কাকেদের মনে রাখার ক্ষমতা অনেক
কাক কেমন বুদ্ধিমান

কাকেদের সঙ্গে মানুষদের সম্পর্ক বেশ পুরাতন। আদি থেকেই মানুষ এই পাখিকে তার গায়ের রঙ,কদাকার চেহারা ও কর্কশ আওয়াজের জন্যে মরণের প্রতীক হিসেবে ভয় করে এসেছে। সীগাল ও কাকদেরকে কোনো কোনো সম্প্রদায়ের মানুষ সৃষ্টিকর্তা হিসেবে সম্মানও করেছে। এবং কাকদের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কারণে প্রতারণার দেবতা হিসেবে মানুষ তাদেরকে পূজা দিয়েছে। কাকদের বুদ্ধি এতই সাংঘাতিক যে আমরা রীতিমত তাদের ভয় পেতে শুরু করব… যদিও এরা তেমন ক্ষতিকর না, বরং মাঝে মধ্যে মানুষের উপকারই করে থাকে। নিচে কাকদের প্রখর বুদ্ধিমত্তার দেখা মিলবে এমন ৬টি ঘটনা।
৬. কাক চেহারা মনে রাখেএকটা কাকের দিকে যত সময় নিয়েই তাকিয়ে থাকেন না কেন পরে অন্য কাক থেকে সেই কাককে আপনি আলাদা করতে পারবেন না। কিন্তু সেই কাকটি ঠিকই অন্য মানুষ থেকে আপনাকে আলাদা করে চিনতে পারে।এটা আন্দাজে বলা কথা না। ওয়াশিংটনের সিয়াটলে গবেষকরা কাকদের পর্যবেক্ষণ করে এ ব্যাপারাএ নিশ্চিত হয়েছেন।

তারা ৭টা কাক নিয়ে এই পরীক্ষা চালান। কলেজ ক্যাম্পাস থেকে কাক ৭টা ধরে চিহ্নিত করে ছেড়ে দেন তারা। এ সময় গবেষকরা মুখোশ পরে ছিলেন। পর্যবেক্ষণের বিষয় ছিল, কাকেরা মানুষের মুখ মনে রাখতে পারে কিনা তা বিচার দেখা। দেখা গেছে কাক মানুষের মুখ মনে রাখতে পারে। শুধু তাই না, কাক কারো বিরুদ্ধে ক্ষোভ পুষে রাখতে সক্ষম।
গবেষকরা পরে যখন মুখোশ পরিহিত অবস্থায় ক্যাম্পাসে বের হয়েছেন তখন কাকেরা তাদের উপর ঝাপিয়ে পরে আক্রমণ করেছে। কেবল ৭টা কাকই না, ক্যাম্পাসের প্রায় সব কাক তাদের উপর আক্রমণ শুরু করে।
গবেষকরা একেক রকম মুখোশ পরে একই পরীক্ষা চালিয়েছেন। দেখা গেছে যে যে মুখোশ পরা অবস্থায় কাকদের বিরক্ত করা হয় নাই কাকেরাও সেই সেই মুখোশে আক্রমণ করে না।অল্প ক্ষণেই ক্যাম্পাসের সব কাক জেনে গিয়েছিল কোন মুখোশ তাদের জন্যে সমস্যার এবং কোন মুখোশে হামলা করতে হবে।তবে মুখোশহীন অবস্থায় কাকেরা কোনো গবেষককে আক্রমণ করে নি।গবেষকরা বিশ্বাস করেন, মানুষের চেহারা মনে রাখার ব্যাপারটি আসলে প্রাণিদের নিজেদেরকে আলাদাভাবে চিনতে পারার যে ক্ষমতা তারই বিকশিত রূপ।
কাকেরা ষড়যন্ত্র করে
যে কাকদের গবেষণাগারে আটকানো হয় নাই তারা কীভাবে মুখোশ চিনতে পারলো? গবেষকরা মনে করেন, মুখোশের কথা অন্য কাকদের জানানো হয়েছে।কাক কা কা ধ্বনির মাধ্যমে কেবল ডাকাডাকিই করে না, একে অন্যের সাথে যোগাযোগও করে থাকে। অবাক করার ব্যাপার হলো, কাকেদের শুধু ভাষাই নেই, অঞ্চলভেদে আলাদা আলাদা উচ্চারণ রূপও আছে।
কাকেরা কেবল দৃষ্টিসীমার জিনিসকেই শনাক্ত করতে বা চিনতে পারে তা নয়, বরং তারা ডিটেইল সহ তা মনে রাখতে পারে। মুখোশগুলিকে চিনে নিয়েছিল ৭টি কাক, ক্যাম্পাসের সব কাক আগে মুখোশ দেখতে পায় নি। কিন্তু অন্য সব কাকও সেই ৭টি কাকের মতই মুখোশগুলির বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে একই রকম নিশ্চিত ছিল। তা তাদের হামলার ব্যাপার থেকেই বোঝা যায়।
এমনকি এই কাকদের পরবর্তী প্রজন্মও এই নির্দিষ্ট মুখোশগুলির ব্যাপারে একই আচরণ করবে, কারণ কাকেরা তাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও নিখুঁতভাবে সবকিছু জানিয়ে রাখতে পারে।আপনি জেনে অবাক হবেন যে, আপনি যদি একবারের জন্যও কোনো কাকের ক্ষোভের কারণ হন তাহলে তার পরবর্তী প্রজন্মের কাকেরা হয়তো প্রতিশোধমূলক মনোভাব নিয়ে আপনাকে লক্ষ্য করছে।
একটি কাক অন্য কাকের সাথে কথা বলে এবং তারা নির্দিষ্ট বস্তুকে আক্রমণ করার ব্যাপারে শলা-পরামর্শ করে থাকে।তাদের এই কর্কশ কথোপকথনকে বিজ্ঞানীরা কাক বিতর্ক হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
৪. কাকেদের মনে রাখার ক্ষমতা অনেক
ঘটনাটা কানাডার অন্টারিওর চাথামের। প্রতি বছর মাইগ্রেশনের সময় কাকের দল সেখানে কয়েক দিন সময় কাটায়। একবার দেখা গেল কয়েক লাখ কাক সেখানে আস্তানা গেড়েছে।চাথাম কৃষিকাজের জায়গা, দলে দলে কাক সেখানকার ফসলের ক্ষেত উজাড় করতে লাগলো। শহরের মেয়র কাকদের বাসা ধ্বংস করার ঘোষণা দিলেন। ৬ লাখ কাকের মধ্যে অন্তত ৩ লাখ কাককে তারা আটক করতে পারবেন এই আশায় শহরের লোকজন বেরিয়ে পড়ল।
দুর্ভাগ্য শহরবাসীর, এই খবর চাথামের অতিথি কাকদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। ঘোষণার পর প্রথম দিনে শিকারীর গুলিতে ১টা কাক মারা যায়। পর থেকে চাথামের সব কাক বন্দুকের রেন্জ থেকে অনেক উপর দিয়ে অন্টারিওতে চলাচল শুরু করে। সে বছর মেয়রের পক্ষে আর কোনো কাককে মারা সম্ভব হয় নি।
মনে হতে পারে, অন্টারিওর এই ঘটনা কাকতালীয়, তবে দুনিয়ার সব কাক এই নিয়মেই ভ্রমণ করে থাকে। এবং কোনো কাকই তেমন জায়গায় যাবে না যেখানে আগে কোনো কাক মারা পড়েছিল।
৩. কাক যন্ত্র ব্যবহার করে
কোনো পোষা বানর আপনাকে ঘাস কাটার মেশিন এগিয়ে দিচ্ছে, বা পোষা কুকুর মুখে কাঠি বা অন্য কিছু নিয়ে মালিককে সাহায্য করছে এ রকম দেখা যায়। কিন্তু কোনো পাখি কি এরকম করে?
গবেষকরা এক বার এক টুকরা মাংস একটা তারে বেঁধে তারটা একটা লাঠি থেকে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। দেখা গেছে কাকেরা লাঠিটির উপর দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে তারটিকে টেনে তোলে এবং পা দিয়ে ধরে রাখে। মাংসখণ্ড না পাওয়া পর্যন্ত তারা একই ভাবে এই কাজ করতেই থাকে।
ঈশপের গল্পে ছিল পাথর ফেলে কলসির নিচের পানি উঠিয়ে আনার কথা। ঈশপের গল্পের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকলেও সাম্প্রতিক পরীক্ষায় একই রকম জিনিস দেখা গেছে।
রুক নামের ছোট এক ধরনের কিছু কাককে নুড়িভর্তি একটা ঘরে আটকে রাখা হয়। এরপর একটা টিউবে পানিসহ পোকা এনে দেয়া হয়। টিউবের ভেতরে পানিতে পোকাদের অবস্থান এমন ছিল যাতে কাকেরা সহজে তা ঠোঁটে তুলতে না পারে। দেখা গেছে, দুটি কাক প্রথমবারের চেষ্টায়ই কাজটি করতে পেরেছে এবং অন্য দুটি দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় কৌশল আবিষ্কার করেছে। তাদের পদ্ধতি ছিল খুব গোছানো। যতক্ষণ পর্যন্ত না পোকাগুলি তাদের আওতায় আসছে তারা শুধু ততক্ষণই পানিতে নুড়ি ফেলে গেছে।
আরেক পরীক্ষায় একটা বাক্সের ভিতর খাবার রেখে সেটা একটা টিউবে রেখে দেয়া হয়। বেটি এবং অ্যাবেল নামের দুটি কাকের কাছে টিউবটি রাখা হয়। কাক দুটির কাছে দুই খণ্ড তার ছাড়া আর কিছুই ছিল না। একটা তার ছিল হুকের মত বাঁকানো আর আরেকটা সোজা। তারা তার দুটি ব্যবহার করে টিউবের ভেতর থেকে খাবারের বাক্সটি বাইরে নিয়ে আসে। এমন না যে, এই কাজটির উপর তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তারা প্রথমবারের মতই এই কাজটি করে।
কাকেদের পাখায় ক্যামেরা লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন তারা গাছের ডাল ব্যবহার করে গাছের কোটর থেকে পোকা বের করে। তারপর ঘাস এবং পাতা ব্যবহার করে ছুরি তৈরি করে এবং সেই ছুরি থেকে তারা প্রয়োজনীয় অন্যান্য যন্ত্রও তৈরি করে থাকে।
আরেক পরীক্ষায় একটা কাককে একটা বাক্সে রাখা হয়। সেখানে একটা ছোট লাঠিও রাখা হয়েছিল। একটু দূরে দুটি আলাদা খাঁচার একটাতে এক টুকরা মাংস এবং একটাতে বড় লাঠি রাখা হয়। বড় লাঠির খাঁচাটি ছিল তুলনামূলক ভাবে কাছে। কাকটি সময় নষ্ট না করে ছোট লাঠিটি তুলে নিয়ে সেটির সাহায্যে প্রথমে বড় লাঠিটি নিয়ে আসে, তারপর বড় লাঠির মাধ্যমে মাংসের টুকরা বের করে নিয়ে আসে।
২. পরিকল্পনা করে কাজ করে কাক
আমরা যখন পরিকল্পনা করি তখন আমাদের মধ্যে এক ধরনের অলসতা কাজ করে, কারণ আমরা ভাবি যে এখনই কাজ করতে হবে। যে বিষয়েই হোক না কেন সেটা নিয়ে অধিকাংশ প্রাণীই পরিকল্পনা করে। এক্ষেত্রে কাকও আলাদা নয়।
https://www.youtube.com/watch?v=URZ_EciujrE
যেহেতু কাক খুব চতুর এবং সুযোগসন্ধানী তাই কাকের চোর হিসেবে বদনাম আছে। এবং কাক এই বদনাম লুকানোরও চেষ্টা করে না।
মজার ব্যাপার হলো, কাক প্রায়ই গর্ত করে খাবার লুকিয়ে রাখে। আরেক দিকে চোখ রাখে, অন্য কাক এই লুকানোর ব্যাপারটি দেখে ফেলছে কিনা। যখন দেখে অন্য কাক দেখে ফেলছে, তখন গর্তে খাবার লুকানোর ভান করে। আসলে সে খাবারটি তার বুকের এবং পাখার আড়ালে লুকায়। তারপর অন্য কোথাও উড়ে গিয়ে গর্ত করে খাবার লুকিয়ে রাখে। কিন্তু যে কাক লুকানোর ঘটনা দেখছিল, সেও আড়াল থেকে কাকটিকে অনুসরণ করে এবং লুকানোর আসল জায়গা দেখে ফেলে, কিন্তু তারা দুয়েই জানে এরপর দ্বিতীয় কাকটি গর্ত থেকে খাবার নিলে প্রথম কাকটিও আড়াল থেকে তাকে লক্ষ্য রাখবে। এভাবে তাদের মধ্যে ক্রমাগত চোর-পুলিশ খেলা চলতেই থাকে।
কাক খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে খাবারের পরিকল্পনা করে। কখন কী খাবার খাবে, কোথায় খাবার পাবে, সে তার সঙ্গীকে খাবার থেকে কতটুকু দিবে এগুলি সে পরিকল্পনা করেই ঠিক করে। তবে অন্য কাকদের সাথে মাঝে মধ্যে যখন তাদের স্নায়ুযুদ্ধ চলে তখন খাবার লুকোনোর জায়গাও থাকে আলাদা।
কাক সুযোগসন্ধানী প্রাণী, এদের মধ্যে চৌর্যবৃত্তি আছে, এবং অধিকাংশই বেশ পরিকল্পিত চুরির ঘটনা।
কাকের যখনই খাবারের প্রয়োজন হয় তখনই সে ময়লার কাছাকাছি চলে যায়। এবং সেখান থেকে চোখের পলকে খাবার নিয়ে ছুটে যায় অন্য গন্তব্যে। মাটির নিচে অথবা গাছের ডালে খাবার লুকায়।
কাক নিয়ম মনে রাখে
কাক খুব দুর্দান্তভাবে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে, যে কোনো পরিস্থিতিতে।তা সে যে ধরনের খাবারই দেয়া হোক না কেন। সে এই কাজে মানুষের জীবনযাপন থেকে সাহায্য নেয়। মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বেশ কড়া নজর রাখে যাতে কাক তার পূর্ণ শক্তি ব্যবহার করতে পারে। আর এভাবেই কাক বেশ কয়েক দিক থেকে মানুষের চেয়েও ধূর্ত!
কাক একেবারে সঠিক উচ্চতা থেকে আখরোট ফল নিচের পাকা জায়গায় ফেলে যাতে তা নিচে পড়ে ফেটে যেতে পারে এবং খাওয়ার উপযোগী হয়।
কাক গাড়ির সামনে আখরোট ফেলে দিয়েও তাদের কাজ উদ্ধার করে। এক্ষেত্রে কাকদের হিসাব একদম নিখুঁত। কাকেরা ট্রাফিক সিগন্যাল মুখস্ত রাখে। সে অনুযায়ী তারা সঠিক মুহূর্তে উপর থেকে আখরোট ছেড়ে দেয়, কিন্তু কেবল লাল লাইট জ্বললেই তারা সেগুলি তুলে নিতে নিচে নেমে আসে, যাতে গাড়ি চাপা পড়তে না হয়। কাক গাড়ির গতিবিধি লক্ষ্য রাখে। গাড়ি যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে উপর থেকে ফল ফেলে দেয় আর গাড়ি সেটি পিষে চলে যায়।
আপনার এলাকার ময়লাওয়ালাদের আসার সময়, ময়লা ফেলার স্থান, তাদের চলাচলের রাস্তা আপনার না-ই জানা থাকতে পারে, কিন্তু কাকেরা সব সময় জানে ময়লা কখন কোনদিক দিয়ে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে কাকেরা তাদের পছন্দমত জিনিসগুলি বেছে নেয়।
পৃথিবীর মাত্র ১০ ভাগ লোকই জীবন সম্পর্কে সচেতন যারা পৃথিবীতে ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে চলে। কিন্তু কাক কখনো কখনো ট্রাফিক সিগনালও লক্ষ্য করে। শুধুমাত্র লাল লাইট জ্বলাকালীন সময়েই কাক সেই ফল নিতে নিচে নামে যাতে গাড়ির নিচে চাপা পড়তে না হয়, বা কোনো অঘটন না ঘটে।কাকদের বুদ্ধিমত্তা গড়ে মানুষের চাইতে কিছুটা বেশিই বলা চলে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন