হরগ্রাম, বসন্তপুর এবং চাপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থানার বারোঘরিয়া গ্রাম, এসব এলাকা শখের হাঁড়ি তৈরির এলাকা। তবে বর্তমানে সর্বত্র আধুনিক জীবনযাত্রার প্রভাবে লোককারুশিল্পের চাহিদা ধীরে ধীরে হ্রাস পাওয়ার প্রেক্ষিতে শখের হাঁড়ির চাহিদাও হ্রাস পেয়েছে। আগের মতো শখের হাঁড়ি শিল্পী পরিবারের সদস্যরা তাদের পিতৃপুরুষের শৈল্পিক পেশা শখের হাঁড়ি সৃষ্টির পরিবর্তে ধীরে ধীরে অন্যান্য পেশার দিকে ঝুঁকছে। আর্থ-সামাজিক কারণে তারা তাদের মূল আবাস এলাকা থেকে জমি বিক্রি করে অন্য নতুন এলাকায় বসতি স্থাপন করে নতুন পেশায় নিয়োজিত হয়েছে। ফলে শখের হাঁড়ি তৈরির শিল্পী পরিবার এখন একেবারেই কমে গেছে।

শখের হাঁড়ি বাংলার লোককারুশিল্পের ঐতিহ্য। আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক উপাদানও বটে। চলনবিলের অন্তর্গত নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার বিয়াশ গ্রামে প্রতিবছর বৈশাখ মাসের শেষ মঙ্গলবার মেলা বসে। মেলার নাম শংকরের মেলা। বিয়াশ গ্রামের শংকর নামে জনৈক ব্যক্তি উক্ত মেলাটির প্রচলন করেছিলেন বলে তার নামে মেলাটি পরিচিত হয়ে উঠেছে। উক্ত মেলায় বর্তমান প্রবন্ধকারের কথা হলো কারুশিল্পী পলান পালের সাথে। তার বাড়ি গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুর গ্রামে। পলান পালের সাথে কথা বলে কিছুটা আশ্বস্ত হন বর্তমান প্রবন্ধকার। পলান পাল নিজে মৃৎশিল্পের সাথে যুক্ত আছেন। পাশাপাশি অন্যদেরকেও যুক্ত করে পৃষ্ঠপোষকের কাজ করছেন। তার ব্যবসা এবং রোজগার মোটামুটি ভালো। নাটোর সদরের চন্দন পালও পূর্বপুরুষের পেশা হিশেবে মৃৎশিল্পের নানা উপকরণ এবং শখের হাঁড়ি তৈরি করেন। তার ব্যবসাও মোটামুটি ভালো। তারা বিভিন্ন মেলায় ঘুরে ঘুরে দোকান বরাদ্দ নিয়ে মৃৎশিল্প এবং শখের হাঁড়ি বিক্রি করেন। তাছাড়া তাদের নিজ গৃহেও পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা রয়েছে। নিজ নিজ গৃহসংলগ্ন বাজারেও তাদের পণ্য বিক্রির দোকান  রয়েছে। বিভাগীয় এবং জেলাসদর গুলোতে বিবিধ কারুপণ্যের দোকানে শখের হাঁড়ি বিক্রি করতে দেখা যায়। সারা বছর মৃৎশিল্পের নানা উপকরণ তৈরি করা হলেও বিশেষ উৎসবকে সামনে রেখে শখের হাঁড়ি তেরি করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তবে সবসময়ই কিছু বিক্রয়যোগ্য শখের হাঁড়ি তাদের সংরক্ষণে থাকে। বাংলাদেশের প্রখ্যাত শখের হাঁড়ির শিল্পীদের মধ্যে পবা থানার বসন্তপুরের সুশান্ত কুমার পাল, হরগ্রামের শিল্পী হরেন্দ্র চন্দ্র পাল, চাঁপাইনবাবগঞ্জের বারোঘড়িয়ার গোপালচন্দ্র পাল, চিত্তরঞ্জনপাল, লাল্টু পাল, বসন্তপুরের নয়নবালা দেবি, ল²ীনারায়ণ পাল প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। মুহম্মদ আবদুল জলিল ২০০৭ সালে এই শিল্পীদের উপর অনুসন্ধানভিত্তিক গবেষণা করে ‘রাজশাহী অঞ্চলের মৃৎশিল্প: শখের হাঁড়ি’ নামক গবেষণামূলক গ্রন্থখানি রচনা করেন, যা বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। সৈয়দ মাহবুব আলম তার ১৯৯৯ সালে সোনারগাঁও থেকে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন প্রকাশিত লোকশিল্প গ্রন্থখানি রচনা করতে গিয়ে সুশান্ত পালের উপর ব্যাপক অনুসন্ধান করেন। শিল্পীর জীবনজিজ্ঞাসার নানা মাত্রাকে উপস্থাপনার সাথে সাথে তিনি শখের হাঁড়ির সংকট ও সম্ভাবনার দিকটিকে প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের শিক্ষার্থী দেবযানী সরকার রাজশাহী জেলার পবা উপজেলার বসন্তপুর গ্রামের দেশখ্যাত সুশান্ত কুমার পালসহ ৬ জন শখের হাঁড়ির শিল্পীর উপর ক্ষেত্রসমীক্ষাভিত্তিক অনুসন্ধান পরিচালনা করেন, একই সময়ে বায়া, পালপাড়ায় ক্ষেত্রসমক্ষিাভিত্তিক গবেষণা কাজ করতে গিয়ে ৮ জন শখের হাঁড়ির শিল্পীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। অপর একটি ক্ষেত্রসমীক্ষায় পুঠিয়া উপজেলার বাঙ্গালপাড়ার জগদীসপুর গ্রামের ৮ জন শখের হাঁড়ির শিল্পীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। তার গবেষণাপত্রটি ‘রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প: সখের হাঁড়ি’ শিরোনামে ২০১১ সালের এমএসএস পরীক্ষার রিসার্চ মনোগ্রাফ হিশেবে ফোক ৫১০ কোর্সের শর্ত পূরণার্থে ফোকলোর বিভাগে উস্থাপিত হয়।
৭. উপসংহার
বর্তমান প্রবন্ধে মৃৎশিল্পের প্রেক্ষিতে শখের হাঁড়িকে মূল প্রতিপাদ্য করে সীমিত পরিসরে বাঙালির জীবনসম্পৃক্ত সামাজিক সাংস্কৃতিক-ইতিহাসের বিবর্তনের ধারাকেই প্রত্যক্ষ করা হয়েছে। বাংলা তথা ভারতবর্ষের বৈদিক ধর্মাচারের  প্রত্যক্ষ প্রভাব লোকশিল্প তথা মৃৎল্পিকে কীরূপে আচ্ছন্ন করে তা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। নাটোর অঞ্চলের শখের হাঁড়ির গড়ণ, রূপ ও বৈশিষ্ট্য একান্তই এই অঞ্চলের স্থানিক বৈশিষ্ট্যের সমুজ্জ্বল এবং স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার। স্থানিক ও কালিক ব্যবধানে লোক সমাজের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় প্রবহমান ধারায় বেঁচে থাকে লোকশিল্প। পূর্বপুরুষ থেকে শেখা কৌশল ও দক্ষতা এসব নিয়ে জীবনযাপনের তাগিদ। কালভেদে তার অনুভূতিতে, জীবনযাপনের এবং শখের হাঁড়ি সৃষ্টিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া অনিবার্যভাবে যুক্ত হয়েছে তার প্রমাণ শিল্পীর নিজের কথায়। যেহেতু লোক কারুশিল্প সাংস্কৃতিক, নদীর স্রোতধারার মত প্রবহমান এবং পদ্মা মেঘনা, যমুনা আমাদের জীবনে যেমন সতত চলমান, সেহেতু বাংলাদেশের লোককারুশিল্পের রত্নভান্ডারের এক অমূল্য সম্পদ শখের হাঁড়ি সাংস্কৃতিক রূাপান্তরের ধারায় চলমান থাকবে। এর যথাযথ সংগ্রহ সংরক্ষণ, গবেষণা ও পুনুরুজ্জীবনে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। নাটোর জেলার  লোকশিল্পীদের পেশা পরিবর্তন এবং শিল্পবিমুখতা রোধে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে আর্থিক পরিপোষণ এবং সমবায়ভিত্তিক উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত জরুরি।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

২০০০ সালে এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৫৯০ দুর্ঘটনার মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে কনকর্ড যুগের।

বাংলাদেশের সকল রাজবাড়ী ও জমিদার বাড়ীগুলির ইতিহাস ও বর্তমান অবস্হা কি (ভিডও সহ )